অমর্ত্য সেন: দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের বন্ধু

বিশ্বে যে কয়জন বাঙ্গালিকে নিয়ে আমরা গর্ব করতে পারি তাদেরই একজন অমর্ত্য সেন। তিনি উপমহাদেশের একজন বিখ্যাত অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও লেখক। অমর্ত্যের নাম শুনেননি এমন বাঙালি হয়তো পাওয়া যাবে না। কারণ তিনি ছিলেন দরিদ্র ও ক্ষুধার্ত মানুষের বন্ধু, যিনি দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে গবেষণার জন্য নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন।

তিনিই মানব উন্নয়ন সূচকের উদ্ভাবক। তিনিই প্রথম ব্যক্তি, যিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক না হয়েও ন্যাশনাল হিউম্যানিটিস মেডালে ভূষিত হয়েছিলেন। কল্যাণ অর্থনীতি, সামাজিক নির্বাচন তত্ত্ব, অর্থনীতিক উন্নয়ন ও সামাজিক ন্যায়বিচার, দুর্ভিক্ষের অর্থনৈতিক তত্ত্ব এবং উন্নয়নশীল দেশের নাগরিকদের কল্যাণে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন।

অমর্ত্য সেন ১৯৩৩ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকার মানিকগঞ্জে এক সম্ভ্রান্ত হিন্দু পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তার নাম রেখেছিলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তার মাতামহ আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন ছিলেন ভারতীয় সংস্কৃত সাহিত্যের অধ্যাপক, রবীন্দ্রনাথের সহযোগী ও বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় উপাচার্য। তার বাবা আশুতোষ সেন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক।

অমর্ত্য সেন ১৯৪০ সালে ঢাকার সেন্ট জর্জ’স স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৪৫ সালে তার বাবা পরিবারসহ পশ্চিমবঙ্গে চলে যান। ১৯৫১ সালে তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন এবং সেখান থেকে অর্থনীতি বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ ডিগ্রি পাস করেন। প্রেসিডেন্সি কলেজে থাকাকালে তার ক্যান্সার ধরা পড়ে। চিকিৎসকরা বলেছিলেন যে, তিনি আর পাঁচ বছর বাঁচার সম্ভাবনা আছে।

যাইহোক পরবর্তীতে চিকিৎসা শেষে তিনি সুস্থ হয়ে ওঠেন এবং ১৯৫৩ সালে ক্যামব্রিজের বিখ্যাত ট্রিনিটি কলেজে ভর্তি হন। সেখান থেকে তিনি ১৯৫৫ সালে পুনরায় ‘পিওর ইকোনমিক্স’ বিষয়ে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে বিএ ডিগ্রি লাভ করেন। যখন তিনি ক্যামব্রিজে পিএইচডি গবেষণা করছিলেন তখনই তাকে ভারতের যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের নতুন সৃষ্ট অর্থনীতি বিভাগের প্রথম অধ্যাপক এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্ব দেয়া হয়। অমর্ত্য সেনই ছিলেন ভারতের ইতিহাসে সর্বকনিষ্ঠ (২৩ বছর) অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান।

১৯৫৯ সালে তিনি আবার ট্রিনিটি কলেজে ফিরে যান এবং ফেলোশিপ অর্জন করেন, যা তাকে পরবর্তী চার বছর তার ইচ্ছামত যেকোনো কাজ করার সুযোগ এনে দেয়। তিনি দর্শনশাস্ত্রে অধ্যয়ন করার সিদ্ধান্ত নেন। দর্শনশাস্ত্রের জ্ঞান তাকে পরবর্তিকালে তার গবেষণা কাজে অনেক সাহায্য করে।

এসময় তিনি তার অসমাপ্ত পিএইচডি গবেষণার কাজ শুরু করেন। তিনি জন রবিনসনের অধীনে অর্থনীতির বিকল্প কৌশলের উপর তার গবেষণাকাজ সম্পন্ন করেন। ১৯৬০-৬১ সালে ম্যাসাচুসেট্‌স ইন্সটিটিউট অফ টেকনোলজির ভিজিটিং অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৬৪-১৯৬৫ সময়ে তিনি ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাট বার্কলেতে এবং ১৯৭৮-১৯৮৪ সময়ে কর্নেল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভিজিটিং অধ্যাপক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

১৯৭২ সালে তিনি লন্ডন স্কুল অফ ইকোনমিক্স এ অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮৬ সাল পর্যন্ত তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছেন। এছাড়া বিভিন্ন সময়ে দিল্লী স্কুল অব ইকোনমিক্স, জহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয়, কলাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়সহ অসংখ্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কাজ করেছেন অমর্ত্য সেন।

১৯৮৭ সালে তিনি হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগদেন। ১৯৯৮ সালে তিনি ট্রিনিটি কলেজে চলে আসেন এবং ২০০৪ সালে পুনরায় হার্ভার্ডে চলে যান। ২০০৭ সালে তিনি নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় কাজ শুরু করেন এবং ২০১২ সালে তিনি প্রস্তাবিত নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হিসেবে যোগদেন।

পেশাগত জীবনে বিভিন্ন দায়িত্ব পালনের সময় তিনি বেশ কিছু গবেষণাকাজ করেছেন, যা ভারত ও বিশ্ব অর্থনীতির বিকাশ ও উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। অর্থনীতির বিকল্প কৌশল নিয়ে তার গবেষণা ‘সোশ্যাল চয়েস থিওরি’-এর বিকাশে ভূমিকা রেখেছে।

১৯৮১ সালে তিনি “Poverty and Famines: An Essay on Entitlement and Deprivation” শিরোনামে একটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। এখানে তিনি প্রমাণ করেছেন যে, দুর্ভিক্ষ শুধু খাদ্যের অভাব থেকেই হয় না, বরং খাদ্য বণ্টনে বৈষম্য ও অসমতা থেকেও দুর্ভিক্ষের সৃষ্টি হয়।

১৯৪৩ সালের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের তথ্য বিশ্লেষণ করে তিনি প্রমাণ করেন, ওই সময় যথেষ্ট খাদ্য সরবরাহ হয়েছিল। কিন্তু শহরের অর্থনীতি চাঙ্গা হলেও সঠিকভাবে খাদ্য বণ্টন না হওয়ায় গ্রামের দরিদ্র লোকদের খাদ্য কেনার সামর্থ্য ছিল না। ফলে চরম দুর্ভিক্ষ দেখা দেয় এবং লাখ লাখ লোক মারা যায়।

এই গবেষণার পাশাপাশি তার অন্যান্য গবেষণাগুলো উন্নয়ন অর্থনীতির বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। বিশেষ করে জাতিসংঘ কর্তৃক প্রকাশিত মানব উন্নয়ন সূচক ধারণার প্রবর্তনে তার ভূমিকা ছিল সবচেয়ে বেশি।

এছাড়া তিনি ‘ডেভেলাপম্যান্ট এজ ফ্রিডম’, ‘কমোডিটিজ অ্যান্ড ক্যাপাবিলিটিস’, ‘অন ইকোনোমিক ইন-ইকুয়ালিটি’, ‘কালেকটিভ চয়েস অ্যান্ড সোশ্যাল অয়েলফার’, ‘অন ইথিকস অ্যান্ড ইকোনমিক্স’ সহ অসংখ্য বই ও গবেষণা রচনা করেছেন। তার অধিকাংশ রচনা অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের আর্থসামাজিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

দারিদ্র্য ও দুর্ভিক্ষ নিয়ে কাজ করার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৮ সালে তিনি অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পান। এছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে প্রায় ১০২টি সম্মানসূচক পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন এই অর্থনীতিবিদ। এর মধ্যে রয়েছে- ইন্সটিটিউট অব সোশ্যাল স্টাডিজ কর্তৃক ফেলোশিপ (১৯৮২), ভারত রত্ন (১৯৯৯), বাংলাদেশের নাগরিকত্ব (১৯৯৯), গ্রেট ব্রিটেন কর্তৃক অর্ডার অফ কম্প্যানিয়ন অফ অনার, লিনটিফ পুরস্কার, আইজেনহেওয়ার পদক ফর লিডারশীপ ও সার্ভিস ইউএসএ (২০০০), আন্তর্জাতিক মানবিক পুরস্কার (২০০২), ইউএনইএসসিএপি কর্তৃক লাইফ টাইম অ্যাচিভমেন্ট পুরস্কার (২০০৫) ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।

এছাড়াও, ৩০ ডিসেম্বর, ২০১১ সালে অমর্ত্য সেনকে বাংলা ভাষার ধারক ও বাহক হিসেবে বাংলা একাডেমী তাদের বার্ষিক সাধারণ সভায় অমর্ত্য সেনকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে।

এভাবেই সবচেয়ে বেশি পদক ও সম্মাননায় ভূষিত একজন সফল অর্থনীতিবিদ হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। সেই সঙ্গে তিনি বিশ্বদরবারে বাংলা ও বাঙ্গালিকে এক নতুন উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। যেখানে তার পরিচয় কেবল একজন অর্থনীতিবিদই নয়, একাধারে তিনি দরিদ্র, ক্ষুধার্ত, বৈষম্য ও শোষণের শিকার অসহায় মানুষের এক পরম বন্ধু।

ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন এনামুল হক।

 

টাইমস/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
নেপালকে ৪ গোলে উড়িয়ে দিল বাংলাদেশ Sep 18, 2025
img
নির্বাচনী দায়িত্বে অবহেলা ও অপরাধের সাজা বাড়ছে Sep 18, 2025
img

শেষ ওভারে নবির ৫ ছক্কা

শ্রীলংকাকে ১৭০ রানের টার্গেট দিল আফগানিস্তান Sep 18, 2025
img
আওয়ামী লীগের মিছিলে নেতৃত্ব দেয়া তেজগাঁও কলেজের শিক্ষক গ্রেপ্তার Sep 18, 2025
img
সেপ্টেম্বরের ১৭ দিনে রেমিট্যান্স এলো ১৭৭ কোটি মার্কিন ডলার Sep 18, 2025
img
বেনাপোল বন্দর দিয়ে ২ দিনে ভারতে ৫৬ মেট্রিক টন ইলিশ রপ্তানি Sep 18, 2025
img
যারা পিআর নিয়ে কথা বলে তারা নির্বাচনের বিরোধিতা করে : টুকু Sep 18, 2025
img
অনেকেই চান দুর্নীতি থাকুক, কারণ তারা এ থেকে সুবিধা পান: ফাওজুল কবির Sep 18, 2025
img
বিএনপি ক্ষমতায় এলে প্রতিটি ফেডারেশনকে পেশাদারির সঙ্গে এগিয়ে নিয়ে যাবে : ডা. জাহিদ Sep 18, 2025
img
ফ্রান্সে বিক্ষোভ বেড়েই চলছে Sep 18, 2025
img
কয়েকটি রাজনৈতিক দল চায় দেশে যাতে নির্বাচন না হয়: মেজর হাফিজ Sep 18, 2025
img
ভারতীয় ব্যবসায়ীদের ভিসা বাতিল করল যুক্তরাষ্ট্র Sep 18, 2025
img
প্রেমিকের সঙ্গে মা উধাও, ছেলের আয়োজনে বাবার নতুন বিয়ে! Sep 18, 2025
img
উপদেষ্টা পরিষদে আইন পাস : ইসি কর্মকর্তারাই হতে পারবেন সচিব Sep 18, 2025
img
ট্রাম্প ‘বিশ্বের সম্রাট’ নন: ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট Sep 18, 2025
img
পিআর নিয়ে আন্দোলনের নামে ষড়যন্ত্র হচ্ছে : প্রিন্স Sep 18, 2025
img
নিজের স্ত্রীকে ‘নারী প্রমাণে’ বৈজ্ঞানিক প্রমাণ দেবেন ফরাসি প্রেসিডেন্ট ম্যাক্রোঁ Sep 18, 2025
img
নারায়ণগঞ্জে বিচ্ছিন্ন করা হলো ৪ শতাধিক অবৈধ গ্যাস সংযোগ Sep 18, 2025
img
দেওয়ানি ও ফৌজদারি আদালত পৃথক করল সরকার Sep 18, 2025
img
ইসলামী দলগুলোও শেষ পর্যন্ত জামায়াতের সঙ্গে থাকবে না : জাহেদ উর রহমান Sep 18, 2025