থাইল্যান্ড ভ্রমণ: ব্যাংকক শহর ও সাফারি ওয়ার্ল্ড ভ্রমণ (পর্ব-৪)

১৮ নভেম্বর বিকাল চারটায় আমরা পাতায়া থেকে ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা দেই। সবচেয়ে ভালো লেগেছে যে বিষয়টি সেটা হলো আমরা যে গাড়িতে করে ব্যাংককের উদ্দেশে রওনা দিয়েছিলাম সেই গাড়ির চালক ছিলেন একজন থাই ভদ্রমহিলা। সাধারণত চালকের পাশের আসনে বাবা বসেন। তবে এবার ভদ্রমহিলাকে দেখে অতি আগ্রহে আমিই গিয়ে উনার পাশে বসলাম। ভদ্রমহিলা খুবই মিশুক ছিলেন। আমরা অনেক ক্ষণ গল্প করেছি। এখানে একটা কথা বলে রাখি,আমি আমার নিজের দেশে খুবই অন্তর্মুখী টাইপের হলেও বিদেশে আসলে বেশ কথা বলি এবং অনেক মেশার চেষ্টা করি সবার সাথে। তার কারণ প্রথমত এখানে আমার ভুল ধরার মতো কেউ নেই। তাছাড়া এখানে কেউ আমাকে চিনে না।  সুতরাং ইতস্তত বোধ করার কোনো কারণ নেই। তার সাথে সাথে ইংরেজি চর্চাটা খুব ভালো হয়।

ভদ্রমহিলা গুগল ম্যাপ অনুসরণ করে করে গাড়ি চালাচ্ছিলেন। আমি উনার সাথে কথা বলতে বলতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছি মনে নেই। ঘুম ভেঙেছে যখন সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে। জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখি ঝকঝকে তকতকে আলোর ঝলকানি, অনেক বড় বড়  আকাশচুম্বি ভবন আর আলোয় পরিপূর্ণ শহর। আমার মতে কিছু শহর থাকে যা শুধুই রাতের সৌন্দর্যে ভরপুর। দিনে সেসব শহরের সৌন্দর্য রাতের শহরের কাছে কিছুই না। ব্যাংকককেও আমার রাতের সৌন্দর্যের শহর বলেই মনে হয়েছে। রাস্তার ওপরে স্কাই ট্রেন, শহরে অনেক অনেক ফ্লাইওভার। কোথা থেকে কোনো রাস্তা আসছে বা যাচ্ছে বুঝতে পারছিলাম না। নিচে তাকালেও রাস্তা, ওপরে তাকালেও রাস্তা, ডানে বামে, দূরে সব জায়গায়ই রাস্তা। অর্থাৎ ব্যাংকক যেন রাস্তার শহর। লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, ব্যাংককের জ্যাম একটি নির্দিষ্ট  মাত্রায় রাখা সম্ভব হয়েছে 'স্কাই ট্রেন' এবং 'ফ্লাইওভার' এর কারণে।

ব্যাংককের রাতের শহর দেখতে দেখতে পৌঁছে গেলাম জেনিথ সুখোমভিত হোটেলে। এ হোটেলটা আমার খুব ভালো লেগেছে। আমাদের রুমটা ছিল ১৪ তলায়। রাতে আমরা ডিনার সেরে ফেললাম। পরদিন ভোরে উঠে ব্রেকফাস্ট করতে চলে গেলাম ওই হোটেলেরই পঞ্চম তলায়। জেনিথ সুখোমভিত হোটেলে ‘বেড অ্যান্ড ব্রেকফাস্টের’ এর ব্যবস্থা  ছিল। নাশতা ছিল বুফেতে। এত খাবারের সমারোহে কোনটা ছেড়ে কোনটা খাব বুঝে উঠতে  পারছিলাম না। সবরকমের খাবার ছিলো সেখানে।যখন আনলিমিটেড খাবারের আয়োজন থাকে তখন তৃপ্তি করে খাওয়া যায় না খুব একটা। নাশতা শেষ করেই আমাদের 'সাফারি ওয়ার্ল্ড' ভ্রমণের যাত্রা শুরু হলো। এটাও একটা 'প্যাকেজ ট্যুর' ছিল। 'মনিকাস কিচেন' নামের একটি বাঙালি রেস্তোরাঁ থেকে এই প্যাকেজ ট্যুরের ব্যবস্থা  করে দিয়েছিল। আমরা মাইক্রোবাসে উঠলাম। আমাদের গাইড ছিলেন একজন থাই বয়স্ক ভদ্রমহিলা। প্যাকেজ ট্যুরের অন্যান্য পর্যটকরা হলেন দুইজন শ্রীলঙ্কার দম্পতি, ওমানের একজন তরুণ, সৌদি আরবের একজন বয়স্ক ভদ্রলোক এবং মিয়ানমারের দুইজন তরুণী। রওনা দেওয়ার প্রায় দেড় ঘন্টা পর আমরা 'সাফারি ওয়ার্ল্ড' এ পৌঁছালাম।

'সাফারি ওয়ার্ল্ড দুই ভাগে বিভক্ত:

১. মেরিন পার্ক

২. সাফারি পার্ক

প্রথমেই আমাদের গাইড আমাদের মেরিন পার্কে নিয়ে গেলেন। এখানে একটা মজার বিষয় ছিল, গাইড একটা লাঠির সাথে ওড়না জাতীয় কিছু বেঁধে রেখেছিলেন। ওটা উঁচু করে সবার সামনে হাঁটছিলেন যাতে দূর থেকেও আমরা উনাকে চিনতে পারি। তিনি প্রথমে আমাদের ডলফিন শো যেখানে শুরু হবে সেখানে গিয়ে বললেন ভিতরে ঢুকে যেতে; তিনি বাইরে অপেক্ষা করবেন। আমরা যাতে শো শেষ করে ওই জায়গায় চলে আসি। আমরা উনার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনে ভিতরে ঢুকলাম। ব্যাংককের বিভিন্ন স্কুলের  ইউনিফর্ম  পড়া  খুবই ছোট ছোট বাচ্চারাও এসেছিল দেখলাম। ওদের চিৎকার এবং আনন্দ দেখেই মন ভালো হয়ে যাচ্ছিল। ডলফিন শো শুরু হলো অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই। বেশ কয়েকটি ডলফিন সাঁতার কাটতে কাটতে উঁচু করে লাফ দিচ্ছিল। এছাড়াও জোড়া বেঁধে বেঁধে পুরো পানিতে নেচে বেড়াচ্ছিল, উঁচু রিং এর মত কিছু একটা থেকে লাফও দিচ্ছিল। একটা ডলফিন গ্যাংনাম গানের সাথেও নাচছিল। যারা ডলফিনগুলোকে নির্দেশ দিচ্ছিল তারা কিছুক্ষণ পর পর ডলফিনগুলোকে আদর করছিল এবং প্রত্যেকটা খেলার পরপরই খাবার দিচ্ছিল। নির্দেশনা প্রদানকারীদের মধ্যে একজন ডলফিনের ওপরে চড়ে ঘুরেও দেখালেন পুরো পুলটা। স্কুলের বাচ্চাদের চিৎকার  আমাদের আনন্দ আর মজা দুটোকেই বাড়িয়ে তুলছিল। শো শেষ হবার পর আমরা আবার গাইডের কাছে ফিরে এলাম। এরপর  গাইড ভদ্রমহিলা আমাদের নিয়ে গেলেন 'এলিফ্যান্ট শো' দেখানোর জন্য। শো শুরু হয়ে গেল। প্রথমেই দেখলাম অনেকগুলো হাতি  ছবি আঁকছিল শুঁড়ের মাধ্যমে। এরপর তারা ফুটবল, বাস্কেটবল খেলে দেখাল। একটি হাতি শুঁড়ের মাধ্যমে একজন তরুণীকে নিয়ে গেল। দর্শক সারি থেকে দু’জনকে ডাকা হলো। হাতিগুলো তাদের ওপর দিয়ে হেঁটে দেখাল। হাতির খেলা আমার কাছে মোটামুটি লেগেছে। এরপরের শো ছিল অনেক অনেক মজার যেটার নাম হলো 'ওরাং ওটাং শো' অর্থাৎ  বানরের শো। মানুষ যে দুষ্টু বাচ্চাদের শুধু শুধু 'বান্দর' নামে অভিহিত করেন না তা এই শো দেখে বুঝতে পারলাম। কি সুন্দর সুন্দর  জামা পড়েছিল তারা! বানরগুলো বিভিন্ন রকম বাদ্যযন্ত্র বাজাচ্ছিল। নির্দেশনা প্রদানকারী আর বানরের কথোপকথন দেখলাম এবং শুনলাম। হাসতে হাসতে পেটে খিল ধরে যাওয়ার মত অবস্থা হয়েছিল। এত দুষ্ট বানরগুলো! এরপর শুরু হলো বানরের বক্সিং। সেখানে অনেকগুলো বানর ছিল। একটি ডাক্তার বানর, দুটি বক্সার বানর,একটি সুন্দরী তরুণী বানর, অনেকগুলো দর্শক বানর, স্ট্রেচার নিয়ে আসার জন্য কয়েকটি বানর। নানা চরিত্রে অগণিত বানর খেলা দেখাল। সবগুলো চরিত্র আমার মনে নেই। আর সত্যি কথা বলতে কী বানরের এই শো এর বর্ণনা লিখে বোঝানো যাবে না। যারা দেখেছেন তারাই বুঝবেন কি পরিমাণ হাসির ছিল শো’টা। এরপরের শো’টা ছিল প্রচণ্ড বিরক্তিকর একটা শো। ওয়েস্টার্ন ছবির আদলে তৈরি 'ওয়েস্টার্ন  কাউবয় স্টান্ট শো'। অর্থাৎ অভিনেত্রী, অভিনেতাগণ আমাদের সামনেই মুভিটা করেছিলেন এবং  সেভাবেই মঞ্চ তৈরি করা হয়েছিল। প্রচণ্ড বাস্তবধর্মী ছিল। ওপর থেকে দেয়াল ভেঙে  নিচে পড়ার দৃশ্য, আগুনের গোলা, একদম সত্যিকারের গুলির মতো বন্দুকযুদ্ধ, সত্যিকারের ঘোড়া দিয়ে যুদ্ধ, কুয়া, ভবন সব সরাসরি এভাবে দেখলে দর্শকের ভালো লাগাটা স্বাভাবিক। কিন্তু আমার মুভির প্রতি আগ্রহ কম তাই খুব একটা ভালো লাগেনি। তবে এটা ঠিক তাদের পরিশ্রম অনেক বেশি ছিল। পরের শো ছিল 'স্পাই ওয়ার শো'। এটাও আমার কাছে তেমন ভালো লাগেনি। কিছুক্ষণ পর পর আগুনের গোলা, অনেক উঁচু থেকে লাফ দেওয়া, অনেক বিকট জোড়ে বোমা  বিস্ফোরণ ইত্যাদি  থাকা সত্ত্বেও আমার ভালো লাগেনি। এরপর আমরা সাফারি ওয়ার্ল্ডের ভেতরেই একটি ভারতীয় রেস্তোরাঁয় গেলাম। যেখানে বুফের আয়োজন ছিল। অনেক খাবারের সমারোহ ছিল। দুপুরের খাবার সেরে আবার শুরু হলো শো দেখার পালা। পরবর্তী শো এর নাম ছিলো ‘সি লায়ন শো’। এই শো’টা  অসাধারণ! এত সুন্দরভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে সি লায়নগুলোকে যা বলার মতো না। তারা বল এবং রিং দিয়ে খেলছিল। তাছাড়া আরও অনেক আকর্ষণীয় খেলা দেখাচ্ছিল। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নাচের স্টাইলে বিভিন্ন অঙ্গ ভঙ্গিমা সবকিছুই মন ভালো করে দেওয়ার মতো। সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে,  প্রত্যেকটা খেলার পর সি লায়নগুলো তালি দিচ্ছিল। শোগুলোর মাঝখানে মাঝখানে অনেক মজার মজার ঘটনা ঘটেছে। সৌদি আরবের বয়স্ক ভদ্রলোকটি কিছুক্ষণ পরপর হারিয়ে যাচ্ছিলেন। আর আমাদের গাইড (বয়স্ক ভদ্রমহিলা)  উনাকে খুঁজে বের করছিলেন। আমাদের গাইড খুবই ভালো  ছিলেন। অন্যদের চেয়ে আমার আর আম্মুর সাথে উনার বেশি ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল। এছাড়াও আমাদের প্যাকেজ ট্যুরের অন্যান্য পর্যটকদের সাথে ভীষণ ভালো বন্ধুত্ব হয়েছিল।

এবার সাফারি পার্কে ঘোরাঘুরি। প্রথমেই আমরা মাইক্রোবাসে উঠে বসলাম। গাইড বারবার সতর্ক করছিলেন যাতে আমরা কেউ দরজা জানালা না খুলি। আমরা গাড়িতে ঘুরছি এবং প্রাণিগুলো যে যার জায়গায় নিজের মত ঘুরছে, ফিরছে, খাওয়া-দাওয়া করছে। অগণিত জিরাফ, জেব্রা পুরো সাফারি পার্ক জুড়ে ছিল। এছাড়াও ছিল প্রচুর উট, হাতি, ভালুক ইত্যাদি। অনেক বাঘ ও সিংহ দেখলাম বিশ্রাম করছে। অনেক  পাখি দেখলাম সেখানে। যেমন: উটপাখি, রাঙা মানিকজোড়(Painted Stork- দেখে মনে হবে তাদের সারা শরীরে রঙতুলির ছোঁয়া), ম্যারাবু মদনটাক(Marabou Stork), ময়ূর, মেটেঝুঁটি সারস (Grey Crowned Crane), গগণবেড় (Pelican) ইত্যাদি। এ পাখিগুলোর বিচরণ ঝাঁকে ঝাঁকে পুরো সাফারি পার্ক ঘিরে ছিল। এছাড়াও অনেক অসাধারণ প্রাণির দর্শন মিলেছে সেখানে। যেমন- সাদা গন্ডার, নানা প্রজাতির হরিণ, নীলগাই ইত্যাদি। সাফারি পার্ক ঘোরার পরই ফেরার পালা। আমাদের শপিংয়েও যেতে হবে। গাইড বয়স্ক ভদ্রমহিলা এতই আন্তরিক ছিলেন যে আমাদের একটা শপিংমলে পৌঁছে দিয়েই তিনি ক্ষান্ত থাকেননি। কোথায় কি পাওয়া যায়, না পাওয়া সবকিছু দেখিয়ে পরে তিনি বিদায় দিলেন। এরপর শপিং শেষে  ডিনার করে হোটেলে ফিরে এলাম। খুব সুন্দর ছিল দিনটা। সবার কাছেই ব্যাংককের বিখ্যাত সাফারি ওয়ার্ল্ডের নাম শুনেছি। তবে সেটা যে এতটা সুন্দর হবে ভাবতেও পারিনি। বাংলাদেশের সাফারি পার্কেও যদি এ রকম সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করা হয় তাহলে তা  অবশ্যই দেশ-বিদেশের পর্যটকদের আরও বেশি আকৃষ্ট করবে। থাইল্যান্ড ভ্রমণের পরবর্তী পর্বগুলো শিগগির লেখা হবে।

চলবে...

লেখক: শিক্ষার্থী, সংগীত বিভাগ
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ। 

থাইল্যান্ড ভ্রমণ পর্ব-১

থাইল্যান্ড ভ্রমণ: সমুদ্র সৈকত এবং রাতের পাতায়া (পর্ব-২)

থাইল্যান্ড ভ্রমণ: পাতায়া থেকে কোরাল দ্বীপ (পর্ব-৩)

 

টাইমস/এসআই

Share this news on: