অনলাইন ক্লাস নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের অনুভূতি

করোনা সংক্রমণ মোকাবেলায় গত মার্চ মাস থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। করোনাভাইরাসের প্রভাবে পুরো বিশ্বজুড়ে যে স্থবিরতা নেমে এসেছে, তার ব্যাপক প্রভাব পড়েছে শিক্ষাঙ্গনে।

উন্নত দেশগুলো অনলাইন মাধ্যমকে শিক্ষাক্ষেত্রে কাজে লাগাতে অভ্যস্ত হওয়ায় শিক্ষা কার্যক্রম চলছে বেশ ভালোভাবেই। নানা প্রতিকূলতা পেরিয়ে বাংলাদেশেও চলছে অনলাইন ক্লাস।

৭ জুলাই থেকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েও অনলাইন মাধ্যমে ক্লাস নেয়া শুরু হয়েছে। এই ব্যবস্থাটি শিক্ষার্থীদের জন্য অনেকটাই নতুন। আসুন জেনে নিই নতুন এই পদ্ধতি বা অনলাইন শিক্ষা মাধ্যমের বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কে কি ভাবছেন-

 

ফাতেমা আফরোজ মিলি

৩য় বর্ষ, অর্থনীতি বিভাগ।

বর্তমান মহামারী অবস্থাতে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাবর্ষ না বাড়িয়ে ডিজিটাল পদ্ধতির আওতাভুক্ত অনলাইন ক্লাসের মাধ্যমেই বর্তমানে শিক্ষা ব্যবস্থা পরিচালিত হচ্ছে। স্কুল থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের পর্যায় পর্যন্ত একই পদ্ধতিতে কার্যক্রম চালু আছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হিসেবে আমাদেরও অনলাইন ভিত্তিক শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে। অনলাইনের মাধ্যমে ক্লাস করাটা আমাদের সবারই একটি নতুন অভিজ্ঞতা, যেহেতু এর আগে এটি কখনো করা হয়নি। আমার কাছে অনলাইন ক্লাসের অনুভূতি বলতে গেলে একদিক থেকে ইতিবাচক অন্য দিক থেকে নেতিবাচক দিকও রয়েছে।

প্রথমে ইতিবাচক দিকটা দিয়েই শুরু করি। অনলাইন ক্লাসের সবচেয়ে ইতিবাচক দিক হলো সম্পূর্ণ মনোযোগ দিয়ে ক্লাস করা যায়। বাসার মধ্যে একটি নিরিবিলি পরিবেশ পাওয়া যায় ক্লাস করার ক্ষেত্রে, যেটা আমরা আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাস রুমে অনেক সময় পাই না।

আরেকটা ইতিবাচক দিক হলো অনেক সময় বাঁচানো যায়। ভার্সিটিতে আসা যাওয়ায় যে সময়টা আমাদের রাস্তাঘাটের প্রচুর জ্যামের মুখোমুখি হতে হয় সেটা থেকে আমরা মুক্তি পাচ্ছি। বাসায় যেখানে ইচ্ছা সেখানে বসে ক্লাস করতে পারি। ক্লাস রুমের যে হৈচৈ বা সাইড টকিং ব্যাপারটা অনলাইন ক্লাসে থাকে না বিধায় বেশি মনোযোগ দেয়া সম্ভব হয়।

তবে এতকিছুর পরেও কিন্তু কিছু নেতিবাচক দিক থেকে যায়। অনলাইন ক্লাসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের নেটওয়ার্ক সিস্টেম। অনেক সময় দেখা গেল নেট অথবা ওয়াইফাই স্লো হয়ে যাচ্ছে, আবার দেখা গেল কারেন্ট নাই ওয়াইফাই অফ থাকে।

মোবাইলের ক্ষেত্রে চার্জ নিয়ে সমস্যা হয়। মাঝে মাঝে বৃষ্টি হলেতো কথাই নেই। বিদ্যুৎ এর সাথে সাথে নেটও পাওয়া যায়না।

আরেকটা সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে অনেকক্ষণ ধরে মোবাইলে বা কম্পিউটারে ক্লাস করার ফলে চোখে প্রচুর সমস্যা হচ্ছে। যেমন চোখে ব্যথা ও জ্বালা পোড়া হচ্ছে। শিক্ষকরা যে শিক্ষা উপকরণ (পিডিএফ, স্লাইড) সমূহ ক্লাসে সরবরাহ করছে সেগুলো স্ক্রিনে পড়তে গেলে এই শারীরিক সমস্যাটা হচ্ছে।

