খোলা আকাশের নিচে ঘর-সংসার

মাথার ওপরে মশারি বাঁধা, তার পাশে দুটি ছোট ছোট ব্যাগ, তার পাশে আরেকটি ব্যাগে পেঁয়াজ-রসুন-আলু রাখা। আর তার নিচে এক পাশে কাঁথায় মোড়ানো তোশক-বিছানা। বিছানার ঠিক পাশেই ব্যানার বিছিয়ে শুয়ে আছেন অসুস্থ গুলজার মিয়া। বয়স ষাটের কাছাকাছি। এই দৃশ্য রাজধানীর পলাশী-নীলক্ষেত রাস্তার পাশে ফুটপাতের।  

গুলজার মিয়ার সঙ্গে কথা বলতে চান বাংলাদেশ টাইমসের এই প্রতিবেদক। কিন্তু ইশারায় জানালেন, তিনি কথা বলতে পারবেন না। একটু দূরেই বসেছিল গুলজার মিয়ার দ্বিতীয় শ্রেণিতে পড়ুয়া মেয়ে রাশিদা বেগম।

সে জানায়, অনেক দিন থেকে তার বাবা অসুস্থ। কথা বলতে পারে না, হাত-পা নাড়াচাড়া করতে পারেন না।

রাশিদা জানায়, তাদের গ্রামের বাড়ি লালমনিরহাট। কয়েক মাস ধরে তার বাবা অসুস্থ। আর তার মা আলেয়া বেগম রাজধানীর বিভিন্ন বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। তারা সবাই এই ফুটপাতেই থাকেন।

পলাশী এলাকায় একটি প্রাইমারি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণিতে লেখাপড়া করে রাশিদা। সে জানায়, মা আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়েছেন। স্কুল থেকে এসে বাবার পাশে থাকি। আর রাতে বাবাকে নিয়ে ফুটপাতেই ঘুমিয়ে পড়ি।

শুধু গুলজার মিয়া নন প্রায় অর্ধ শতাধিক পরিবার পলাশী থেকে নীলক্ষেত যাওয়া রাস্তার ডান পাশের এই ফুটপাতে বসবাস করেন। অবাক করা বিষয় হচ্ছে, এসব পরিবারগুলোর মধ্যে কেউ কেউ ২০-৩০ বছর ধরে এখানে বসবাস করছেন।

নানান প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়ে ফুটপাতেই ঘর-সংসার করছেন তারা। বাংলাদেশ টাইমসের এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় বেশ কয়েকটি পরিবারের। পরিবারগুলোর অধিকাংশ নারীরা রাজধানীর বিভিন্ন বাসা-বাড়িতে গৃহকর্মীর কাজ করেন। আর পুরুষরা রিকশা, ভ্যান ইত্যাদি চালান।

হবিগঞ্জের লাখাই উপজেলার বাসিন্দা আমেনা বেগম (৬০)। স্বামী পরিত্যক্তা আমিনা প্রায় ৩০ বছর ধরেই এখানে বসবাস করছেন। তিনি বাংলাদেশ টাইমসকে বলেন, অভাবের তাড়নায় প্রায় ৩০ বছর আগে তাদের গ্রামের পরিচিত একজনের সঙ্গে ঢাকায় এসেছিলেন। কাজের সন্ধানে ঢাকায় এসে পলাশী এলাকার ফুটপাতেই বসবাস শুরু করেন তিনি। পরিচিত লোকটি চলে গেলে তিনি ফুটপাতেই থেকে যান। বিয়ে করেন রিকশাচালক আব্দুল জব্বারকে। স্বামী রিকশা চালায়, আর তিনি বাসায় গৃহপরিচারিকার কাজ করেন। এভাবে চলছিল তাদের সংসার। কয়েক বছর পর একদিন স্বামী আব্দুল জব্বার তাকে রেখে উধাও হন। এরপর থেকেই তিনি এখানে একাই থাকছেন।

বাংলাদেশ টাইমসের সঙ্গে কথা বলার সময় ফুটপাতে দুপুরের খাবার রান্না করছিলেন তিনি। অতীতের কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি। কিছুক্ষণ পর আবার কথা বলা শুরু করেন।

তিনি বলেন, ত্রিশটি বছর এভাবে রান্না করেছি। এখন অনেক অসুস্থ। কেউ কাজেও নেয় না। তবে ব্যাচেলরদের একটি মেসে কাজ করেন তিনি। আক্ষেপ করে বলেন, আমার সন্তান নেই। এছাড়াও ভিক্ষা করতেও লজ্জা লাগে। তাই এখনো কাজ করে যাওয়ার চেষ্টা করছি।

একই ফুটপাতে বসবাস করেন নূর নাহার নামে আরেক নারী। তিনি বাংলাদেশ টাইমসকে জানান, প্রায় আট বছর থেকে সেখানে তিনি বসবাস করছেন।

পারভীন আক্তার নামে একজন জানান, পরিবারে সঙ্গে প্রায় ১০ বছর এই ফুটপাতে থেকেছেন তিনি। এখন আজিমপুর কলোনির এক বাসায় থাকেন। তবে মাঝে মাঝে ফুটপাতে থাকা পরিচিতদের দেখতে চলে আসেন তিনি।

 

তিনি আরো জানান, দেশের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিম্ন আয়ের অনেকেই ঢাকা এসে থাকার জায়গা পায় না। তাই ফুটপাতকেই বেছে নেয় তারা। পরে একটু স্বাবলম্বী হলে তারা ভাড়া বাসা নিয়ে অন্যত্র চলে যান।

 

 

টাইমস/কেআরএস/এসআই

Share this news on:

সর্বশেষ