ভারতীয় মিডিয়ার সুরেই কথা বলছেন তুলসী গ্যাবার্ড। কোনো নির্দিষ্ট তথ্য-প্রমাণ ছাড়া তুলসীর বিভ্রান্তিকর বক্তব্য ভারতীয় প্রোপাগাণ্ডারই বাস্তবায়ন। বাংলাদেশে ধর্মীয় সংখ্যালঘুর ওপর নির্যাতন এবং ইসলামি খেলাফত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা সত্যের অপালাপ। এসব কথা বলে যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধানের মন্তব্যের তীব্র প্রতিবাদ জানিয়েছেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল এবং কূটনৈতিক বিশ্লেষকরা। ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের নেতারাও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমনির্ভর হয়ে তুলসী গ্যাবার্ডের দেয়া এই ধরনের অভিযোগকে সম্পূর্ণ মিথ্যা বলে প্রতিবাদ জানিয়েছেন।
এরই মধ্যে তুলসী গ্যাবার্ডের মন্তব্যে আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে তার মন্তব্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করছে জানিয়ে প্রতিবাদ করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, গ্যাবার্ডের এই ধরনের বিভ্রান্তিকর অভিযোগ অন্যায় ও অতিরঞ্জিতভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। তবে ট্রাম্পের নিয়োগপ্রাপ্ত এই কর্মকর্তার বক্তব্য ঘিরে বিস্তর আলোচনা-সমালোচনা শুরু হলেও এটি বাংলাদেশের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপক্ষীয় বা বহুপক্ষীয় সম্পর্কে প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনার পতন ঘিরে দেশে রাজনৈতিক কারণে কিছু সহিংসতা হলেও সংখ্যালঘুদের ওপর আক্রোশ থেকে কোনো হামলা হয়নি বলে দাবি প্রথম সাড়ির রাজনৈতিক দলগুলোর। তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় সরকারের ভাষ্যের সঙ্গে একমত পোষণ করেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল-বি/এন/পি। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘এটা নিয়ে সরকারের পক্ষ থেকে একটা বক্তব্য দেয়া হয়েছে। তার সঙ্গে সারা দেশবাসী একমত। সরকার বলেছে, বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে যেসব মিস ইনফরমেশন, তার ভিত্তিতে তুলসী গ্যাবার্ড বক্তব্য দিয়েছে। সরকার এটা কনডেম করেছে। আমরাও কনডেম করি।’
যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দা প্রধানের বিতর্কিত মন্তব্যের বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল মিয়া গোলাম পরওয়ার বলেন, ‘আমরা তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের তীব্র নিন্দা জানাই। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গোয়েন্দাপ্রধান হিসাবে তিনি বাংলাদেশ নিয়ে যে মন্তব্য করেছেন, তাদের ভাষায় সংখ্যালঘুরা নির্যাতনের শিকার, তাদের অধিকার খর্ব করা হচ্ছে, কিন্তু এই কথাগুলো একেবারেই অসত্য। এগুলো আবার ভারতীয় গণমাধ্যমে ফলাও করে প্রচার করা হয়। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক উত্তরণের স্থিতিশীল পরিবেশকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য এটি আন্তর্জাতিক চক্রান্ত বলেই আমরা মনে করি।’
শিক্ষার্থীদের নবগঠিত রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি-এন/সি/পি’র যুগ্ম-আহ্বায়ক সারোয়ার তুষারের মতে, তুলসী গ্যাবার্ড ভারতে এসে বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে উদ্বেগ দেখিয়েছেন। তার এমন মন্তব্যের মধ্য দিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সরকার বা রাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গি প্রকাশিত হয়নি। এটা সম্পূর্ণ তার ব্যক্তিগত মন্তব্য। ভারতে বাংলাদেশবিরোধী যেসব প্রোপাগান্ডা হয় তিনি সেটা দ্বারা বিভ্রান্ত হয়ে এই মন্তব্য করছেন। বাস্তবতা হচ্ছে তার কাছে প্রকৃত সত্য নেই। তিনি যা বলেছেন তা ভিত্তিহীন। বাংলাদেশের সংখ্যালঘুরা অন্য যে কোনো সময়ের থেকে অনেক ভালো অবস্থায় রয়েছেন। তার এমন প্রমাণহীন মন্তব্য নিয়ে আমরাও উদ্বিগ্ন।
