ইন্ধিরা গান্ধী: বাংলাদেশের এক পরম বন্ধু

ইন্ধিরা গান্ধী। ভারতের একজন প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ, রাষ্ট্রনেতা ও ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের কেন্দ্রীয় নেতা। তিনি ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহরুর মেয়ে এবং ভারতের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী। তিনিই বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ভারতের প্রথম ও একমাত্র নারী প্রধানমন্ত্রী।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের সময় ইন্ধিরা গান্ধী ছিলেন বাংলাদেশের এক পরম বন্ধু। তিনি ১৯১৭ সালের ১৯ নভেম্বর ভারতের এলাহাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে তিনি ছিলেন এক অদম্য মেধাবী শিক্ষার্থী। ১৯৩৪ সালে মেট্রিকুলেশন পাশ করেন। পরে বিভিন্ন সময় সুইজারল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে গিয়ে লেখা-পড়া করেছেন।

১৯৩৬ সালে তার মা কমলা নেহরু মারা যান। আর বাবা নেহরু প্রায় সময়ই রাজনৈতিক কার্যক্রম নিয়ে ছিলেন ব্যস্ত। কখনো কখনো দীর্ঘসময় ছিলেন কারাগারে। তাই শৈশবে বাবার সান্নিধ্য পেয়েছেন খুব কম। তবে বাবা নেহরু যেখানেই থাকেন না কেন, মেয়ের সঙ্গে চিঠির মাধ্যমে ঠিকই যোগাযোগ রাখতেন। তাই শৈশব থেকেই বাবার রাজনৈতিক আদর্শ দ্বারা তিনি প্রভাবিত হয়েছিলেন। ১৯৪২ সালে ইন্ধিরা গান্ধী তার পারিবারিক বন্ধু ফিরোজ গান্ধীকে বিয়ে করেন।

১৯৪৭ সালে নেহরু ভারতের প্রথম প্রধানমন্ত্রী হলে তার একান্ত সহকারীর দায়িত্ব পান ইন্ধিরা গান্ধী। ১৯৫৯ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। ১৯৬৪ সালে বাবার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি নেহরুর প্রতিনিধি হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক সভায় অংশ নেন। এর ফলেই তার রাজনৈতিক জ্ঞান ও দক্ষতা বিকাশ লাভ করে।

জওহরলাল নেহরুর মৃত্যুর পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী হন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। এসময় ইন্ধিরা গান্ধী ভারতের সংসদের উচ্চ কক্ষ রাজ্যসভার সদস্য নির্বাচিত হন এবং শাস্ত্রীর মন্ত্রীসভার তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী নিযুক্ত হন।

১৯৬৬ সালে লালবাহাদুর শাস্ত্রী মারা যান। তার মৃত্যুর পর প্রতিদ্বন্দ্বী মুরার্জি দেশাইকে পরাজিত করে ইন্ধিরা গান্ধী ভারতের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। প্রধানমন্ত্রী হিসেবে তিনি রাজনৈতিক দৃঢ়তা ও ক্ষমতার অভূতপূর্ব কেন্দ্রীকরণের জন্য বেশ পরিচিতি লাভ করেন।

তবে তার সবচেয়ে বড় সফলতা হল ১৯৭১ সালে পাকিস্তানের সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তিনি বাংলাদেশকে সর্বাত্মক সহযোগিতা দিয়েছিলেন। এর ফলেই তিনি একজন বিশ্বনেতা হিসেবে আবির্ভূত হন।

মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে বাংলাদেশ থেকে প্রায় এক কোটি শরণার্থী ভারতে আশ্রয় নেয়। ১৯৭১ সালের ১৭ মে ইন্ধিরা গান্ধী পশ্চিমবঙ্গ আসেন এবং লাখ লাখ শরণার্থীকে সব ধরনের সাহায্য দেয়ার জন্য রাজ্য সরকারকে নির্দেশ দেন। ‘তারা সবাই ঈশ্বরের সন্তান’ শীর্ষক এক বইয়ে মাদার তেরেসা ইন্ধিরা গান্ধীর এ কাজকে যিশু খ্রিস্টের কাজের সঙ্গে তুলনা করেছেন।

১৯৭১ সালের ১৩ এপ্রিল তিনি বিশ্ব নেতাদের উদ্দেশ্য করে বলেন, ‘পূর্ব বাংলায় যা ঘটছে, তাতে ভারত সরকার নীরব থাকতে পারে না’। মুক্তিযোদ্ধাদের সহযোগিতা ও প্রশিক্ষণের জন্য তিনি ১৯৭১ সালের ৩০ এপ্রিল ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দায়িত্ব দেন। এছাড়া পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নারকীয় হত্যাযজ্ঞ বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে তিনি রাশিয়াসহ বিভিন্ন দেশ সফর করেছেন। তার চেষ্টায় বাংলাদেশ যুদ্ধে বিশ্ব সম্প্রদায়ের সহানুভূতি ও সমর্থন আদায়ে সক্ষম হয়।

স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের জন্য একটি ট্রান্সমিটার বরাদ্দ করেন তিনি। তার নির্দেশেই ১৯৭১ সালের ২১ নভেম্বর ভারতীয় সেনাবাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী মিলে যৌথবাহিনী গঠন করা হয়। মুক্তিযুদ্ধে ভারতের এই সরাসরি অংশগ্রহণের ফলে অল্প কিছু দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে।

১৯৭৫ সালে তার বিরুদ্ধে অবৈধ নির্বাচনী কার্যক্রমের অভিযোগ এনে রায় দেয় এলাহাবাদ হাইকোর্ট। এতে ভারতে রাজনৈতিক সংকট তৈরি হলে তিনি জরুরী অবস্থা জারি করেন। ১৯৭৭ সালে জরুরী অবস্থার অবসান হয় এবং সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। এ নির্বাচনে তিনি পরাজিত হন।

১৯৭৮ সালে দুর্নীতির অভিযোগে তাকে কারাগারে যেতে হয়। তবে ১৯৮০ সালের নির্বাচনে তিনি পুনরায় প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হন। এই সময় থেকে পাঞ্জাবে শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উত্থান ঘটে। ১৯৮৪ সালে শিখদের দমনে অমৃতসারের স্বর্ণ মন্দিরে তিনি অভিযানের নির্দেশ দেন। এ ঘটনায় ব্যাপক হতাহতের ঘটনা ঘটে। ফলে ১৯৮৪ সালের ৩১ অক্টোবর দুই শিখ দেহরক্ষীর গুলিতে মারা যান ইন্ধিরা গান্ধী।

ইন্ধিরা গান্ধীর মৃত্যুর পর ক্ষমতায় আসেন তার ছেলে রাজীব গান্ধী। ১৯৭১ সালে ইন্ধিরা গান্ধী ভারতের সর্বোচ্চ সম্মাননা ‘ভারত রত্ন’ খেতাবে ভূষিত হন। ১৯৯৯ সালে বিবিসির অনলাইন জরিপে তিনি ‘উইমেন অফ দ্য মিলেনিয়াম’ নির্বাচিত হন।

মুক্তিযুদ্ধে অবদানের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১১ সালে ইন্ধিরা গান্ধীকে (মরণোত্তর) স্বাধীনতার সর্বোচ্চ পুরস্কার ‘বাংলাদেশ স্বাধীনতা সম্মাননা’ প্রদান করে বাংলাদেশ সরকার। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে যুগ যুগ ধরে স্মরণ করবে বাংলার মাটি ও মানুষ।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
অপসংস্কৃতি থেকে রক্ষা পেতে মঞ্চ নাটকের পুনর্জাগরণ প্রয়োজন Jul 07, 2025
img
এমন কোনো জায়গা নাই যেখানে বিএনপি চাঁদা তোলে না: ফয়জুল করিম Jul 07, 2025
img
তেলের বাজারে বড় ঘোষণা, আগস্টে বাড়ছে উৎপাদন Jul 07, 2025
img
মাহভাশের সঙ্গে সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুললেন চাহাল Jul 07, 2025
img
আরে কারে ভয় দেখান? আমাদের হারানোর কিছুই নাই: হাসনাত আবদুল্লাহ Jul 07, 2025
img
ব্যাংকক থেকে দেশে ফিরলেন নারী ফুটবলাররা Jul 07, 2025
img
সাই পল্লবীর প্রতিবাদ: নারীর অবজেক্টিফিকেশনকে না Jul 07, 2025
img
বিশ্বকে বদলে দিতে ট্রাম্পের ‘ম্যাডম্যান থিওরি’ Jul 07, 2025
img
টঙ্গীর তিন নেতাসহ চার বিএনপি নেতা বহিষ্কার Jul 07, 2025
img
টঙ্গী থেকে গ্রেফতার নেত্রকোণা জেলা আ. লীগের সহ সভাপতি Jul 07, 2025
img
জনগণের অধিকার রক্ষায় ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান মুশফিকুর রহমানের Jul 07, 2025
img
আন্দোলনে বিকল্প যোগাযোগের গোপন ছক ফাঁস করলেন শিবির সভাপতি Jul 07, 2025
img
৭ জুলাই: ঢাকায় বাংলা ব্লকেডের ১ বছর Jul 07, 2025
img
মাহমুদুর রহমানের মায়ের মৃত্যুতে তারেক রহমানের শোকপ্রকাশ Jul 07, 2025
img
কুয়াকাটায় এক ইলিশ বিক্রি সাত হাজার সাতশ টাকায় Jul 07, 2025
img
বাল্কহেড আটকিয়ে চাঁদাবাজি, গোয়াইনঘাটে ৬ জন গ্রেফতার Jul 07, 2025
img
শেখ হাসিনা কি দিল্লি থেকে লন্ডনে যাচ্ছেন? Jul 07, 2025
img
রাজধানীর দুই স্থানে ককটেল বিস্ফোরণ Jul 07, 2025
img
স্বজন হারালেন জামায়াত আমির, জামায়াতের শোক প্রকাশ Jul 07, 2025
img
জামায়াত আমিরের শাশুড়ি ইন্তেকাল করেছেন Jul 07, 2025