জগদীশ চন্দ্র বসু: বাংলার আইনস্টাইন

বিশ্বে যে কয়জন বাঙ্গালিকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি তাদের একজন স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু। তিনি একাধারে একজন পদার্থবিদ, উদ্ভিদবিজ্ঞানী, জীববিজ্ঞানী ও ভারতের প্রথম সারির একজন সায়েন্স ফিকশন রচয়িতা। লেখাপড়া করেছেন অথচ জগদীশ চন্দ্র বসুর নাম শুনেন নি এমন বাঙালি হয়তো পাওয়া যাবে না।

সেই ছোটবেলা থেকেই আমরা জেনে এসেছি যে, তিনিই প্রথম উদ্ভিদের মধ্যে প্রাণের উপস্থিতি আবিষ্কার করেছিলেন। এছাড়া তিনিই প্রথম বেতার যন্ত্রের ধারণা ও তত্ত্ব দিয়েছিলেন, যা ব্যবহার করে পরে বিজ্ঞানী মার্কোনি রেডিও আবিষ্কার করেছিলেন। তাইতো ইন্সটিটিউট অব ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ার্স তাকে রেডিও বিজ্ঞানের জনক বলে অভিহিত করেছে।

১৮৫৮ সালের ৩০শে নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি অঞ্চলের বিক্রমপুরে (বর্তমান ময়মনসিংহ জেলা) এক শিক্ষিত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জগদীশ চন্দ্র বসু। তার পৈতৃক নিবাস ছিল বিক্রমপুরের রাঢ়িখাল গ্রামে, যা বর্তমান বাংলাদেশের মুন্সিগঞ্জ জেলায় অবস্থিত। তার বাবা ভগবান চন্দ্র ছিলেন ময়মনসিংহ জিলা স্কুলের প্রথম প্রধান শিক্ষক এবং পরবর্তীতে একজন ম্যাজিস্ট্রেট।

একজন ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হিসেবে ভগবান চন্দ্র চাইলে ছেলেকে উন্নত ইংলিশ মাধ্যমের স্কুলে পড়াতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে ছেলেকে স্থানীয় বাংলা স্কুলে ভর্তি করেন। তার উদ্দেশ্য ছিল ছেলে যেন মাতৃভাষাকে আগে শিখতে ও বুঝতে পারে। পাশাপাশি সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশলে ছেলের মধ্যে দেশপ্রেম জাগ্রত হবে। অবশ্য পরে জগদীশের মধ্যে বাংলা স্কুলে পড়ার এই ইতিবাচক প্রভাবের প্রমাণ আমরা পেয়েছি।

প্রথমে কলকাতার হেয়ার স্কুল থেকে এবং পরে ১৮৭৯ সালে সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বিএ পাশ করেন। বাবার আগ্রহে ১৮৮০ সালে তিনি চিকিৎসাবিদ্যা নিয়ে পড়তে লন্ডনে যান। কিন্তু অসুস্থতার কারণে তা শেষ করা হয়নি। পরে প্রকৃতি বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে ক্যামব্রিজের ক্রাইস্ট কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে পাশ করার পর ১৮৮৪ সালে তিনি লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বিএসসি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন।

ভারতে ফিরে এসে ১৮৮৫ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে পদার্থবিদ্যার অধ্যাপক হিসেবে যোগদেন। তবে তার এই নিয়োগের বিরোধিতা করেন কলেজের অধ্যক্ষ হ্যানরি। ফলস্বরূপ তাকে ইউরোপীয় অধ্যাপকদের থেকে অর্ধেক কম বেতন দেয়া হত। এর প্রতিবাদে তিনি প্রায় তিন বছর বিনা বেতনে অধ্যাপনা করেছেন। ফলে জগদীশের পরিবার চরম ঋণগ্রস্ত হয়ে পড়েছিল।

আর্থিক সংকট, গবেষণাগারের অভাব, কলেজ কর্তৃপক্ষের অসহযোগিতাসহ নানা প্রতিকূলতা থাকা সত্ত্বেও শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি গবেষণা চালিয়ে গেছেন। তার গবেষণাকর্মগুলো লন্ডনের রয়েল সোসাইটির জার্নালে প্রকাশিত হয়। তার গবেষণাগুলো এতই সমৃদ্ধ ছিল যে, ১৮৯৬ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয় তাকে ডিএসসি ডিগ্রী প্রদান করে।

পরে ব্রিটিশ অ্যাসোসিয়েশনের আমন্ত্রণে তিনি তার গবেষণাগুলো নিয়ে ইংল্যান্ডে বক্তৃতা দিয়েছিলেন। এরপর থেকে ফ্রান্স, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশ থেকে তিনি বক্তৃতার আমন্ত্রণ পান। তার বক্তৃতা শুনে ও পরীক্ষাগুলো দেখে বিখ্যাত বিজ্ঞানী লর্ড র‌্যালে এতোটাই বিস্মিত হয়েছিলেন যে, তার কাছে সবকিছু অলৌকিক মনে হয়েছিল।

১৮৮৭ সালে তিনি মেডিক্যালের ছাত্রী অবলাকে বিয়ে করেন। তার আর্থিক সংকটের সময় এই মানুষটি ছায়ার মত তার পাশে থেকে সহযোগিতা করেছিলেন।

১৮৯৫ সালে জগদীশ চন্দ্র ৫ মিলিমিটার তরঙ্গ দৈর্ঘ্যবিশিষ্ট অতি ক্ষুদ্র তরঙ্গ (মাইক্রোওয়েভ) তৈরি করেন। এই ক্ষুদ্র তরঙ্গ ব্যবহার করেই আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থায় তথ্য আদান-প্রদান করা হয়।

একই বছর তিনি প্রথম রিমোট কন্ট্রোল সিস্টেমের রিমোট সেন্সিং প্রদর্শন করেন। এর কিছুদিন পরে তিনি কলকাতার টাউন হলে নিজের উদ্ভাবিত মাইক্রোওয়েভ কমিউনিকেশনের সাহায্যে ৭৫ ফুট দূরে রাখা বারুদের স্তূপে আগুন জ্বালাতে সমর্থ হন। এছাড়াও তিনি তার উদ্ভাবিত যন্ত্রের মাধ্যমে নিজের বাসা থেকে এক মাইল দূরে কলেজে সঙ্কেত আদান-প্রদানের ব্যবস্থা করে সবার নজর কেড়েছিলেন।

এরপর তিনি পদার্থ বিজ্ঞানের জ্ঞান কাজে লাগিয়ে উদ্ভিদ বিজ্ঞান নিয়ে গবেষণা শুরু করেন। ১৯০২ সালে তিনি ‘রেসপন্সেস ইন লিভিং অ্যান্ড ননলিভিং’ গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এরপর তিনি আরও কিছু রচনা প্রকাশ করেন, যেখানে তিনি প্রমাণ করেন উদ্ভিদ বা প্রাণীকে কোনোভাবে উত্তেজিত করলে তা থেকে একই রকম প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায়। এভাবেই তিনি উদ্ভিদে প্রাণের অস্তিত্ব আবিষ্কার করেন।

এছাড়া তিনি গ্যালেনা ক্রিস্টাল থেকে সলিড স্টেট ডায়োড ডিটেক্টর তৈরি করেন এবং ১৯০৪ সালে তার ওপর পেটেন্ট নেন। সে হিসেবে জগদীশ চন্দ্রকে সেমিকন্ডাক্টর তৈরির পথিকৃৎ বললে ভুল হবে না।

বিজ্ঞান গবেষণায় জগদীশ চন্দ্র বসুর এই অভূতপূর্ব সাফল্য তাকে বিশ্ববিখ্যাত বিজ্ঞানীদের কাতারে নিয়ে গিয়েছিল। লন্ডনের ডেইলি এক্সপ্রেস পত্রিকা তাকে গ্যালিলিও-নিউটনের সমকক্ষ বলে স্বীকৃতি দিয়েছিল।

তার সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে আইনস্টাইন বলেন- “জগদীশ চন্দ্র যেসব অমূল্য তথ্য বিশ্বকে উপহার দিয়েছেন. তার যে কোনটির জন্য বিজয়স্তম্ভ স্থাপন করা উচিত”।

১৯১৫ সালে তিনি চাকরি থেকে অবসর নেন। ১৯১৭ সালে ইংল্যান্ডের রয়েল ইন্সটিটিউটের আলোকে ভারতে ‘বসু বিজ্ঞান মন্দির’ প্রতিষ্ঠা করেন। তার প্রতিষ্ঠিত এ গবেষণাগারটি ক্রমশ আন্তর্জাতিক মানের গবেষণাগারে পরিণত হয়।

বিজ্ঞানে তার এই অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ১৯১৭ সালে তিনি ‘নাইটহুড’ উপাধি পান। এছাড়া ১৯২০ সালে রয়েল সোসাইটির ফেলো, ১৯২৭ সালে ভারতীয় বিজ্ঞান কংগ্রেস-এর ১৪তম অধিবেশনের সভাপতি, ১৯২৮ সালে ভিয়েনা একাডেমী অব সায়েন্স এর সদস্য, ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব সায়েন্সেস অব ইন্ডিয়া (বর্তমান নাম ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল সায়েন্স একাডেমী) এর প্রতিষ্ঠাতা ফেলো, ফ্রান্সের বিখ্যাত বিজ্ঞান সমিতি ‘Société dePhysique’ এর সদস্যসহ অসংখ্য সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই প্রতিথযশা বিজ্ঞানী।

বাঙ্গালিদের আইনস্টাইন জ্ঞানতাপস এই মহান বিজ্ঞানী স্যার জগদীশ চন্দ্র বসু ১৯৩৭ সালের ২৩ শে নভেম্বর কলকাতায় মারা যান। মূলত তিনিই ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশে ব্যবহারিক ও গবেষণাধর্মী বিজ্ঞানের পথপ্রদর্শক।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on: