“উপকূলের বন্ধু” শাহীন বিল্লাহ

উপকূলের জেলা সাতক্ষীরার বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ছুটে বেড়ান গ্রাম থেকে গ্রামে। তুলেন ছবি, আসেন ফেসবুকে লাইভে। দেশবাসীর সামনে তুলে ধরেন উপকূলবাসীর বুকফাটা আর্তনাদ আর হাহাকারের কথা। তা দেখে মানুষজন যেটুকু সাহায্য পাঠায় তা দিয়ে বাচ্চাদের জন্য কিনে নিয়ে যান চিপস-বিস্কুট, কিশোরীদের জন্য স্যানিটারি ন্যাপকিন আবার কখনোবা গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবার।

এসব বিষয় নিয়ে বাংলাদেশ টাইমস এর সাথে কথা বলেছেন সাতক্ষীরা সরকারি কলেজের স্নাতক প্রথম বর্ষের ছাত্র শাহিন বিল্লাহ। তিনি সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার পদ্মপুকুর ইউনিয়নের এসএম শহিদুল্লাহ ও জাহানারা খানম দম্পতির বড় সন্তান।

বাংলাদেশ টাইমস: বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ানো, গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ানো, ত্রাণ বিতরণ এসবের শুরুটা হলো কিভাবে?

শাহীন বিল্লাহ: শিশুকাল থেকে খুব কাছে থেকে দেখেছি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ। তারপর মানুষের বুকফাটা আর্তনাদ, হাহাকার। ২০০৯ সালে প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড় আইলা আঘাত হানার সময় আমার বয়স ছিল ৮ বছর। আমার গ্রামের বাড়ির সব কিছু তছনছ হয়ে যায়। পানিতে তলিয়ে ছিলাম ১ বছর। সে সময় খাদ্যের তীব্র সংকট দেখা দেয়, লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। সব মিলিয়ে জীবন থমকে গিয়েছিলো। কত মানুষ মারা গিয়েছিলো, কত মানুষ অনাহারে অর্ধাহারে পানি বন্দী অবস্থায় দিনের পর দিন, মাসের পর মাস কাটিয়ে দিয়েছিলো। এসব আমাকে প্রতিনিয়ত ভাবায়, যার কারণে প্রাকৃতিক দুর্যোগ আর উপকূলে মানবিক বিপর্যয় দেখলে বসে থাকতে পারি না ছুটে যাই গ্রামে গ্রামে।

আমি শিশুকাল থেকে লেখালেখি এবং ইউনিসেফের শিশু সাংবাদিকতার সাথে যুক্ত। তাই আমি যখই সময় পাই উপকূলের সমস্যা ও সম্ভাবনা নিয়ে কখনো লেখালেখি করি, কখনো ভিডিও করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করি। আম্পান যখন আঘাত হানে তার পর থেকে প্রতিনিয়ত সেখানকার দুরবস্থার চিত্র সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তুলে ধরি। যেসব জায়গাতে কেউ কখনো যায় না, সেসব জায়গাতে গিয়ে যখন সেখানকার চিত্র তুলে ধরতে পেরেছি তখন বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন, সংস্থা আমার মাধ্যমে সহযোগিতা দেন। প্রথমে আমার একজন শিক্ষক কিছু টাকা পাঠান আমি সেই টাকা দিয়ে নিত্য প্রয়োজনীয় খাদ্য নিয়ে বানভাসিদের নিকট ছুটে যাই আর এভাবে একের পর সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন বিভিন্ন ব্যক্তি ও সংগঠন।

বাংলাদেশ টাইমস: বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষের পাশে এসে দাঁড়ান, মানুষকে সতর্ক করেন, মানুষের মাঝে সচেতনতা বৃদ্ধির চেষ্টা করেন। এই বয়সে এতো বড় কাজ করার অনুপ্রেরণা পেলেন কোথায় থেকে?

শাহীন বিল্লাহ: আমি কোথাও থেকে অনুপ্রেরণা পাইনি। আমি আমার নিজের দায়বদ্ধতা আর দায়িত্ববোধের জায়গা থেকে করি। আর তাতেই আত্মতৃপ্তি পাই।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনার সমবয়সী সবাই যখন খেলাধুলা, পড়াশোনা, ক্যারিয়ার নিয়ে ব্যস্ত আপনি তখন গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়াচ্ছেন, মানুষকে সচেতন করছেন, মানুষের পাশে এসে দাঁড়াচ্ছেন তাতে আপনার পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় না?

শাহীন বিল্লাহ: ছোট বেলা থেকে আমার পাঠ্যবইয়ের বাইরের জগতের প্রতি একটু বেশিই টান ছিলো। আমার বন্ধুরা খেলা করত, আমি তখন উপকূলের বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে ঘুরে দেখতাম আর আবিষ্কার করতাম সেখানের সমস্যা ও সম্ভাবনা। পড়ালেখার ফাঁকে যে সময় টুকু পেতাম চলে যেতাম নদীর পাড়ে নিভৃত পল্লীতে, শুনতাম সেখানকার মানুষের দুঃখ কষ্টের কথা। পড়াশোনা বা ক্যারিয়ার নিয়ে দুশ্চিন্তা হয় না এমন না, হয় কিন্তু উপকূলের মানুষের কষ্ট দেখলে ভুলে যাই সব।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনি এখন কি করছেন? ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা কি?

শাহীন বিল্লাহ: আমি লেখাপড়া করছি সাতক্ষীরা সরকারি কলেজে স্নাতক প্রথম বর্ষে। পাশাপাশি সাংবাদিকতা করি। ভবিষ্যতে যে পেশাতে যাই না কেন উপকূলের ভাগ্যহত মানুষদের জীবন মান পরিবর্তনের জন্য কাজ করব।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনার পরিবারের লোকজন বিষয়টাকে কিভাবে দেখেন?

শাহীন বিল্লাহ: শুরুতে আমার এই খামখেয়ালীপনা পরিবার মেনে নিত না। বাবা বকাবকি করত। কিন্তু যখন দেখলো আমি হাজারো মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছি, তাদের মুখে হাসি ফুটাচ্ছি, এখন সম্পূর্ণ সার্পোট করে, পরিবারের সবাই পজেটিভলি দেখে।

বাংলাদেশ টাইমস: আপনাকে দেখা যায়, বন্যার সময় বা যে কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগের সময় ত্রাণ হিসেবে সবাই যখন চাল, ডাল, তৈল বা শুকনো খাবার দেয় আপনি তখন বাচ্চাদের জন্য বিভিন্ন খাবার নিয়ে যাচ্ছেন, কিশোরীদের স্যানিটারি ন্যাপকিন দিচ্ছেন আবার গর্ভবতী মায়েদের জন্য পুষ্টিকর খাবারের ব্যবস্থা করছেন, এমন ব্যতিক্রমী কিছু করার চিন্তা আসলো কিভাবে?

শাহীন বিল্লাহ: শুরু থেকে আমার ভাবনা ছিলো আমি গতানুগতিক কিছু নিয়ে যাবো না কারণ সবাই একই জিনিস নিয়ে যায়। এখানে আমি আমার ছোট বেলার অভিজ্ঞা কাজে লাগিয়েছি। আমি যখন ছোট ছিলাম, দেখতাম সবাই যখন খাবারের ট্রলার নিয়ে তীরে ভিড়ত আমি বা আমার মতো শিশুরা হুমড়ি খেয়ে পড়তাম, ভাবতাম আমাদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। কিন্তু বার বার হতাশ হতাম কারণ আমাদের জন্য কিছু নিয়ে আসত না। সেই জায়গা থেকে আমি চেষ্টা করি শিশুদের জন্য কিছু না কিছু নিয়ে যেতে। তাছাড়া গর্ভবতী, প্রতিবন্ধীদের জন্য, কিশোরীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য ন্যাপকিন। উপকূল ঘুরে ঘুরে সমস্যা চিহ্নিত করে এই ব্যতিক্রম উদ্যোগ গুলো নিয়েছি। আমি যেহেতু উপকূলের ছেলে সেহেতু আমি জানি সমস্যা কোথায় আর সমাধান কি? অনেকে দায়সারা সহায়তা দিতে আসেন সামনে যাকে পান তাকে দিয়ে চলে যান।

বাংলাদেশ টাইমস: কয়রা উপজেলার কাটমারচর এর মত দুর্গম জায়গায়, ঘূর্ণিঝড় আম্পানের কারণে যেখানে সবাই বাড়িঘর ছেড়ে নিরাপদ জায়গায় আশ্রয় নিয়েছেন, সেখানে আপনি গর্ভবতী অই নারীর খুঁজ পেলেন কিভাবে?

শাহীন বিল্লাহ: আম্পানের পরের দিন বেরিয়ে পড়ি ক্যামেরা নিয়ে। আগের দিন হয়ে যাওয়া ঝড়ের ক্ষতের চিত্র তুলছি। বেশ কিছু ছবি তোলার পর দেখি দূরে মাঠের মধ্যে একটা ঘর পড়ে আছে মাটিতে। দেখে ভাবলাম ভালো একটা ছবি হবে, বোঝানো যাবে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কিন্তু হেটে কাছে যেতেই শুনি কারা যেনো কথা বলছে। আমি তো রীতিমত অবাক, কল্পনাও করা যায় না এখানে একটা পরিবার আটকা পড়ে আছে। পরে কথা বলে জানতে পারলাম, ঘরে একজন গর্ভবতী মা থাকায় আশ্রয়কেন্দ্রে নিয়ে যেতে পারেননি, তাই পরিবারের কেউ আর আশ্রয়কেন্দ্রে যাননি। পরবর্তীতে তারা কেউ আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে না চাইলে আমি এক মাসের বাজার ও নতুন জামা নিয়ে দেখতে যাই।

বাংলাদেশ টাইমস: দুর্যোগের সময় আপনি মানুষকে সচেতন করার পাশাপাশি ছবি তুলেন, ফেসবুক লাইভে আসেন, এর কারণ কি?

শাহীন বিল্লাহ: কারণ যদি এক কথায় বলি তাহলে মানুষকে জানানোর জন্য। উপকূলের মানুষ বাস্তবিক অর্থে কিভাবে জীবন অতিবাহিত করে তা জানানো এবং দেখানো।

আম্পানের পূর্বে মিডিয়ায় আমার এলাকার খবর দেখালেও পরে আর দেখায় না। যখন দেখানোর দরকার তখন আসলে দেখায়না। সেই ক্ষোভের জায়গা থেকে আর কিছু মিডিয়া দেখালেও তারা আসলে ক্ষতিগ্রস্তদের নিকট পর্যন্ত পৌছায় না। তাই আমি আমার লাইভের মাধ্যমে একেবারে প্রত্যন্ত এলাকায় গিয়ে সেখানকার চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করি।

বাংলাদেশ টাইমস: বিভিন্ন দুর্যোগে মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন, জনসচেতনতায় কাজ করছেন, ত্রাণ বিতরণ করছেন এর জন্য যে অর্থ প্রয়োজন তা কিভাবে সংগ্রহ করেন?

শাহীন বিল্লাহ: আমার লাইভ করার কারণে উপকূলের প্রকৃত অবস্থা অনেকে জানতে পারছে, দেখতে পারছে। সেই থেকে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন ব্যক্তি, সংগঠন ও সংস্থা তাদের সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেয়। আর মাধ্যম হিসেবে আমি সেগুলো ক্ষতিগ্রস্তদের মাঝে বিতরণ করি।

বাংলাদেশ টাইমস: সব রকম দুর্যোগে এগিয়ে যাওয়া, মানুষের পাশে দাঁড়ানো, জনসচেতনতা বৃদ্ধি ইত্যাদি সব কাজ কি আপনি ব্যক্তিগতভাবেই করেন? নাকি আপনাদের কোন সংগঠন আছে? না থাকলে ভবিষ্যতে কি এমন কোন সংগঠন গড়ে তুলার ইচ্ছে আছে যাতে করে আরও বেশি মানুষ মিলে অসহায় মানুষগুলোর পাশে গিয়ে দাঁড়াতে পারেন?

শাহীন বিল্লাহ: ব্যক্তিগতভাবে করলেও আমার একটি উপকূল এক্সপ্রেস টিম আছে। যারা সবসময় মানুষের ক্রান্তিলগ্নে সর্বাত্মকভাবে পাশে থেকে কাজ করে। এইভাবে ভবিষ্যতেও মানুষের পাশে থেকে কাজ করে যেতে চাই।

 

টাইমস/আরএ/এইচইউ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কাদের সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের জমি দখল ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগ Jul 15, 2025
img
১৪ জুলাই স্মরণে ঢাবিতে রাতব্যাপী কনসার্ট Jul 15, 2025
img
১৪ জুলাই স্মরণে মধ্যরাতে রাজপথে নারী শিক্ষার্থীদের মিছিল Jul 15, 2025
img
এনসিপি’র সমন্বয় কমিটি অনুমোদনের দুই দিনের মধ্যেই তিনজনের পদত্যাগ Jul 15, 2025
img
জুলাই আন্দোলনে সম্পৃক্ত নারীদের খুঁজে বের করার উদ্যোগ নিল সরকার Jul 15, 2025
img
এনসিপি ভাগবাটোয়ারার রাজনীতিতে আগ্রহী নয়: নাহিদ ইসলাম Jul 15, 2025
img
মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে ভালো ফলাফল করা শিক্ষার্থীদের জন্য সুখবর Jul 15, 2025
img
পুতিনকে ৫০ দিনের আলটিমেটাম দিলেন ট্রাম্প Jul 15, 2025
img
মব জাস্টিস সমাজের মরণ ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে : রিজভী Jul 15, 2025
img
১৪ জুলাই স্মরণে ‘তুমি কে আমি কে রাজাকার রাজাকার’ স্লোগানে ফের উত্তাল ঢাবি Jul 15, 2025
img
টাকার বিপরীতে কমল ডলারের দাম Jul 15, 2025
img
বরগুনায় এনসিপির পথসভা, মঞ্চে সারজিসকে দেখে ‘দুলাভাই দুলাভাই’ স্লোগানে মুখর ছাত্র-জনতা Jul 15, 2025
img
'একজন প্লেয়ার হিসেবে সাকিবের বিকল্প নেই' Jul 14, 2025
img
নিজেরা মেঝেতে বসে শহীদদের মা-বাবাকে চেয়ারে বসালেন উপদেষ্টারা! Jul 14, 2025
img
ভারতে অনুপ্রবেশের চেষ্টা, আটক ২ Jul 14, 2025
img
জার্মান পার্লামেন্টে রংধনু পতাকা উত্তোলন নিষিদ্ধ Jul 14, 2025
img
৫০ ডিগ্রির ভয়াবহ গরমে কাঁপছে আমিরাত Jul 14, 2025
img
উচ্চকক্ষকে দুর্বল করার অপচেষ্টা চলছে: আখতার হোসেন Jul 14, 2025
img
সাগরে নিম্নচাপ: সমুদ্র বন্দরে ৩ নম্বর সংকেত Jul 14, 2025
img
রোহিঙ্গা সংকট মোকাবিলায় শুধু বাংলাদেশ নয়, বিশ্ব সম্প্রদায়েরও বড় দায় আছে : কক্সবাজারে দুই উপদেষ্টা Jul 14, 2025