এখানে কিন্তু আমরা আমাদের বন্ধু বান্ধবদের সাথে আড্ডা দিতে পারছিনা। মজা করতে পারছিনা। এটা দীর্ঘ মেয়াদি হলে আসলে আমরা নিজেরা আত্মকেন্দ্রিক হয়ে যেতে পারি যা আসলে কারো জন্যই ভালো হবে না।

সবশেষ বলতে পারি, একটা পাঁচ মিশালি অনুভূতি হচ্ছে। একদিক থেকে ভালো তো অন্য দিক থেকে খারাপ।

 

রুবাইয়া রায়হান

২য় বর্ষ, সমাজকর্ম বিভাগ

করোনা প্রকোপে সাধারণ জীবন যাত্রা কতোটা বিপর্যস্ত সেটা কারো অজানা নয়। সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে সকল পর্যায়ে ব্যাপক পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। ঠিক তেমনি পরিবর্তন এসেছে প্রাইমারি থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায় পর্যন্ত, পাল্টে গেছে পাঠদানের ধরন, এসেছে নতুনত্ব। সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। সেই সম্পর্কে বলতে গেলে আমাকে বলতে হয় অনলাইন ক্লাস শুরু করা ভালো সিদ্ধান্ত ও যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত।

এতে করে শিক্ষা অর্জনের স্পর্শে থাকা যায়। যদিও প্রথমে টেকনিক্যাল কিছু কারণে আর অনলাইন ক্লাস সম্পর্কে অনভিজ্ঞ হওয়ায় আমাকে সমস্যার মুখোমুখি পরতে হয়েছে। এক পর্যায়ে শিক্ষকদের সহায়তা আর রুটিন মাফিক ক্লাস এর মাধ্যমে সমস্যাগুলো কাটিয়ে উঠতে পেরেছি। এক সেমিস্টার থেকে পরবর্তী  সেমিস্টারের উঠতে পেরেছি। যদিও পরীক্ষা পরে নেওয়া হবে।

ফিল্ড ওয়ার্ক করা, লাইব্রেরি গিয়ে বই সংগ্রহ এগুলো অনলাইন ক্লাসে সম্ভবপর না হলেও কিছুটা হলেও সেশনজট কমানো যাবে বলে আমি মনে করি, সেশন জট এড়াতে অনলাইন ক্লাস অন্যতম সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

 

রিয়াদ হোসেন

২য় বর্ষ, সমাজকর্ম বিভাগ

করোনাকালীন সংকটে দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, বাতিল করে দেয়া হয়েছে কয়েকটি পাবলিক পরীক্ষা। আটকে আছে উচ্চ মাধ্যমিক সার্টিফিকেট পরীক্ষা। দেশের বিশ্ববিদ্যালয় গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে মার্চ মাসের মাঝামাঝি সময় থেকে।

এমতাবস্থায় আমাদের মাঝে দেখা দিচ্ছিল সেশনজটে পরার আশংকা। পাশাপাশি দীর্ঘ  দিন ক্লাস রুমের বাইরে থাকায় পড়াশুনায় অনিয়মিত হয়ে পড়ছিলাম। তবে আমাদের অনলাইনে জুম অ্যাপ এর মাধ্যমে পাঠদান শুরু হওয়ায় কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে। পুনরায় শিক্ষকদের সান্নিধ্যে আসতে পারায় পড়াশুনায় নিয়মিত হওয়ার পাশাপাশি শিক্ষকদের দিকনির্দেশনা ও উৎসাহে মনোবল অনেকটাই বেড়েছে।

জুম অ্যাপ-এ প্রাতিষ্ঠানিক ক্লাসের মতই একইসাথে মতবিনিময় করতে পারায় জ্ঞানের আদন-প্রদান অব্যাহত রাখা সম্ভব হচ্ছে। ক্লাস নিয়মিত হওয়ায় এক সেমিস্টারের ক্লাস সম্পন্ন করে শিক্ষকরা অন্য সেমিস্টারের ক্লাস শুরু করে দিয়েছেন |

তবে ক্লাস নিয়মিত অনুষ্ঠিত হলেও পরীক্ষা না দিতে পারায় আমাদের একত্রে দুইটি সেমিস্টার পরীক্ষা নেওয়ার পরিকল্পনা করছে প্রশাসন যা শিক্ষার্থীদের বাড়তি চাপে ফেলে দিচ্ছে।

