বাবরি মসজিদ: ভারতীয় আদালতের সাম্প্রদায়িক রায়

এই বাবরি মসজিদ নিয়ে ঝামেলা বা ক্যাচাল, যেটাই বলেন, সেটা বেশ পুরনো। কিন্তু ভারতের সর্বোচ্চ আদালতে মসজিদের সাথে মন্দির নির্মাণ নিয়ে যে রায়’টা দিলো তা মোদীর সাম্প্রদায়িক মনোভাবেরই আইনি প্রকাশ হয়েছে। বলে রাখা ভালো, রাম মন্দির নির্মাণ বিজেপির নির্বাচনী অঙ্গীকারেও ছিলো। আদালতের রায়ে কিংবা

আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার প্রতিবেদনের কোথাও বলা হয়নি, মসজিদের স্থানে রাম মন্দিরের অস্তিত্ব ছিল। আদালত তার রায়ে স্ববিরোধিতাও করেছে। যেমন রায়ে বলেছে 'যেহেতু বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা ঠিক করা সম্ভব নয়, তাই আইনের ভিত্তিতেই জমির মালিকানা ঠিক করা উচিত।' কিন্তু সেই মন্দির থাকার অলীক কল্পনার ভিত্তিতেই রায় দিয়ে নতুন করে রাম মন্দির নির্মাণের নির্দেশ দিয়েছে।

এবার বিষয়গুলো ব্যাখ্যা করি। এই জন্য বাবরি মসজিদ নিয়ে বিরোধিতার শুরু থেকে নজর দিতে হবে। এখন পর্যন্ত এই নিয়ে চারটি মামলা হয়েছে। পাঠকের বুঝবার জন্য সেই মামলাগুলোর সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরছি। সেই ১৮৮৫ সালে থেকে যার শুরু। বাবরি মসজিদ, মসজিদ সংলগ্ন কবরস্থান মিলে জমির পরিমাণ প্রায় ২.৭৭ হেক্টর। যার মালিকানার দাবি করেছে, নির্মোহ আখড়া, সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড, আর স্বয়ং রামের হয়ে তার একজন পূজারী।

এই চারটি মামলা হলো:

মামলা ১: মসজিদে রামের মূর্তি স্থাপন করে পূজা করার অনুমতি চেয়ে ১৯৫০ সালে রাম ভক্ত গোপাল সিং বিশারদ প্রথম মামলা করেন। সেই সময়ই রামের মূর্তিও স্থাপন করা হয় মসজিদের ভেতরে।

মামলা ২: ১৯৫৯ সালে ‘নির্মোহ আখড়া’ মসজিদের পুরা মালিকানা দাবি করে মামলা দায়ের করে। এর আগে নির্মোহ আখড়ার মহান্ত রঘুবির দাস ১৮৮৫ সালে এখানে মসজিদের পাশে মন্দির বানানোর অনুমতি চেয়ে মামলা করেছিল। কিন্তু তাতে তাদের দাবি নাকচ করে দেয়া হয়েছিল। (নির্মোহ আখড়া খুব ধনী একটি সংগঠন/ সম্প্রদায় যা ভারতে প্রচুর মন্দির এবং মঠের মালিক।)

মামলা ৩: ১৯৬১ সালে মুসলিম সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড পুরো প্রপার্টির মালিকানা দাবী করে মসজিদ থেকে মূর্তি সরিয়ে ফেলার আর মসজিদের কাস্টোডিয়ানশিপ ওয়াকফ বোর্ডের কাছে হস্তান্তর করার দাবি নিয়ে মামলা করে। কোন রায় ছাড়া সেই মামলাও ঝুলে থাকে।

মামলা ৪: এই মামলাটি খুব ইন্টারেস্টিং ......

১৯৮৯ সালে হিন্দু দেবতা রামের পক্ষ হয়ে পুরো জায়গার মালিকানা দাবি করে মামলা দায়ের করে হিন্দু আরাধক জি এস বিশারদ।

চারটি সিভিল মামলার ওপর ভিত্তি করে ২০১০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর এলাহাবাদ হাইকোর্ট বাবরি মসজিদের জমিকে তিন গ্রুপের মাঝে ভাগ করার রায় দেয়। যার একাংশ সুন্নি বোর্ড, অন্য অংশ মন্দির আর বাকি অংশ নির্মোহ আখড়াকে দেয়া হয়। এরপর মামলাটি চলে যায় ভারতের সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে, যার রায় দেয়ার মাধ্যমে ভারতের ইতিহাসে আইনি সম্প্রাদায়িকতার সূচনা করলো সে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

এবার আসি কেন এই রায়কে সাম্প্রদায়িক বলছি তার ব্যাখ্যায়

রায়ে, ২ দশমিক ৭৭ একর জমিতে মন্দির নির্মাণের জন্য কেন্দ্রীয় সরকারকে ট্রাস্ট গঠনের নির্দেশ দিয়েছেন সুপ্রিম কোর্ট। বিপরীতে অযোধ্যায় অন্য কোনো স্থানে মসজিদ নির্মাণের জন্য পাঁচ একর জমি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ডকে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু জমিটি সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড কখন বুঝে পাবে তা পরিষ্কার করে বলা নেই।

অপরদিকে, আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার (এএসআই) তথ্যানুযায়ী বাবরি মসজিদের নিচে স্থাপনার প্রমাণ পাওয়া গেছে। তবে মাটির নিচে থাকা স্থাপনাটি ঠিক কী ছিল, তা এএসআই সুনির্দিষ্ট করে বলতে পারেনি। অর্থাৎ রাম মন্দিরের জায়গায় যে মসজিদ নির্মাণ হয়েছিল কোর্ট তা প্রমাণ করতে পারেনি।

কলকাতার আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে বলা হয়, রায়ের শুরুতেই প্রধান বিচারপতি রঞ্জন গগৈ ওয়াকফ বোর্ডের আর্জি এবং নির্মোহ আখড়ার বিতর্কিত জমির ওপর দাবি খারিজ করে দেন। তারপর তিনি বলেন, 'যেহেতু বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে জমির মালিকানা ঠিক করা সম্ভব নয়, তাই আইনের ভিত্তিতেই জমির মালিকানা ঠিক করা উচিত। আপাতত কেন্দ্রীয় সরকার ওই জমির মালিকানা পাবে। কেন্দ্রকে তিন মাসের মধ্যে বোর্ড অব ট্রাস্ট গঠন করে তাদের হাতে বিতর্কিত জমি তুলে দিতে হবে। ট্রাস্টের তত্ত্বাবধানেই বিতর্কিত ২ দশমিক ৭৭ একর জমিতে মন্দির নির্মাণ হবে। সুন্নি ওয়াকফ বোর্ড ওই জমিতে অধিকার দাবি করতে পারবে না।' এখানে প্রশ্ন হলো, ধর্মীয় বিশ্বাসকে যদি আদালত প্রাধান্য না দেন তাহলে কিসের ভিত্তিতে কোন আইনের বলে মন্দির নির্মাণের অনুমতি দিলেন?

গণমাধ্যমের খবর থেকে যা বুঝলাম, এএসআই এর খননের ফলে মসজিদের নিচে যেসব জিনিস পাওয়া গেছে, তাতে মনে হয়েছে মসজিদটির নিচে অন্য কাঠামো ছিল। তবে সেগুলো মসজিদের না মন্দিরের তা নিশ্চিত নয়। তবে, কাল্পনিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে রায় মন্দিরের পক্ষেই গেছে। ওদিকে, রায়ে মসজিদ ভাঙার জন্য, হাজার হাজার মুসলিমকে হত্যার জন্য, কোনো শাস্তির কথা না বলায়, বিজেপির রাম মন্দিরের জন্য মসজিদ ধ্বংসের বিষয়টিকে ‘অন্যায়’ না বলে নৈতিক ভিত্তিই দিল। যা কি না ধর্মীয় স্থাপনা উচ্ছেদ আর ধর্মের নামে হানাহানিকে ভারতে আইনিভাবে প্রতিষ্ঠিত করলো।

তর্কের খাতিরে যদি ধরেও নেওয়া হয়, এক সময়ে সেখানে রাম মন্দির ছিল তাই মসজিদ ভাঙতে হবে। তাহলে তো বলতে হয় কাবা শরিফেও তো আরবের পৌত্তলিকদের উপাসনা চলতো একসময়, এখন পৌত্তলিকরা কাবা শরিফের মালিকানা দাবি করলে চলবে? একসময় তো এই রাম-শ্যাম, কোরআন ইসলাম কিছুই ছিল না (বিজ্ঞানের কথা অনুসারে) তখন মানুষ সূর্য-চাঁদ এগুলোর পূজো করতো। তাহলে কি হিন্দু-ইসলাম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ধর্ম বিশ্বাস বাদ দিয়ে আবার আগের সূর্য দেবতাকে নিয়ে আসতে হবে?

আমার বন্ধু ফরহাদ হোসেন বলেন, রাজনীতিতে ইস্যু থাকতে হয় কিংবা ইস্যু তৈরি করতে হয়। আবার রাজনীতির মাঠে বিপক্ষ দলও লাগে। কিংবা অদৃশ্য শত্রুরও প্রয়োজন আছে। শত্রু না থাকলে বানানো হয়। এসব না করলে রাজনীতির খেলা জমে না। মানুষও এক পেশে খেলা বেশি দিন খায় না। তাই তো বাবরি মসজিদ, গোরক্ষা, এনআরসি এসবই খেলার উপাদান। এগুলো না থাকলে কিংবা না বানালে রাজনীতি করবে কেমনে ওরা? সব কিছু ঠিকঠাক চললে তো ওরা বেকার হয়ে যাবে, রাজনীতিই হারিয়ে যাবে।

লেখক: সাজিদ হক সৌম্য

যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক।

 

টাইমস/টিএইচ/এনজে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ভেনেজুয়েলায় মাদুরোর দিন ফুরিয়ে আসছে : রিক স্কট Oct 28, 2025
img
এআই ড্রোন ও রোবট কুকুরে চীনে সামরিক বিপ্লব Oct 28, 2025
img
ঘূর্ণিঝড়ে রূপ নিলো মোন্থা, বাতাসের সর্বোচ্চ গতি ১১০ কি.মি. Oct 28, 2025
img
জেলা ঘোষণার দাবিতে ভৈরবে এবার নৌপথ অবরোধ Oct 28, 2025
img
২০ বছর পালিয়ে অবশেষে ধরা পড়লেন মফিজ Oct 28, 2025
img
ভূমি কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগ Oct 28, 2025
img
‘সবকিছু পরিকল্পনা অনুসারে চলছে', কিমকে পুতিনের বার্তা Oct 28, 2025
img
বীরশ্রেষ্ঠ হামিদুর রহমানের ৫৪তম শাহাদাতবার্ষিকী আজ Oct 28, 2025
img
দুর্নীতির মামলায় খালাস পেলেন এলডিপি মহাসচিব রেদোয়ান Oct 28, 2025
img
যুক্তরাষ্ট্র থেকে গম আমদানিতে কোনো অনিয়ম হয়নি : খাদ্য মন্ত্রণালয় Oct 28, 2025
img
৫ বছর পর আবারও ভারত-চীনের সরাসরি ফ্লাইট চালু Oct 28, 2025
img
ঢাবির দুই প্রক্টরের বিরুদ্ধে গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ Oct 28, 2025
img
২০২৬ বিশ্বকাপ পরিকল্পনা নিয়ে মেসির বার্তা Oct 28, 2025
img
নির্বাচনে প্রতি কেন্দ্রে ১৩ আনসার নিয়োজিত থাকবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Oct 28, 2025
img
তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা ফেরাতে চলছে চতুর্থ দিনের আপিল শুনানি Oct 28, 2025
img
নিয়মিত পড়ালেখা করতে হবে, নইলে পাস করা যাবে না: শিক্ষা উপদেষ্টা Oct 28, 2025
img

বেলজিয়ামের হুঁশিয়ারি

ব্রাসেলসে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করলে মস্কোকে মানচিত্র থেকে মুছে ফেলব Oct 28, 2025
img
অক্টোবরের ২৬ দিনে এলো ২১৬ কোটি ডলার রেমিট্যান্স Oct 28, 2025
img
ছাত্র উপদেষ্টারা কিছু বিষয় না জেনে বলেন, কিছু বিষয় বেশি বুঝে বলেন : ডা. সায়ন্থ Oct 28, 2025
img
তৃতীয় মেয়াদে প্রেসিডেন্ট হওয়ার ইচ্ছা ট্রাম্পের Oct 28, 2025