জানা গেছে, তুলসী গ্যাবার্ড নামে হিন্দু পরিচয় ধারণ করলেও তিনি ভারতীয় কিংবা হিন্দু ধর্মের অনুসারী নন। তার পুরো পরিবার আমেরিকান খ্রিষ্টান। কিন্তু তার মা ক্যারল এক সময় হিন্দুধর্মে দিক্ষা নিয়েছিলেন এবং তার সন্তানদের নামে হিন্দু ছোঁয়া রেখেছেন। তবে তুলসী গ্যাবার্ড কংগ্রেসের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে ভগবৎ গিতার ওপর হাত রেখে শপথ নেয়ায় তার ধর্মীয় পরিচয় নিয়েও জল ঘোলা করছে একটি মহল। অনেকে বলছেন, তুলসী যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম হিন্দু কংগ্রেস সদস্য। শুধু তাই নয়, তিনি হিন্দুদের আন্তর্জাতিক সংগঠন ইসকনের সঙ্গে সক্রিয়ভাবে যুক্ত। অনেকে আবার বলছেন, তুলসী আপদমস্তক প্র্যাকটিসিং হিন্দুধর্মের অনুসারী। সে কারণে শুরু থেকেই হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তর রাষ্ট্র ভারত ও ভারতের জনগণের প্রতি তুলসীর ধর্মীয় অনুভূতি ও আবেগ রয়েছে।
সেই ধর্মীয় আবেগ থেকেই তিনি বাংলাদেশ সম্পর্কে নেতিবাচক ও অসত্য মন্তব্য করছেন বলে দাবি করেছেন দেশের বেশ কিছু ধর্মীয় সংগঠন। অনেকে বলছেন, ভারতের যেসব মৌলবাদী হিন্দুরা বাংলাদেশ সম্পর্কে সংখ্যালঘু কার্ড খেলতে হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে প্রোপাগান্ডায় লিপ্ত, তুলসী সেখানে তাল দিয়েছেন মাত্র। তারা বলছেন, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম হলেও হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টানসহ সব ধর্মের অনুসারীরা সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশে ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান পালন করে আসছেন যুগযুগ ধরে। রাজনৈতিক কারণে এখানে সংখ্যালঘু নির্যাতনের ট্রাম্পকার্ড খেলা হয়। ৫ আগস্টের পর থেকে ভারত এ খেলা শুরু করেছে। পতনের পর আওয়ামী লীগ ও শেখ হাসিনারাও নানাভাবে সেই চেষ্টা করে যাচ্ছে। ভারত ছাড়া আর একটি দেশও এ নিয়ে উদ্বেগ পর্যন্ত জানায়নি। বরং এবার তুলসী গ্যাবার্ডের বক্তব্যের পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে যে প্রতিবাদ জানানো হয়েছে, তা নিজেদের ফেসবুক পেজে শেয়ার করেছে ঢাকাস্থ ফরাসি দূতাবাস।
হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান কল্যাণ ফ্রন্টের চেয়ারম্যান ও সাবেক সচিব বিজন কান্তি সরকারের ভাষ্য, ‘সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে কথা বলা হচ্ছে, ১৯৭২ সাল থেকে এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি নির্যাতন হয়েছে আওয়ামী লীগের সময়ে। অন্য সময়ে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা আসলে রাজনৈতিক কারণে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে বলা হয়। বাংলাদেশে সংখ্যালঘু নির্যাতনের কথা যেভাবে বলা হয়েছে, সে মাত্রায় হয়নি বলে দাবি করেছেন ধর্ম উপদেষ্টা আ ফ ম খালিদ হোসেন। তিনি বলেন, ‘দেশে কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটেছে। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে সরকার।’
এদিকে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, আঞ্চলিক শান্তির জন্য তুলসী গ্যাবার্ডকে বাংলাদেশ যে হুমকি মনে করে, এটা তাদের স্টেট ডিপার্টমেন্ট ও পেন্টাগনে জানিয়ে দেয়া উচিত। সে সম্পূর্ণ ব্যক্তিগত অভিপ্রায়ে তার ধর্মবিশ্বাস, এবং ভারতের হিন্দুত্ববাদী চিন্তাধারার সমর্থনে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপবাদ দিচ্ছে। এটা যে কত বড় মিথ্যা, এর প্রমাণ হচ্ছে পৃথিবীর আর কোনো দেশ এমন কোনো অভিযোগ আনেনি। তুলসী গ্যাবার্ডের এ মন্তব্য একেবারে অকূটনৈতিক দাবি করে তারা বলেন, ‘তুলসী গ্যাবার্ডকে গোয়েন্দা প্রধানের গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে না সরালে তিনি মার্কিন জাতীয় স্বার্থকেও ক্ষতিগ্রস্ত করবেন।’
টিএ/