অনলাইন ক্লাস কল্যাণকর হলেও শতভাগ শিক্ষার্থী এর সুবিধা পাচ্ছে না। অনেকের ক্লাস করার জন্য উপযুক্ত ডিজিটাল ডিভাইস না থাকায় সুবিধা বঞ্চিত হচ্ছে। পাশাপাশি মেগাবাইটের উচ্চ মূল্য, স্বল্প মেয়াদ এবং দুর্বল নেটওয়ার্ক অনেকের জন্য বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই সকলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা সম্ভবপর হচ্ছে না।

ইউজিসি এবং টেলিটক চুক্তিতে আসলেও বেশিরভাগ শিক্ষার্থীর এ সিম না থাকায় এবং সিমের নেটওয়ার্ক সবজায়গায় সমান না হওয়ায় অনেকেই সেবা পাচ্ছে না ফলে ক্লাস করতে ব্যর্থ হচ্ছে। এর ফলে শিক্ষার্থীদের একাংশ পিছিয়ে পড়ছে।

সংকটকালীন এই সময়ে অনলাইনে পাঠগ্রহণে শিক্ষার্থীদের যে সকল সমস্যা হচ্ছে সেগুলো সমাধান করে সকলের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা গেলে কোভিড-১৯ ভাইরাসের ফলে বৈশ্বিক মহামারির এই পরিস্থিতিকে মোকাবেলা করে আমরা সবাই শিক্ষা কার্যক্রম নিয়মিত চালিয়ে যেতে পারব এবং সেশনজট নামক অভিশাপকে এড়াতে পারব বলে আশা করি।

 

 

সৈয়দ জোনায়েদ হোসেন

১ম বর্ষ, মার্কেটিং বিভাগ

সভ্যতার আমূল পরিবর্তন হলেও কিছু বিষয় আছে যার পরিবর্তনে ভালো ফল পাওয়া যায় না। তেমনি একটি হচ্ছে অনলাইন ক্লাস।

করোনার মহামারিতে পুরো পৃথিবী থমকে গেছে, থমকে গেছি আমরা। জানুয়ারির শুরুর দিকে পরিকল্পনার যে চিত্র এঁকেছি মার্চে এসে সব ভেস্তে গেল। করোনার প্রভাবে স্বপ্নের শহর ছেরে পাড়ি জমাতে হল গ্রামে। ভয়ে ভয়ে কাটছিল প্রতিটা সময়। বাহিরে যাওয়া বারণ, করোনার ভয়।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ, পড়ালেখার দিক থেকে অনেকটা ক্ষতির মুখেই পড়তে হল। বাড়িতে আসার সময় সব বই আনা হয়নি, কেননা বুঝে উঠতে পারিনি এতটা সময় আটকে থাকতে হবে।

কিছুদিন পর শুরু হল অনলাইন ক্লাস, বুঝে উঠতে পারিনি কি করব। কেননা গ্রামে ইন্টারনেটের অনেক সমস্যা, ফোর জি পাওয়া যায় না ঠিক ভাবে।

তাছাড়া ওয়াইফাই না থাকায় প্রতিনিয়ত ডাটা প্যাক কিনে ক্লাস করাটা কষ্টসাধ্য হয়ে উঠল। স্যাররা যথেষ্ট চেষ্টা করেন আমাদের পড়া বুঝানোর কিন্তু অনেক বিষয় আছে যা অফলাইনে অনলাইন থেকে অনেকটা ইফেক্টিভ।

মাঝে মাঝে সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি কারেন্ট থাকে না যার ফলে দেখা গেছে অনেক সময় ক্লাসের সময় ফোন বন্ধ থাকে মূল্যবান ক্লাস হারাতে হয়। ক্লাস উপস্থিতি নাম্বার অনেক সময় হতাশ করে তোলে, কেননা ইচ্ছে থাকলেও ক্লাসে জয়েন দেওয়া যায় না। প্রতিনিয়তই কোনো না কোনো সমস্যার মুখে পড়তে হয়।  সব সমস্যার পরেও একটা স্বস্তির বিষয় হচ্ছে ক্লাসের জন্য বইয়ের সাথে সম্পর্কের উন্নতি ঘটছে।

 

টাইমস/সুমন/এনজে

Share this news on: