ডা. রাজনের মৃত্যুর প্রকৃত কারণ জানা যায়নি

খাদ্যমন্ত্রী সাধন চন্দ্র মজুমদারের জামাতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) চিকিৎসক ডা. রাজন কর্মকারের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়েছে। সোমবার সকালে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ডা. রাজনের ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়।

ডা. রাজনের ময়নাতদন্তকারী শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক ডা. আ ম সেলিম রেজা জানান, ‘মৃত্যুর কারণ অনুসন্ধানের জন্য তার ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করেছি। প্রাথমিকভাবে মৃত্যুর কারণ নিশ্চিত হওয়ার মতো কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে কারণ জানার জন্য ভিসেরাসহ অন্যান্য উপাদান হিস্টোপ্যাথলজির জন্য ল্যাবে পাঠানো হয়েছে। সেগুলো না আসা পর্যন্ত কিছুই বলতে পারব না।’

ময়নাতদন্তের রিপোর্ট পেতে কতদিন লাগতে পারে এ বিষয়ে জানতে চাইলে ডা. সেলিম রেজা বলেন, ‘ভিসেরাসহ যে উপাদানগুলো ল্যাবে পাঠানো হয়েছে সেগুলোর ফলাফল পেতে এক থেকে দুই মাসের মতো সময় লাগে। টেস্টের রেজাল্ট পেলে আমরা মৃত্যুর কারণ সম্পর্কে জানতে পারব।’

ডা. রাজনের মৃত্যু সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে

রোববার ভোর পৌনে ৪টার দিকে ডা. রাজনকে পরিবারের সদস্যরা রাজধানীর স্কয়ার হাসপাতালে নিয়ে আসেন। তাকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার পর লাইফের কোনো সাইন পাওয়া যায়নি বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন স্কয়ার হাসপাতালের জরুরি বিভাগের চিকিৎসক আসাদুজ্জামান।

ডা. রাজনের দেহে কোনো জখম ছিল না বলে জানান এই চিকিৎসক। তবে ডা. রাজনের মৃত্যু নিয়ে তার পরিবার ও শ্বশুরবাড়ির সদস্যরা দুই রকম তথ্য দিয়েছেন।

খাদ্যমন্ত্রীর বড় মেয়ে ডা. কৃষ্ণা মজুমদারের স্বামী ডা. রাজন কর্মকার বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ওরাল অ্যান্ড ম্যাক্সিলোফেসিয়াল বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ছিলেন। তার স্ত্রী কৃষ্ণাও বিএসএমএমইউর চিকিৎসক।

৩৯ বছর বয়সী রাজন কর্মকারের মৃত্যু নিয়ে তার মা, ভাই ও সহকর্মীদের অভিযোগ, তিনি হত্যার শিকার হয়েছেন।

রাজনের চাচাত ভাই অভি রোববার সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমাদের সন্দেহ তাকে হত্যা করা হয়ে থাকতে পারে। আমরা তার লাশের ময়নাতদন্ত করাতে চাই।’

রাজনের মামা সুজন কর্মকারও ময়নাতদন্তের মাধ্যমে মৃত্যুর কারণ জানতে চেয়েছিলেন। রাজনের সহকর্মীরা যারা স্কয়ার হাসপাতালে ছিলেন, তারাও সাংবাদিকদের বলেন, তারা এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত চান।

রাজনকে হত্যা করা হয়েছে অভিযোগ তুলে তার গ্রামের বাড়ি নোয়াখালীতে সড়ক আটকে বিক্ষোভ করেছেন তার স্বজন ও গ্রামবাসী। তাদের অভিযোগের আঙুল রাজনের স্ত্রী কৃষ্ণা মজুমদারের দিকে। কৃষ্ণা নিজেও বিএসএমএমইউয়ের সহকারী অধ্যাপক, তার বাবা খাদ্যমন্ত্রী সাধন মজুমদার।

স্কয়ার হাসপাতালের পেছনে ইন্দিরা রোডের একটি ভবনের চারতলায় তিন বছর ধরে থাকতেন রাজন ও কৃষ্ণা দম্পতি। ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীরা জানান, নিয়মিত বাসা ভাড়া দিয়ে গেলেও থাকতেন না এই দম্পতি। আর কৃষ্ণার বাবা সাংসদ নির্বাচিত হওয়ার পর তারা আরও কম এখানে থাকতেন।

মো. ইউনুস নামের একজন নিরাপত্তাকর্মী জানান, শনিবার দিবাগত রাত একটার দিকে রাজন বাসায় ঢোকেন। ১৫ থেকে ২০ মিনিট পরে বেরিয়ে আধা ঘণ্টা পরে ফেরেন। রাত আনুমানিক তিনটার দিকে ওই বাসায় বড় একটি জিপ গাড়ি নিয়ে আসেন কৃষ্ণা মজুমদার। ওই গাড়িটিকে নিরাপত্তাকর্মীরা ‘মন্ত্রীর গাড়ি’ (কৃষ্ণার বাবার ব্যবহৃত) হিসেবে জানেন। নিচে চালককে রেখে সিঁড়ি দিয়ে ওপরে যান কৃষ্ণা।

আনুমানিক সাড়ে তিনটার দিকে কৃষ্ণা তার আনা গাড়িটির চালককে ফোন করে দ্রুত আরেকজনকে নিয়ে ওপরে যেতে বলেন। গাড়িচালক চিৎকার করে নিরাপত্তাকর্মীদের ওপরে যেতে বলেন, লিফট চালু করতে বলেন। চালকের সঙ্গে ইউনুস রাজনের ফ্ল্যাটে গিয়ে দেখেন রাজন চিৎ হয়ে মেঝেতে পড়ে রয়েছেন। কৃষ্ণা কাঁদছেন আর বিড়বিড় করে বলছেন ‘কেন এমন হলো’। রাজনকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়ার জন্য তাড়া দিতে থাকেন কৃষ্ণা। ইউনুস ও চালক মিলে চিকিৎসক রাজনের সংজ্ঞাহীন দেহটি ধরে লিফটে নামিয়ে গাড়িতে তুলে দেন। এরপর তারা হাসপাতালের দিকে চলে যান।

স্কয়ার হাসপাতাল থেকে রাজনের ফ্ল্যাট হেঁটে ১০ মিনিটের দূরত্বে। ওই হাসপাতাল থেকে দেওয়া মৃত্যুর সনদপত্রে মৃত্যুর সময় লেখা রয়েছে ভোররাত চারটা। এখানে আনার আগেই তার মৃত্যু হয়েছে বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

রাজন কর্মকারের বাবা সুনিল কর্মকার ও মা খুকু রানী কর্মকার দুজনই ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তারা বর্তমানে অবসরে। দুই ভাই ও এক বোনের সংসারে রাজন ছিলেন দুই ভাইয়ের মধ্যে বড়।

রাজনের মৃত্যুকে ‘পরিকল্পিত হত্যা’ দাবি করে এর বিচারের দাবিতে নোয়াখালীর বেগমগঞ্জে সড়ক আটকে বিক্ষোভ ও মানববন্ধন করেছেন রাজনের স্বজন ও গ্রামের মানুষ। রোববার বিকাল সাড়ে পাঁচটার দিকে চৌমুহনী-মাইজদী মহাসড়ক অবরোধ করেন তারা। এসময় সড়কের দুই দিকে অসংখ্য যানবাহন আটকা পড়ে। পরে বেগমগঞ্জ থানার পুলিশ ঘটনাস্থলে এলে প্রায় এক ঘণ্টা পর অবরোধ তুলে নেওয়া হয়।

রাজনের মা খুকু রানীর অভিযোগ

মানববন্ধন ও সড়ক অবরোধ চলাকালে রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার পাশের বাড়ি থেকে সড়কের ওপর এসে ‘ছেলে হত্যার’ বিচারের দাবিতে আহাজারি করতে থাকেন। তিনি এ সময় সড়কে লুটিয়ে পড়েন। এ সময় উপস্থিত জনতা রাজনকে হত্যা করা হয়েছে দাবি করে বিচারের দাবিতে বিভিন্ন স্লোগান দিতে থাকেন।

রাজনের মা খুকু রানী কর্মকার বলেন, শনিবার রাত দুইটার দিকে তার মুঠোফোনে পুত্রবধূ কৃষ্ণার ফোন আসে। রাগী স্বরে কৃষ্ণা তাকে বলেন, ‘আমি আপনাকে আর আপনার ছেলেকে জেলের ভাত খাওয়াব।’ বলেই ফোন কেটে দেন। খুকু রানী এরপর ছেলে রাজনকে ফোন করেন। রাজন বলেন, ‘মা, তুমি চুপ করো। তুমি কোনো কথা বোলো না।’ রাজন এটা বলেই ফোন কেটে দেন। এরপর তিনি অনেকবার ছেলেকে ফোন করেও পাননি। পরে ভোররাত চারটার দিকে তার ছোট ছেলে রাজিবের মুঠোফোনে রাজনের মৃত্যুর খবর আসে।

রাজনের ছোট ভাই রাজীব কর্মকার বলেন, ভোররাত চারটার দিকে তার ভাইয়ের শ্যালিকা মুন্নি তাকে ফোন করে বলেন, ‘নিকটাত্মীয় কেউ ঢাকায় থাকলে হাসপাতালে পাঠান।’ এরপর মুন্নী তাদের আত্মীয় রাজেশ মজুমদারকে ফোনটি দিলে তিনি রাজীবকে ভাইয়ের মৃত্যুর কথা জানান।

রাজনের মা ও ভাই জানান, ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি পারিবারিকভাবে রাজনের সঙ্গে কৃষ্ণার বিয়ে হয়। বিয়ের পর থেকেই তাদের দাম্পত্য কলহ শুরু হয়। রাজনের গায়ে হাতও তুলতেন কৃষ্ণা। প্রায় দেড় বছর আগে কৃষ্ণার প্রচণ্ড মারধরে রাজনকে হাসপাতালে পর্যন্ত ভর্তি হতে হয়। তখন তাকে আইসিইউতে নিতে হয়েছিল।

খুকু রানী কর্মকার দাবি করেন, তার ছেলের বউ পরিকল্পিতভাবে তার ছেলেকে হত্যা করেছে। তিনি এর বিচার চান।

রাতে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জানে আলম মুন্সী বলেন, রাজনের মামা সুজন থানায় একটি অভিযোগ দিয়েছেন। যেখানে তিনি অভিযোগ করেছেন, রাজনের মৃত্যু নিয়ে তার সন্দেহ আছে। তবে সন্দেহভাজন হিসেবে কারও নাম দেওয়া নেই। এর জন্য তারা রাজনের ময়নাতদন্ত করছেন।

 

খাদ্যমন্ত্রীর জামাতা ডা. রাজনের রহস্যজনক মৃত্যু, পরিবারের দাবি হত্যাকাণ্ড

 

 

টাইমস/এসআই

 

Share this news on: