বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ: প্রচার না প্রতারণা?  (পর্ব-১)

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লি.’ নামে একটি পেজ খুলে ডিলারশিপ নিয়োগের প্রচার চালানো হচ্ছে। একইসঙ্গে রাজধানীর মহাখালীর ডিওএইচএস আবাসিক এলাকায় একটি ফ্ল্যাট বাসায় নেওয়া হয়েছে অফিসও।

এমডি, সিইওসহ কয়েকজন কর্মচারী নিয়ে ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে নতুন এই ই-কমার্স কোম্পানি।

তবে বাজারে তাদের কোনো পণ্যের অস্তিত্ব না থাকায় ফেসবুকে প্রচারের ধরণ দেখে সন্দেহ হয়।

পরে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলাদেশ টাইমস অনুসন্ধানে নামে।

ফেসবুক পেজে দেয়া ডিলারশিপের নিয়োগের বিজ্ঞপ্তি দেখে এ প্রতিবেদক পরিচয় গোপন রেখে ওই কোম্পানিতে ফোন করেন।

কোম্পানিটির এক কর্মকর্তার সঙ্গে আলাপের এক পর্যায়ে তাকে বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের অফিসে আসতে বলা হয়। এও বলা হয়, ‘ডিলারশিপের জন্য পাঁচ লাখ টাকা লাগবে।’

পরে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের অফিসে যান। 

অনুসন্ধানে জানা গেছে, রবিন নামের এক ব্যক্তি (যিনি নিজেকে এই কোম্পানির এমডি দাবি করেন) ফেসবুকে একটি পেজ খুলে বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন।

প্রতিষ্ঠানটির কার্যক্রম চালানোর জন্য মহাখালী ডিওএইচএস আবাসিক এলাকায় ১৯ নম্বর রোডের ২৬২ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায় নেওয়া হয়েছে একটি ফ্ল্যাট। তবে ফ্ল্যাটের ভেতরে ও বাইরে প্রতিষ্ঠানের নাম সম্বলিত কোনো সাইনবোর্ড নেই!

সেখানে গিয়ে কথা হয় বাড়ির কেয়ারটেকারের সঙ্গে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কেয়ারটেকার জানান, মার্চ মাসেই তাদের কাছে ফ্ল্যাটটি ভাড়া দেওয়া হয়েছে। তবে তাদের কার্যক্রম সম্পর্কে কিছুই জানাতে পারেননি তিনি।

এক পর্যায়ে ভবনটির দ্বিতীয় তলায় বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের  অফিসে যান এ প্রতিবেদক। এসময় তিনি সাংবাদিক পরিচয় দিলে তাকে বিভিন্ন উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করা হয়। এমডির সঙ্গে কথা বলতে চাইলে তাকে বসিয়ে রাখা হয়।

এসময় রিসিপশনে বসে থাকা দুই নারীর সঙ্গে কথা হয়  এ প্রতিবেদকের। তাদের একজন ফারহানা; যিনি নিজেকে ওই কোম্পানির হিসাবরক্ষক হিসেবে পরিচয় দেন।

ফারহানা জানান, ১০ মার্চ ওই কোম্পানিতে তিনি যোগদান করেছেন। তার পাশে বসে থাকা অপর একজন মেয়েকে দেখিয়ে তিনি বলেন, ‘সেও আজ যোগদান করেছেন।’

কোম্পানিতে কতজন লোক চাকরি করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘এটা আমাদের হেড অফিস। এই অফিসে ছয়-সাত জনের মত লোক রয়েছে। তবে নিয়োগ প্রক্রিয়া এখনো চলছে।’

এরপর ফারহানা একটি প্রোডাক্ট ক্যাটালগ বের করে দেন এবং রুপসী ও নারায়ণগঞ্জে তাদের ফ্যাক্টরিও রয়েছে বলে জানান।

চার পৃষ্ঠার ওই ক্যাটালগের ওপরে বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ লিমিটেডের নাম লেখা রয়েছে। পেছনের পাতায় অফিসের ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ফ্যাক্টরির ছবি ও তাদের কোম্পানির গাড়ির ছবি আছে।

আর ভেতরের পৃষ্ঠাগুলোতে সয়াবিন তেল, পানি, চা, চাল, নুডুলস, সেমাইসহ বিভিন্ন পণ্যের ছবি রয়েছে। তবে সেখানে কোনো মূল্য দেওয়া নেই।

এছাড়া ক্যাটালগে যে ফ্যাক্টরি ও গাড়ির ছবি ব্যবহার করা হয়েছে তাতে অনেক অসঙ্গতি। পুরোটাই ফটোশপের কারসাজি। গাড়ির পাশে যে দুজন লোক দাঁড়িয়ে আছেন তারাও বিদেশি!

এভাবে ৪০ মিনিট অপেক্ষার পর অবশেষে কোম্পানির এমডির সঙ্গে দেখা করার সুযোগ পান এ প্রতিবেদক।

শুরুতেই তাকে কেন, কী কারণে এসেছেন-এসব অমূলক অনেক প্রশ্ন করেন এমডি পরিচয়ধারী রবিন।

এক পর্যায়ে কোম্পানি সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি কোনো তথ্য দিতে রাজি হননি। উনার পরিচয় জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমার পরিচয় দিয়ে কি করবেন?’ কোন পদে আছেন জানতে চাইলে ‘এমডি পরিচয়’ গোপন করে রবিন বলেন, ‘আমি এই কোম্পানির সেলস এক্সিকিউটিভ হিসেবে কর্মরত আছি।’

এ সময় সিইওর সঙ্গে কথা বলতে চাইলে রবিন বলেন, ‘উনার সঙ্গে কথা বলা যাবে না। আপনি আসতে পারেন। আমাদের প্রয়োজন হলে আপনাকে খবর দেওয়া হবে।’

এরপর এ প্রতিবেদককে বলপূর্বক অফিস থেকে বের করে দেন রবিন। নিচে নামার পর বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) পরিচয়ধারী সাব্বির আহমেদ সাইমন আসেন। এসময় ভবনটির ছবি তুলতে দেখে তিনিও এ প্রতিবেদকের পরিচয় চানতে চান। পরিচয় দেওয়ার পর আবার তাকে নিয়ে অফিসে নিয়ে যাওয়া হয়।

এবার সিইও এর রুমে গিয়ে একটি চকলেট ও লিচুর বয়াম ও কয়েকটি আটার প্যাকেট পাওয়া যায়। তবে অফিসটিতে আর কোনো পণ্য চোখে পড়েনি।

পণ্য সম্পর্কে জানতে চাইলে সিইও সাব্বির আহমেদ সাইমন বলেন, ‘আমরা এই মাসে (মার্চ) ব্যবসা শুরু করেছি। এখনো সব কার্যক্রম শুরু করিনি।

তবে তাদের সম্পর্কে কোনো ধরনের নিউজ না করতে অনুরোধ করেন তিনি।

এসময় তার রুমে কোম্পানির এমডি রবিনও ছিলেন।

সেলস এক্সিকিউটিভ পরিচয়দানকারী রবিন কেন নিজের পরিচয় লুকিয়েছিলেন জানতে চাইলে সিইও বলেন, ‘ভয়ে’।   

প্রসঙ্গত, ‘বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ ফেসবুক পেজে গিয়ে দেখা গেছে, সম্প্রতি তারা ডিপো ও ডিলার নিয়োগ চলছে বলে একটি পোস্ট দিয়েছে। যোগাযোগ করার জন্য ঠিকানা এবং একটি ফোন নম্বরও দেওয়া হয়েছে।

এছাড়া কোম্পানির জন্য হিসাবরক্ষক চেয়ে সম্প্রতি তারা বিডিজবসেও একটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেন।

এর আগে ‘সিটি ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ ও ‘হামদান ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ নামেও কোম্পানিটির ফেসবুক পেজ ছিল। ওই পেজ দুটি বন্ধ করে ‘বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ’ নামে নতুন ফেসবুক পেজ খোলা হয়।    

এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিআইডির অতিরিক্ত পুলিশ সুপার শারমিন জাহান  বাংলাদেশ টাইমস’কে বলেন,  অনলাইন মার্কেটিংয়ের আড়ালে অর্থ পাচারের অভিযোগ রয়েছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি অনলাইন মার্কেটিং কোম্পানির বিরুদ্ধে প্রাথমিকভাবে সত্যতাও পেয়েছে সিআইডি। তবে তদন্ত কার্যক্রম এখনো অব্যাহত রয়েছে। এ বিষয়টিও খতিয়ে দেখা হবে।

 

ধারাবাহিক প্রতিবেদনের দ্বিতীয় পর্ব পড়তে নিচের লিঙ্কে ক্লিক করুন...  

বিকাশ ফুড অ্যান্ড বেভারেজ: তিন বার ফেসবুক পেজের নাম পরিবর্তন (পর্ব-২)

 

টাইমস/কেআরএস/জেডএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সারাদেশে ৩ দিনের হিট অ্যালার্ট জারি Apr 19, 2024
img
বিশ্বের ১০০ প্রভাবশালীদের তালিকায় আলিয়া Apr 19, 2024
img
পালিয়ে আসা ২৮৫ জনকে ফেরত নিচ্ছে মিয়ানমার: পররাষ্ট্রমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
গ্রেপ্তারি পরোয়ানার শঙ্কায় নেতানিয়াহু, ইসরায়েলে জরুরি বৈঠক Apr 19, 2024
img
পালিয়ে বাংলাদেশে এলেন আরও ১১ বিজিপি সদস্য Apr 19, 2024
img
কৃষক লীগ নেতাদের গণভবনের শাক-সবজি উপহার দিলেন শেখ হাসিনা Apr 19, 2024
img
প্রধানমন্ত্রী ভবিষ্যৎ বাংলাদেশ গড়ার কাজ শুরু করেছেন : অর্থমন্ত্রী Apr 19, 2024
img
থার্ড টার্মিনালের বাউন্ডারি ভেঙে ঢুকে গেল বাস, প্রাণ গেল প্রকৌশলীর Apr 19, 2024
img
চুয়াডাঙ্গায় তাপমাত্রা ৪১ দশমিক ৩ ডিগ্রি, হিট এলার্ট জারি Apr 19, 2024
img
৩টি ড্রোন ধ্বংস করল ইরান, ইসফাহানের পারমাণবিক স্থাপনা নিরাপদ Apr 19, 2024