প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজে যা আছে

করোনাভাইরাসের প্রভাবে আর্থিক ক্ষতি মোকাবিলায় ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকার আর্থিক প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। নতুন একটি প্যাকেজসহ মোট পাঁচটি প্যাকেজে এই প্রণোদনা দেয়ার কর্মপরিকল্পনা তুলে ধরেন তিনি।

রোববার প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবনে (গণভবন) আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এসব প্যাকেজ ঘোষণা করেন। প্রধানমন্ত্রীর এ সংবাদ সম্মেলনে অর্থমন্ত্রী, অর্থসচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর বক্তব্য দেন।

বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সম্ভাব্য বিরূপ প্রভাব উত্তরণে আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ ও সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধিসহ ৫টি কার্যক্রম নিয়ে এ কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা করেন প্রধানমন্ত্রী।

তাৎক্ষণিক, স্বল্প এবং দীর্ঘ-মেয়াদী পর্যায়ে এসব কর্মপরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা হবে বলে সংবাদ সম্মেলনে জানান তিনি। কর্মপরিকল্পনাগুলো হলো:

সরকারি ব্যয় বৃদ্ধি করা: প্রধানমন্ত্রী বলেন, সরকারি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ‘কর্মসৃজনকে’ মূলত প্রাধান্য দেয়া হবে। বিদেশ ভ্রমণ ও বিলাসী ব্যয় নিরুৎসাহিত করা হবে। আমাদের ঋণের স্থিতি-জিডিপির অনুপাত অত্যন্ত কম (৩৪ শতাংশ)। কাজেই অধিকতর সরকারি ব্যয় সামষ্টিক অর্থনীতির ওপর কোনও চাপ সৃষ্টি করবে না।

আর্থিক সহায়তার প্যাকেজ: ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে কতিপয় ঋণ সুবিধা প্রবর্তন করা হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড পুনরুজ্জীবিত করা, শ্রমিক-কর্মচারীদের কাজে বহাল রাখা এবং উদ্যোক্তাদের প্রতিযোগিতার সক্ষমতা অক্ষুণ্ন রাখাই হলো আর্থিক সহায়তা প্যাকেজের মূল উদ্দেশ্য।

সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি: দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাসকারী জনগণ, দিনমজুর এবং অপ্রাতিষ্ঠানিক কাজে নিয়োজিত জনসাধারণের মৌলিক চাহিদা পূরণে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কার্যক্রমের আওতা বৃদ্ধি করা হবে। যেমন- বিনামূল্যে খাদ্যসামগ্রী বিতরণ, ১০ টাকা কেজি দরে চাল বিক্রয়, লক্ষ্যভিত্তিক জনগোষ্ঠীর মাঝে নগদ অর্থ বিতরণ, বয়স্ক ভাতা এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা নারীদের জন্য ভাতা কর্মসূচির আওতা সর্বাধিক দারিদ্র্যপ্রবণ ১০০টি উপজেলায় শতভাগে উন্নীত করা এবং জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে গৃহীত অন্যতম কার্যক্রম গৃহহীন মানুষদের জন্য গৃহনির্মাণ কর্মসূচি দ্রুত বাস্তবায়ন করা।

মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা: অর্থনীতির বিরূপ প্রভাব উত্তরণে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধি করা অত্যন্ত জরুরি। বাংলাদেশ ব্যাংক ইতোমধ্যে সিআরআর এবং রেপোর হার কমিয়ে মুদ্রা সরবরাহ বৃদ্ধির ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। যা আগামীতেও প্রয়োজন অনুযায়ী অব্যাহত থাকবে। তবে এক্ষেত্রে সরকারের লক্ষ্য থাকবে যেন মুদ্রা সরবরাহজনিত কারণে মুদ্রাস্ফীতি না ঘটে।

প্রধানমন্ত্রী ঘোষিত আর্থিক সহায়তা প্যাকেজগুলো হলো

প্যাকেজ-১

ক্ষতিগ্রস্থ শিল্প ও সার্ভিস সেক্টরের প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা দেয়া। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল দেয়ার লক্ষ্যে ৩০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর সংশ্লিষ্ট শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেয়া। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৯ শতাংশ। ঋণের সুদের অর্ধেক অর্থাৎ ৪.৫০ শতাংশ ঋণ গ্রহীতা শিল্প/ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৪.৫০ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-২

ক্ষুদ্র (কুটির শিল্পসহ) ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল সুবিধা প্রদান। ব্যাংক ব্যবস্থার মাধ্যমে স্বল্প সুদে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল প্রদানের লক্ষ্যে ২০ হাজার কোটি টাকার একটি ঋণ সুবিধা প্রণয়ন করা হবে। ব্যাংক-ক্লায়েন্ট রিলেশনসের ভিত্তিতে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো সংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্রও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানকে তাদের নিজস্ব তহবিল হতে ওয়ার্কিং ক্যাপিটাল বাবদ ঋণ দেবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হারও হবে ৯ শতাংশ। ঋণের ৪ শতাংশ সুদ ঋণ গ্রহীতা শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিশোধ করবে এবং অবশিষ্ট ৫ শতাংশ সরকার ভর্তুকি হিসেবে সংশ্লিষ্ট ব্যাংককে দেবে।

প্যাকেজ-৩

বাংলাদেশ ব্যাংক প্রবর্তিত এক্সপোর্ট ডেভেলপমেন্ট ফান্ডের (ইডিএফ) সুবিধা বাড়ানো। ব্লক টু ব্লক এলসির আওতায় কাঁচামাল আমদানি সুবিধা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ইডিএফের বর্তমান আকার ৩.৫ বিলিয়ন ডলার হতে ৫ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হবে। ফলে ১.৫ বিলিয়ন ডলারের সমপরিমাণ অতিরিক্ত ১২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা ইডিএফ তহবিলে যুক্ত হবে। ইডিএফের বর্তমান সুদের হার এলআইবিওআর + ১.৫ শতাংশ (যা প্রকৃত পক্ষে ২.৭৩ শতাংশ) হতে কমিয়ে ২ শতাংশ নির্ধারণ করা হবে।

প্যাকেজ-৪

প্রি-শিপমেন্ট ক্রেডিট রিফাইন্যান্স স্কিম নামে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫ হাজার কোটি টাকার একটি নতুন ঋণ সুবিধা চালু করবে। এ ঋণ সুবিধার সুদের হার হবে ৭ শতাংশ।

প্যাকেজ-৫

ইতোপূর্বে রফতানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর শ্রমিক-কর্মচারীদের বেতন/ভাতা পরিশোধ করতে ৫ হাজার কোটি টাকার একটি আপৎকালীন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী। নতুন ৪টিসহ মোট ৫টি প্যাকেজে আর্থিক সহায়তার পরিমাণ হবে ৭২ হাজার ৭৫০ কোটি টাকা যা জিডিপির প্রায় ২.৫২ শতাংশ।

এদিকে সংবাদ সম্মেলনে করোনায় দেশের অর্থনীতিতে নেতিবাচক প্রভাব নিয়ে সর্তক করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, বিশ্বব্যাপী করোনাভাইরাস সংক্রমণে বাংলাদেশের অর্থনীতির ওপর কী ধরনের বা কতটুকু নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা এখনও নির্দিষ্ট করে বলার সময় আসেনি। তারপরও কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্ভাব্য অর্থনৈতিক প্রভাব তুলে ধরেন তিনি। তা হল:

ক) আমদানি ব্যয় ও রফতানি আয়ের পরিমাণ গত অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ৫ শতাংশ হ্রাস পেয়েছে। অর্থবছর শেষে এই হ্রাসের পরিমাণ আরও বাড়তে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।

খ) চলমান মেগা প্রকল্পসমূহ বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠা এবং ব্যাংক সুদের হার হ্রাসের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন বিলম্বের কারণে বেসরকারি বিনিয়োগ প্রত্যাশিত মাত্রায় অর্জিত না হওয়ার সম্ভাবনা আছে।

গ) সার্ভিস সেক্টর বিশেষত, হোটেল-রেস্টুরেন্ট, পরিবহন এবং এভিয়েশন সেক্টরের ওপর বিরূপ প্রভাব পড়বে।

ঘ) বিশ্বের অন্যান্য দেশের মত বাংলাদেশের শেয়ার বাজারেও বিরূপ প্রভাব পড়েছে।

ঙ) বিশ্বব্যাপী জ্বালানি তেলের চাহিদা হ্রাসের কারণে এর মূল্য ৫০ শতাংশের অধিক হ্রাস পেয়েছে, যার বিরূপ প্রভাব পড়বে প্রবাসী-আয়ের ওপর।

চ) বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ৩.০২ বিলিয়ন ডলার হবে মর্মে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক প্রাক্কলন করেছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে মনে হচ্ছে এ ক্ষতির পরিমাণ আরও বেশি হতে পারে।

ছ) দীর্ঘ ছুটি বা কার্যত লকডাউনের ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প প্রতিষ্ঠানসমূহের উৎপাদন বন্ধ এবং পরিবহন সেবা ব্যাহত হওয়ায় স্বল্পআয়ের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস এবং সরবরাহ চেইনে সমস্যা হতে পারে।

জ) চলতি অর্থবছরের রাজস্ব সংগ্রহের পরিমাণ বাজেটের লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় কম হবে। এর ফলে অর্থবছর শেষে বাজেট ঘাটতির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পেতে পারে।

ঝ) বিগত ৩ বছর ধরে ধারাবাহিক ৭ শতাংশের অধিক হারে প্রবৃদ্ধি অর্জন এবং ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৮.১৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জনের প্রধান চালিকাশক্তি ছিল শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ চাহিদা এবং সহায়ক রাজস্ব ও মুদ্রানীতি। সামষ্টিক চলকসমূহের নেতিবাচক প্রভাবের ফলে জিডিপি’র প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।

 

টাইমস/এসএন/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিএনপি খালেদা জিয়ার দল, তারেক রহমানের দল: রুমিন ফারহানা Jul 19, 2025
img
তদবির নয়, এবার বিচারপতি নিয়োগে কাঠামোগত পরিবর্তন Jul 19, 2025
img
সুইজারল্যান্ডকে হারিয়ে উইমেন্স ইউরোর সেমিফাইনালে স্পেন Jul 19, 2025
img
ড্রোন ও এআই অস্ত্র নির্মাণে যৌথভাবে কাজ করবে যুক্তরাজ্য-জার্মানি Jul 19, 2025
img
স্ত্রীকে তালাক দিয়ে ২৫ কেজি দুধে স্নান করলেন হৃদয় মিয়া Jul 19, 2025
img
হাই অল্টিটিউড ম্যাচে কতটা প্রস্তুত জামালরা? Jul 19, 2025
img
সমর্থক গ্রেফতারে শীর্ষে ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড Jul 19, 2025
img
সরকারই উসকানি দিয়ে এনসিপিকে গোপালগঞ্জ পাঠিয়েছে : এলডিপি মহাসচিব Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশ সরকারের কাজের প্রশংসা করলেন স্পেসএক্সের ভাইস প্রেসিডেন্ট Jul 19, 2025
img
কিছু বিকৃত মস্তিষ্কের লোক ছাত্রদের দল গঠনের বুদ্ধি দিয়েছে : অলি আহমদ Jul 19, 2025
img
পিআর পদ্ধতিতে উচ্চকক্ষ চায় না বিএনপি Jul 19, 2025
হলফনামায় শেখ হাসিনার মি'থ্যা তথ্য, ব্যবস্থা নেয়ার সুযোগ নেই ইসির Jul 19, 2025
img
মুজিববাদের কবর দিতে গোপালগঞ্জ যাওয়ার দরকার নেই : এ্যানি Jul 19, 2025
বাংলাদেশে স্টারলিংক কার্যক্রমে সরকারকে ‘নজিরবিহীন’ বললো স্পেসএক্স Jul 19, 2025
‘হিরোস উইদাউট কেপস’ ডকুমেন্টারি: জুলাই আন্দোলনের প্রামাণ্য চিত্র Jul 19, 2025
img
জামালপুরে যুব মহিলা লীগ নেত্রী গ্রেফতার Jul 19, 2025
img
বাংলাদেশে স্টারলিংক আনুষ্ঠানিকভাবে চালু, রিসেলার বিএসসিএল Jul 19, 2025
img
দলীয় উন্নয়নেই মনোযোগ, আজও দ্বিতীয় সারির দল পাঠাবেন বাটলার Jul 19, 2025
img
পাকিস্তানের ইরানি দূত এখন এফবিআইয়ের মোস্ট ওয়ান্টেড Jul 19, 2025
img
এসি মিলানে মডরিচ, ফিরে গেলেন ছোটবেলার প্রেমে Jul 19, 2025