লবণ ব্যবসার আড়ালে যেভাবে করতো কোটি টাকার আইস ব্যবসা

মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া থেকে অবৈধ মাদক আইসের (ক্রিস্টালমেথ) সর্ববৃহৎ চালানসহ পাঁচ জনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-১৫। 

বুধবার রাতে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়। পরে বৃহস্পতিবার রাজধানীর র‌্যাবের মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে তাদের ব্যাপারে বিস্তারিত জানান সংস্থাটির আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন। 

গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা হলেন- চক্রের হোতা মো. জসিম উদ্দিন (৩২), মকসুদ মিয়া (২৯), মো. রিয়াজ উদ্দিন (২৩), শাহিন আলম (২৮) ও মো. সামছুল আলম (৩৫)। এ সময় তাদের কাছ থেকে ১২ কেজি আইস/ক্রিস্টাল মেথ (যার আনুমানিক মূল্য ৫০ কোটি টাকা), এক লাখ পিস ইয়াবা, ৪,৬০০ পিস চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন, দুটি বিদেশি পিস্তল, ৯ রাউন্ড গোলাবারুদ, দুটি টর্চ লাইট, বার্মিজ সিমকার্ড, এক লাখ ৬৪ হাজার টাকা, এক লাখ বার্মিজ মুদ্রা ও পাঁচটি মোবাইল ফোন জব্দ করা হয়। 

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের বরাতে র‌্যাব জানায়, গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা মিয়ানমারের মাদক চক্রের যোগসাজশে দেশে অবৈধ আইস কারবারের সঙ্গে জড়িত। দেশে জসিমের নেতৃত্বে এই মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। তিনি লবণের আড়ালে আইসের এই ব্যবসাটি করতেন। 

খন্দকার আল মঈন জানান, গ্রেপ্তার জসিমের নেতৃত্বে এই মাদক সিন্ডিকেটের কার্যক্রম পরিচালিত হয়। দেশে এই চক্রের ১২/১৫ জন সদস্য রয়েছে। চক্রটি মূলত সোনাদিয়া কেন্দ্রিক একটি মাদক চোরাকারবারী চক্র। ঢাকা, মুন্সিগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, মানিকগঞ্জ, বরিশাল ইত্যাদি এলাকায় বিভিন্ন কৌশলে মিয়ানমার থেকে নিয়ে আসা অবৈধ মাদক ক্রিস্টাল আইস ও ইয়াবা পৌঁছাত। মূলত নৌপথে বিভিন্ন কৌশলে পার্শ্ববর্তী দেশ মিয়ানমার থেকে মাদক নিয়ে আসত তারা। বাংলাদেশের অভ্যন্তরেও সাম্প্রতিক সময়ে তারা নৌপথকে প্রাধান্য দিয়ে ঢাকাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করত।  

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আরও জানা যায়, মিয়ানমারের এই চক্রের সদস্যরা সেদেশ থেকে বাংলাদেশে ক্রিস্টাল আইস ও ইয়াবা সাগর পথে পাচার করে আসছে। সেন্টমার্টিন দ্বীপের দক্ষিণে গভীর সমুদ্রে ট্রলারের মাধ্যমে মিয়ানমারের চক্র বাংলাদেশের এই চক্রের কাছে ইয়াবা ও আইসের চালান হস্তান্তর করে। চালান গ্রহণ ও নিরাপদ স্থলে পৌঁছানোর জন্য এ চক্রের সদস্যরা ২০/২৫ দিন জেলেদের ছদ্মবেশ নিয়ে গভীর সমুদ্রে অবস্থান করে। পরে সুবিধাজনক সময়ে তারা সোনাদিয়া দ্বীপে চলে আসেন। এরপর সেগুলো সোনাদিয়া ও মহেশখালী দ্বীপের বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়। সুবিধাজনক সময়ে চক্রটি সোনাদিয়া থেকে দুইটি বোটের মাধ্যমে সেই চালান নোয়াখালীর হাতিয়াতে নিয়ে আসত। হাতিয়ায় পৌঁছালে চক্রটির স্থানীয় সদস্যদের তত্ত্বাবধানে চালান সংরক্ষণ করা হয়। এরপর পুনরায় ইঞ্জিনচালিত নৌকায় মেঘনা নদী হয়ে মুন্সিগঞ্জের গজারিয়া/ঢাকার আশপাশে অথবা সুবধিাজনক স্থানে পৌঁছাত। ঢাকা ছাড়াও এরা বরিশাল, পটুয়াখালী ইত্যাদি অঞ্চলে মাদক সরবরাহ করতো। 

সংবাদ সম্মেলনে আরও জানানো হয়, মাদকের চালান মুন্সীগঞ্জে পৌঁছানোর পর রাজধানীর একটি চক্র তা গ্রহণ করে এবং সড়কপথে বিভিন্ন মাধ্যমে কৌশলে মুন্সীগঞ্জ থেকে ঢাকায় নিয়ে যায়।

উল্লেখ্য, নৌপথে মাদক পরিবহনে তারা বিভিন্ন নিরাপত্তা ও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখকে ফাঁকি দেওয়ার জন্য চক্রটি দুটি বোট ব্যবহার করে। সামনের বোটটিকে নজরদারিতে ব্যবহার করত এবং পরের বোটটিতে মাদক বহন। মোবাইল অথবা টর্চ লাইট সিগন্যালের মাধ্যমে উভয় বোটের সদস্যরা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করত। 

র‌্যাব জানায়, জসিম দীর্ঘ ৫/৭ বছর যাবত মাদক চোরাচালানের সঙ্গে জড়িত। তিনি লবণ ব্যবসার আড়ালে আইসের কারবারে জড়িত। তিনি মূলত মিয়ানমারের মাদক সিন্ডিকেটের সঙ্গে সমন্বয় সাধন করতেন। তার নেতৃত্বে চক্রটি প্রথমে মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আনতো। পরবর্তীতে রাজধানীসহ বিভিন্ন স্থানে ক্রিস্টাল আইসের চাহিদা বৃদ্ধি পেলে গত বছর থেকে আইস আনা শুরু করেন। তিনি রাজধানী থেকে কয়েকটি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চেতনানাশক মাদক সিডাকটিভ ইনজেকশন সংগ্রহ করে নৌপথে দেশের বিভিন্ন স্থানে পৌঁছে দিতেন। 

এ ছাড়া গ্রেপ্তার শাহীন আলম জসিমের অন্যতম প্রধান সহযোগী। তিনি সাগর ও নৌপথে মাদক পরিবহনের মূল দায়িত্ব পালন করেন। তার বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় মানব পাচার ও মারামারি সংক্রান্ত দুটি মামলা রয়েছে। শামছুল আলমের বিরুদ্ধে মহেশখালী থানায় অস্ত্র ও মারামারি সংক্রান্ত তিনটি মামলা রয়েছে। মকসুদের বিরুদ্ধে অস্ত্র ও ডাকাতি সংক্রান্ত ছয়টি মামলা রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন বলে জানিয়েছে র‌্যাব। 

Share this news on: