লালনের গানে বিপ্লব এনেছিলেন ফরিদা পারভীন

লালনের গানে বিপ্লব এনেছিলেন ফরিদা পারভীন, এই কথা বললে অত্যুক্তি হয় না। লালনের গানকে জনমানসে পৌঁছে দেওয়ার প্রধান দূতও বলা যায় সদ্য প্রয়াত কিংবদন্তি এই শিল্পীকে। গ্রামীণ আঙিনা থেকে উঠে আসা বাউল লালন সাঁইজির গানকে তিনি বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরেছেন। তার কণ্ঠে লালনের দর্শন পেয়েছে নতুন প্রাণ, পেয়েছে শিল্পরূপের পূর্ণতা।

ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি ছিল প্রবল ঝোঁক। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীনও তিনি গান শেখেন নানা গুণীজনের কাছে। প্রথমে নজরুলগীতি ও আধুনিক গান গাইলেও তার নিয়তি ঠিক ছিল বুঝি লালনের গানেই। সেখানেই তিনি খুঁজে পেলেন জীবনের আসল সুর।


কুষ্টিয়ায় বেড়ে ওঠার সুবাদে লালনের ভক্ত, সাধক-শিষ্যদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয় তার। ছোটবেলায় সঙ্গীতের হাতেখড়ি হয়েছিল মাগুরায় ওস্তাদ কমল চক্রবর্তীর কাছে। পরে কুষ্টিয়ায় ওস্তাদ রবীন্দ্রনাথ রায়, মোতালেব বিশ্বাস এবং ওসমান গণির কাছে আধুনিক গানের তালিম নেন। শুরুতে নজরুল সঙ্গীতেই মনোযোগী ছিলেন তিনি। ১৯৬৮ সালে রাজশাহী বেতারে তালিকাভুক্ত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী হিসেবে নাম লেখান ফরিদা পারভীন। ১৯৭৩ সাল থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে লালন সাঁইজির গানের তালিম নেয়া শুরু করেন গুরু মোকছেদ আলী সাঁইয়ের কাছে। এরপর থেকেই সংগীতে শুরু হয় ফরিদা পারভীনের রাজকীয় যাত্রা।

কুষ্টিয়ার নিভৃতচারী সাধক লালনকে উচ্চবিত্তদের কাছে পৌঁছে দিয়েছিল কলকাতার জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির লোকেরা। ঠাকুরদের জমিদারিতেই ছিল লালনের আখড়া। সেই সুবাদে ঠাকুরবাড়ির সদস্যদের সঙ্গে লালন সাঁইয়ের গভীর সম্পর্ক তৈরি হয়েছিল। বিশেষ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভাই জ্যোতিরিন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে লালনের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনিই লালনের জীবদ্দশায় তার একমাত্র স্কেচটি তৈরি করেছিলেন। জ্যোতিরিন্দ্রনাথের সঙ্গে যোগাযোগ থাকার সুবাদে লালন শিলাইদহ কুঠিবাড়িতে আসা-যাওয়া করতেন। সেখানে তিনি সমাদর লাভ করতেন। আর রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার সাক্ষাতের কোনো তথ্য না পাওয়া গেলেও তিনি যে লালনের গান ও দর্শনে দারুণভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন সেটা স্পষ্ট।

লালনের মানবতাবাদী দর্শন ও বাউল গান রবীন্দ্রনাথকে বিশেষভাবে প্রভাবিত করে। এই প্রভাব পরে তার সাহিত্যকর্মেও প্রতিফলিত হয়েছিল। ঠাকুরবাড়ি ও কবিগুরুর হাত ধরে লালন পৌঁছে গিয়েছিলেন উচ্চবিত্তদের আসরে। নিজের সাহিত্য, বক্তৃতায় বিশ্বজুড়েও লালনকে তুলে ধরেছিলেন রবি ঠাকুর।

আর লালনকে সর্বসাধারণের কাছে ছড়িয়ে দিয়েছেন ফরিদা পারভীন। তার আগেও অনেকে লালনের গান করেছেন। কিন্তু ফরিদা পারভীন সেই গানকে শাস্ত্রীয় সুরে, মার্জিত উপস্থাপনায়, আধুনিক বাদ্যযন্ত্রের সহায়তায় এমন এক উচ্চতায় তুলেছেন যে শহুরে শিক্ষিত শ্রেণিও লালনের গান শুনতে শুরু করে তার কণ্ঠে। বোদ্ধারা দাবি করেন, লালনগানে তিনি এনেছেন নন্দনশৈলীর নবায়ন। তার কণ্ঠে ‘খাঁচার ভিতর অচিন পাখি’, ‘সত্য বল সুপথে চল’, ‘আমি কোথায় গেলে পাবো সাঁই’ এসব গান দারুণ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। দেশ ছাড়িয়ে বিদেশেও লালনের গান পৌঁছে দিয়েছেন তিনি। ইউরোপ, আমেরিকা কিংবা জাপানের মঞ্চে যখন তিনি গেয়েছেন লালনের গান ছড়িয়েছেন ‘মানবতার ভাষা সার্বজনীন’ এই বার্তা।

সেই ধারাবাহিকতায় অনেক শিল্পীই পরবর্তীতে লালনের গানে বিকশিত হয়েছেন। অনেকে লালনের গানকেই করেছেন শিল্পী জীবনের পাথেয়।
লালন সাধক ফরিদা পারভীনের জন্ম ১৯৫৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর বনলতা সেনের শহর নাটোরে। তবে বেড়ে ওঠেছেন কুষ্টিয়ায়। ১৯৭৪ সালে কুষ্টিয়া সরকারি মহিলা কলেজ থেকে এইচএসসি পাশ করেন ফরিদা পারভীন। পরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে বাংলা বিভাগ থেকে স্নাতক পাশ করেন তিনি।


লালনের গানে সমাদৃত হলেও তিনি গেয়েছেন আধুনিক, দেশের গানও। সিনেমাতেও কিছু গানে কণ্ঠ দিয়েছেন। যার ফলে ১৯৯৩ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার জেতেন সেরা নারী কণ্ঠশিল্পী হিসেবে।

ফরিদা পারভীনের বর্ণাঢ্য জীবন আরও অনেক স্বীকৃতি ও পুরস্কারে রঙিন হয়েছে। ১৯৮৭ সালে একুশে পদক পান তিনি।২০০৮ সালে জাপানের ফুকুওকা এশিয়ান কালচারাল পুরস্কার তার কৃতিত্বের স্বীকৃতি। তবে পুরস্কারের ঊর্ধ্বে তার সবচেয়ে বড় অর্জন হলো মানুষের ভালোবাসা। সাধারণ মানুষ তার কণ্ঠে লালনকে চিনেছে, জেনেছে জীবনের দর্শন- এই প্রাপ্তিকে তিনি খুব উপভোগ করতেন।

১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫ রাত ১০টা ১৫ মিনিটে রাজধানীর একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন ফরিদা পারভীন। মৃত্যুর মধ্য দিয়ে শেষ হলো এক অধ্যায়। তবে লালনের গান গেয়ে তিনি যে বিপ্লব ঘটিয়েছেন তা চিরকাল অমলিন থাকবে। তার কণ্ঠে লালনের গান নতুন প্রজন্মকে পথ দেখাবে, শেখাবে মানবতার সত্য।

Share this news on:

সর্বশেষ

img

কাতারের প্রধানমন্ত্রী

দ্বৈত নীতি বন্ধ করে ইসরায়েলকে শাস্তি দিন Sep 15, 2025
img
হেসে খেলেই পাকিস্তানকে হারাল ভারত Sep 14, 2025
img
লুৎফুজ্জামান বাবরকে স্যার স্যার করে জড়িয়ে ধরলেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Sep 14, 2025
img

পাপিয়া

আমরা কি বাংলাদেশে রোহিঙ্গা! Sep 14, 2025
img
সিলেটের ডিসি সারওয়ার আলমকে শোকজ Sep 14, 2025
img
পড়ার সুযোগ পেয়েও যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারছেন না হাজার হাজার শিক্ষার্থী Sep 14, 2025
img
দীর্ঘ নয় বছর পর শিবচরে কমিটি ঘোষণা করলো বিএনপি Sep 14, 2025
ব্যাপক অভিযানে সৌদিতে গ্রেপ্তার ২১ হাজারেরও বেশি প্রবাসী Sep 14, 2025
img
৬ বিভাগে ভারি বর্ষণের সতর্কতা জারি, পাহাড়ি এলাকায় পাহাড়ধসের শঙ্কা Sep 14, 2025
img
নাইজেরিয়ায় বিয়ের বাস নদীতে পড়ে প্রাণ গেল ১৯ জনের Sep 14, 2025
img
রানীরা কাউকে অনুসরণ করে না : অপু বিশ্বাস Sep 14, 2025
img
খুনি হাসিনার এমন বিচার হবে, পৃথিবীর সব স্ট্যান্ডার্ড আইন তা মেনে নেবে : সারজিস আলম Sep 14, 2025
img
বিএনপি আজ হোক কাল পিআর সিস্টেমে নির্বাচন দাবি করবে : ফয়জুল করীম Sep 14, 2025
img
দুনিয়ার যে কোনো আদালতে সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব: চিফ প্রসিকিউটর Sep 14, 2025
img
বন্ড-পুঁজিবাজারকে ব্যবহার করে দীর্ঘমেয়াদি অর্থায়নের উদ্যোগ Sep 14, 2025
img
মিয়ানমার থেকে আসা ২ লাখ ৪০ হাজার মাদক দ্রব্য জব্দ Sep 14, 2025
নবীজির ওহীর ঘটনা | ইসলামিক জ্ঞান Sep 14, 2025
img
মা-বাবার কবরে চিরনিদ্রায় শায়িত হলেন ফরিদা পারভীন Sep 14, 2025
রণবীরের জীবনে একমাত্র প্রেমিকা ছিল দীপিকা, দাবি নীতু কাপুরের Sep 14, 2025
লিটনদের একমাত্র পথ: আফগানিস্তানকে হারানো Sep 14, 2025