আট মাসে ধর্ষণের শিকার ৮৮৯ নারী, মৃত্যু ৪১ জনের

বাংলাদেশে প্রতিদিনই ঘটছে ধর্ষণ ও ধর্ষণের পর হত্যার মতো নৃশংস ঘটনা। ধর্ষকের লোলুপ দৃষ্টি থেকে বাদ যাচ্ছে না কন্যাশিশু, বৃদ্ধ নারী এমনকি প্রতিবন্ধীরাও।

সম্প্রতি মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্র (আসক) এক পরিসংখ্যানে জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত ধর্ষণের শিকার হয়েছে ৮৮৯ জন নারী। ধর্ষণের পরে মৃত্যু হয়েছে ৪১ জনের। সে হিসেবে চলতি বছর গড়ে প্রতিমাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ১১১ জন নারী।

সংস্থাটির পরিসংখ্যান থেকে আরও জানা যায়, ২০১৯ সালে ১ হাজার ৪১৩ নারী ধর্ষণ এবং ধর্ষণের পর হত্যার শিকার হয়েছেন ৭৬ জন। আর আত্মহত্যা করতে বাধ্য হয়েছেন ১০ নারী। এছাড়া ২০১৮ সালে ৭৩২ জন এবং ২০১৭ সালে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন ৮১৮ নারী।

সর্বশেষ গত শুক্রবার স্বামীর সঙ্গে বেড়াতে গিয়ে সিলেট এমসি কলেজ ছাত্রাবাসে ধর্ষণের শিকার হয়েছেন এক তরুণী। যা সারাদেশ আলোচিত হচ্ছে। এছাড়া চট্টগ্রামসহ, সিলেটসহ দেশের কয়েক জায়গায় ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে বলে আজও সংবাদ মাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে।

ধর্ষণের মতো অপরাধ বাড়ার কারণ হিসেবে বিচার না হওয়াকে দায়ী করছেন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) আইনি সহায়তাকারী অ্যাডভোকেট মাকসুদা আক্তার লাইলী।

তিনি জানান, ধর্ষণের ক্ষেত্রে তো বিচার হয় না। আর বিচার না হলে এমন ঘটনা তো বাড়বেই। আইনে আছে ১৮০ দিনের মধ্যে বিচার হতে হবে। কিন্তু বাস্তবে বিচার হতে ৮ থেকে ১০ বছর লেগে যায়। বিচারের এ দীর্ঘসূত্রতা তো রয়েছেই, এর সঙ্গে যোগ হয়েছে বিচারকার্যে রাজনৈতিক প্রভাবও। সব মিলিয়ে বিচারহীনতার কারণে বেড়েই চলছে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা।

ধর্ষণের সঙ্গে জড়িতদের বিবেকবোধ, মূল্যবোধ ও নৈতিকতা নেই উল্লেখ করে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক, মনোরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মোহিত কামাল বলেন, আমরা তথ্যপ্রযুক্তির উৎকর্ষতায় যেমন সুফল পাচ্ছি, পাশাপাশি পাচ্ছি কিছু কুফলও। এখন অল্প বয়সী ছেলে-মেয়েরা মোবাইলে এক ক্লিকেই যেকোনো অশ্লীল ওয়েবসাইটে প্রবেশ করতে পারে, যা তাদের মস্তিষ্কে ছাপ ফেলছে, ভোগবাদী সত্তাকে জাগিয়ে তুলছে এবং তাদের নৈতিক সত্তাকে অবদমন করছে। এ কারণেই মূল্যবোধ ও নৈতিকতার অবক্ষয় ঘটছে।

নারী নির্যাতন কিংবা ধর্ষণের ঘটনার পেছনে বহুমুখী কারণ রয়েছে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ড. সানজিদা আখতার বলেন, গোটা সমাজ ব্যবস্থা হতাশাগ্রস্ত। সামাজিক মোরালিটিতেও ধস নেমেছে। অর্থনৈতিক বৈষম্য, নৈতিক অবক্ষয় বেড়েছে। নারীর পদচারণা বাড়লেও তাদের অগ্রগতি কিংবা নারীর প্রতি যে দৃষ্টিভঙ্গি হওয়া উচিত সেভাবে আমাদের সমাজ ব্যবস্থাকে গড়ে তোলা যায়নি। নারীকে ঘরে কিংবা বাইরে মানুষ হিসেবে দেখার মতো মানসিকতা আমাদের তৈরি হয়নি। সেই জায়গাটায় পরিবারের জোরালো ভূমিকা পালন করতে হবে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের অধ্যাপক ড. জিয়া রহমান বলেন, আকাশ-সংস্কৃতির কারণে সমাজে যেসব বিষয় আসছে, সেগুলো ধারণের মতো মানসিক সক্ষমতা আমাদের নেই। এ কারণে ধর্ষণই শুধু নয়, অন্যান্য অপরাধও বাড়ছে। আমাদের মনস্তত্ত্বে যে নেতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, কাউন্সেলিংয়ের মাধ্যমে এর উত্তরণ প্রয়োজন। সচেতনতামূলক কার্যক্রম নিতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যৌন বিষয়ক শিক্ষা নিয়েও আমাদের দেশে তেমন কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ এগুলো আধুনিক সমাজের পথচলায় গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। ধীরে ধীরে ধাপের পর ধাপ পেরিয়ে সে অবস্থায় আমাদের পৌঁছাতে হবে।

নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলার তদন্তে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে জানিয়ে পুলিশ সদর দপ্তরের সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি- মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, গত বছর নির্ধারিত সময়ে এ সংক্রান্ত ৮৫ শতাংশ মামলার চার্জশিট দিয়েছি। দু-একটি ঘটনায় বিচ্যুতি থাকতে পারে। তবে সেটা জানা মাত্র কিংবা অভিযোগ পাওয়া মাত্রই ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ।

নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটামাত্র জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’- এ জানানো মাত্র দ্রুততার সঙ্গে ব্যবস্থা নিচ্ছে পুলিশ বলেও জানান তিনি।

 

টাইমস/এইচইউ

Share this news on: