অগ্নিগর্ভ যুক্তরাষ্ট্র, যেভাবে বেঁচে ফিরলেন বাংলাদেশি সাংবাদিক!

যুক্তরাষ্ট্রে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের মতো সোমবার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিউইয়র্কেও কারফিউ জারি করা হয়। ১৯৪৩ সালের পর প্রথমবারের মতো নিউইয়র্কে কারফিউয়ের ঘোষণা আসে। একজন সংবাদকর্মী হিসেবে বিরল এই পরিস্থিতি সরেজমিন কাভার করতে ম্যানহাটানে যাই। রাত তখন ১০টা ৪০ মিনিট। আর ২০ মিনিট পরই শুরু হবে কারফিউ। কিন্তু কোথায় কী! হাজার হাজার বিক্ষোভকারী ম্যানহাটানের অলিগলি দখল করে আছে।

আমার সঙ্গে স্থানীয় আইটিভির সাংবাদিক মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন। আমরা কারফিউ বলতে কী বুঝি? বুঝি যে কারফিউতে কেউ রাস্তায় বের হতে পারবে না। এমন ধারণা নিয়েই টাইম স্কয়ারে রওয়ানা হই আমরা দুজন। ধারণা ছিল, কারফিউয়ের মধ্যে সিটি থাকবে সুনশান। কিন্তু ম্যানহাটানে ঢুকতেই আমাদের ভুল ভাঙে। বিক্ষোভকারীরা কারফিউ মানছে না। তারা বিভিন্ন সড়ক অবরোধ করে আছে। আশপাশের বিভিন্ন দোকানপাটে লুটতরাজ চলছে। কোথাও কোথাও বিচ্ছিন্নভাবে পুলিশের সাথে চলছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া।

আমরা গাড়ি এক পাশে রেখে ছবি তুলছিলাম। লাইভের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছিলাম। আগেভাগে কিছু দৃশ্য রেকর্ড করেও রাখছিলাম। এমন সময় আমাকে পিছন ও সামনে থেকে হামলা করে কয়েকজন। তারা আমাকে কিল-ঘুষি মারতে থাকে। এক পর্যায়ে আমি রাস্তায় পড়ে যাই। তারা তারপরও আমাকে মারতে থাকে। আমি দৌড়ে রাস্তার অন্যপাশে চলে গিয়ে আমার হাতে থাকা টিভি চ্যানেলের মাইক্রোফোনটি লুকিয়ে ফেলি। এমন সময় তারা আমার বন্ধু-সহকর্মী শহীদুল্লাহর কাছ থেকে ক্যামেরা হিসেবে ব্যবহার করা আইফোনটি ছিনিয়ে নেয়ার চেষ্টা করে। শহীদুল্লাহ তা দিতে না চাইলে ওরা তার ওপরও হামলা করে। আমরা দুজনই দৌড়ে প্রাণ বাঁচানোর চেষ্টা করি। এসময় ওরা আমাদের গাড়ি ভাংচুরেরও চেষ্টা চালায়। আমি দূর থেকে কাঁচ ভাঙার শব্দও শুনতে পাই। আমি ভয় পেয়ে যাই আমাদের গাড়িটা না ভেঙে ফেলে!! কিন্তু পরে গাড়ির কাছে গিয়ে দেখি বোতল ভেঙে গেছে কিন্তু গাড়ির কাঁচ ভাঙেনি।

বিক্ষোভকারীরা সে জায়গা ছেড়ে চলে গেলে আমরা গাড়ি নিয়ে দ্রুত স্থান ত্যাগের চেষ্টা করি। কিন্তু কোনোভাবেই যেন আমরা এগুতে পারছিলাম না। রাস্তা অবরোধ করে আছে বিক্ষোভকারীরা। রাস্তার দু'পাশে দোকানপাটে সমানতালে লুটপাট চালিয়ে যাচ্ছে তারা। আমাদের গাড়ি মেসি'জ (বিশ্বের সবচেয়ে বড় স্টোর) এর সামনে এলে সেখানে কিছু পুলিশ দেখতে পাই। লুটেরারা মেসি'জ-এর ভেতরে ঢোকার চেষ্টা করছিল। পুলিশ মেসি'জ রক্ষা করতে প্রাণপন চেষ্টা করছে। কিন্তু লুটেরাদের তুলনায় পুলিশ ছিল নগন্য। কৃষ্ণাঙ্গরা এতটাই বেপোরোয়া ছিল যে পুলিশ যেন তাদের কাছে অসহায় হয়ে পড়েছিল।

বিক্ষোভ কম দেখিনি। আপনাদের অনেকের হয়তো মনে আছে, ২০০৭ সালে ৩০ মার্চ বাংলাদেশের রাজধানী ঢাকার পুরানা পল্টনে রাজনৈতিক সহিংসতা ছিল নজিরবিহীন। বেশ কয়েকজনকে পিটিয়ে মারা হয়েছিল সেদিন। দেশের প্রথম ২৪ ঘণ্টার সংবাদভিত্তিক চ্যানেল সিএসবি নিউজের ইনপুট হেড ছিলেন তুষার আবদুল্লাহ। তিনি আমাকে ও ক্যামেরাম্যান মঞ্জুরুল হক মঞ্জুরকে ফিল্ডে পাঠিয়েছিলেন। আমরা ভয়াবহ সেই সহিংসতা কাভার করেছি। মঞ্জুর ভাই ছবি তুলেছেন, আর আমি যথাসাধ্য তাকে আগলে রেখে নিক্ষিপ্ত ইট-পাথর থেকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছি। মাঝখানে কেটে গেছে কতগুলো বছর। এখন মঞ্জুর ভাইও সময়-এ, আমিও। তবে দুজন দুদেশে।

২০০৬ সালে বৈশাখী টিভিতে থাকার সময় বিএনপি ও চারদলীয় জোটের আমলে পুলিশের হাতে মার খেয়ে রাস্তায় লুটিয়েছি। আমার দোষ ছিল সহকর্মী ক্যামেরাপরসন দীপু ভাইকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছিলাম আমি। তারা দীপু ভাইকে রেখে আমাকে পেটাতে শুরু করে। গুরুতর আহত হয়ে হাসপাতালে ছিলাম তিনদিন। তৎকালীন সরকারের পেটোয়া বাহিনীর হাতে মার খাওয়া আহত সাংবাদিককে সমবেদনা জানাতে হাসপাতালে এসেছিলেন তিনজন মন্ত্রী!! তখনকার মার্কিন রাষ্ট্রদূত খোঁজ-খবর নিয়েছিলেন।

বিডিয়ার বিদ্রোহের কথা তো আমরা সবাই জানি। দেশের ইতিহাসের আরেক নজিরবিহীন ঘটনা। এটিএন বাংলায় থাকার সময় ঘটনার দিন থেকে টানা আড়াই মাস পিলখানা যেন ছিল আমার ঘর-বাড়ি। মনে পড়ে, উনিশ দিনের নবজাতক কন্যাকে রেখে ঘটনাস্থলে রাশ করেছিলাম। পিলখানার চার নম্বর গেইটে গিয়ে যখন পৌছাই তখন সেখানে আরও অসংখ্য উৎসুক জনতা। পিলখানার ভেতর থেকে গুলি করা হয়েছিল। আরও অনেকের সাথে আমিও প্রাণ বাঁচাতে দিগবিদিক ছুটেছি। লেকের পাড়ে পায়ে চলা পথে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিলেন অভিনয়শিল্পী সাবিনা বারী লাকী। আজ তিনি ও আমি, আমরা দুজনই উত্তর আমেরিকায় থাকি। তিনি কানাডায়, আমি আমেরিকায়। কিন্তু সেই দিনগুলো এখনও চোখে ভাসে। পরে জেনেছিলাম, চুয়াত্তর জন আর্মি অফিসার, সৈনিক ও সীমান্তরক্ষীর সাথে সেদিন একজন রিকসা চালকও গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হন লেকের পাড়ে। আমরা কী সেদিন প্রাণে বেঁচে গিয়েছিলাম?

পুলিশের হাতে জর্জ ফ্লয়েড নামে এক কৃষ্ণাঙ্গ ব্যক্তির মৃত্যুকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে সপ্তাহব্যাপী বর্ণবাদ বিরোধী বিক্ষোভ চলছে। এটাকে এখন আর বিক্ষোভ বলা যাবে না। প্রতিবাদ-বিক্ষোভ রূপ নিয়েছে দাঙ্গা-সহিংসতায়। সর্বত্র চলছে লুটপাট।

বাংলাদেশে যেকোনো বিক্ষোভে গণমাধ্যম কর্মীদের ওপর হামলা, প্রেসের গাড়ি ভাঙচুর স্বাভাবিক ঘটনা। কিন্তু আমেরিকাতেও যে বিক্ষোভকারীদের রোষানলে পড়বে মিডিয়া, তা কী কেউ কোনোদিন ভেবেছে? যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে এই দাঙ্গায় ২শ'রও বেশি সাংবাদিক পুলিশ ও বিক্ষোভকারীদের হামলার শিকার হয়েছে। পুরো পৃথিবীটাকে এখন গ্লোবাল ভিলেজ ডাকা হয়। এই গ্লোবাল ভিলেজের পলিটিক্স সর্বত্রই এক। আর ভিলেজের বাসিন্দাদের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও অভিন্ন।

আমরা হামলার শিকার হওয়ার পর সময় সংবাদ, একাত্তর টিভিসহ বিভিন্ন টিভি চ্যানেল ও নিউজ পেপারে সংবাদ প্রচারিত হওয়ায় খবরটি দ্রুত বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। অসংখ্য জন আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমাকে না পেয়ে আমার স্ত্রীকে ফোন করেছেন। ইনবক্স করেছেন। ওয়াশিংটনে বাংলাদেশ দূতাবাস ও নিউইয়র্ক কনস্যুলেটের শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তা, কমিউনিটি নেতৃবৃন্দ ও সাংবাদিক সহকর্মীরা অনেকে ফোন করে আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। তারা ঘটনায় দু:খপ্রকাশ করেছেন, অনেকেই হামলার নিন্দা জানিয়েছেন। তারা আমাদের পাশে থেকে শক্তি-সাহস যুগিয়েছেন। আমি সবার কাছে কৃতজ্ঞ।

লেখক : হাসানুজ্জামান সাকী, নিউইয়র্ক

টাইমস/জেকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চলমান তাপপ্রবাহ রেকর্ড ভেঙেছে ৭৬ বছরের Apr 26, 2024
img
অলসতা কাটিয়ে সকালে ঘুম থেকে উঠতে করণীয় Apr 26, 2024
img
বাংলাদেশে চিকিৎসা সুবিধায় থাইল্যান্ডের বিনিয়োগ চান প্রধানমন্ত্রী Apr 26, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় মৌসুমের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪২ দশমিক ৭ ডিগ্রি Apr 26, 2024
img
সেন্সর বোর্ডে আটকে গেল রায়হান রাফীর নতুন সিনেমা ‘অমীমাংসিত’ Apr 26, 2024
img
বাংলাদেশের উন্নয়নে পাকিস্তান প্রশংসা করে অথচ বিরোধী দল দেখে না: কাদের Apr 26, 2024
img
চলতি বছরই থাইল্যান্ডের সঙ্গে বাণিজ্য চুক্তি হতে পারে : প্রধানমন্ত্রী Apr 26, 2024
img
দিনাজপুরে দুই ট্রাকের সংঘর্ষে নিহত ২ Apr 26, 2024
img
পাটগ্রাম সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি নিহত Apr 26, 2024
img
নতুন করে বেড়েছে সবজি-মাংসের দাম Apr 26, 2024