সিনিয়র সাংবাদিক মোস্তফা ফিরোজ বলেন, ‘জুলাই সনদ বাস্তবায়ন নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মতবিরোধে জটিলতা তৈরি হয়েছে। গণভোট কবে হবে—এই প্রশ্নে কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় ঝুলে গেছে সনদের চূড়ান্ত রূপরেখা। এখন এই অচলাবস্থা কাটানোর দায়িত্ব পড়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাঁধে। তিনি কি পারবেন রাজনৈতিক ঐক্যের এই ভাঙন রুখে দিতে?’
শুক্রবার (১০ অক্টোবর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে মোস্তফা ফিরোজ এসব কথা বলেন।
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার একটি কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছে। সেই চ্যালেঞ্জটি হলো—জুলাই সনদ বাস্তবায়নের অংশ হিসেবে যে গণভোটের কথা বলা হয়েছে, সেটি কবে অনুষ্ঠিত হবে তা নিয়ে মতবিরোধ। জামায়াত ও এনসিপি বলছে, গণভোটটি নির্বাচনের আগে হওয়া উচিত; আর বিএনপি বলছে, নির্বাচন ও গণভোট একসাথে হওয়া উচিত। এখন প্রশ্ন হলো, এই মতদ্বৈততার সমাধান সরকার কীভাবে করবে? ঐক্যমত কমিশন বলছে, যেহেতু রাজনৈতিক দলগুলো একমত হতে পারেনি, তাই তারা সব দলের মতামত নিয়ে সরকারের কাছে বিকল্প কয়েকটি সুপারিশ পেশ করবে।
এরপর সরকার সেই সুপারিশগুলোর ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত নেবে। এখন, সেই সিদ্ধান্তে বিএনপি ক্ষুব্ধ হতে পারে—আবার জামায়াত ও এনসিপিও অসন্তুষ্ট হতে পারে। ফলে সরকার পড়েছে এক কঠিন পরীক্ষার মুখে।
মোস্তফা ফিরোজ আরো বলেন, সরকার চেয়েছিল, ঐক্যমত কমিশনের মাধ্যমে সবকিছু নিষ্পত্তি হয়ে আসুক, তারপর সরকার জাতির উদ্দেশে একটি সুন্দর ভাষণ দেবে—ধন্যবাদ ও শুভেচ্ছা জানাবে সবাইকে।
কিন্তু সেটি আর সম্ভব হলো না। এখন মূল দায় এবং জটিলতার ভার গিয়ে পড়েছে সরকারের কাঁধেই।
তিনি বলেন, ‘সরকার সব পক্ষকে সন্তুষ্ট রাখতে পারবে কি না—এ নিয়ে আমার যথেষ্ট সন্দেহ আছে। কারণ, ইতিমধ্যেই এনসিপি কোনো এক কারণে সরকারের প্রতি বেশ নেগেটিভ হয়ে গেছে। তারা উপদেষ্টাদের ‘সেফ এক্সিট’, ‘বিশ্বাসভঙ্গ’, ‘আখের গোছানো’—এরকম নানা অভিযোগ তুলে সমালোচনায় নেমেছে। এর মধ্য দিয়ে তারা সরকারের প্রতি একেবারেই নেতিবাচক অবস্থানে চলে গেছে।’
তিনি আরো বলেন, ‘বর্তমানে সরকারের প্রতি সবচেয়ে ইতিবাচক অবস্থানে আছে বিএনপি, এরপর জামায়াত। কিন্তু এনসিপি সম্পূর্ণভাবে বিরাগভাজন হয়ে আছে। হয়তো তারা তাদের ‘শাপলা’ প্রতীকের বিষয়টি এখনো নিষ্পত্তি করতে পারেনি—সেই কারণেই নিবন্ধনও পায়নি। ফলে প্রশ্ন হচ্ছে, তারা এখন কী অবস্থান নেবে? আর সরকার তাদের কতটা প্রাধান্য দেবে? সম্ভবত, প্রাধান্য না পাওয়ার কারণেই এনসিপির মধ্যে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে।’
বল এখন সরকারের কোর্টে। অথচ সরকার এতদিন রাজনৈতিক দলগুলোর দিকে তাকিয়ে ছিল। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপটে রাজনৈতিক দলগুলো এখন সরকারের দিকে তাকিয়ে আছে। এদিকে কমিশন জানিয়েছে, আগামী বুধবার (১৫ অক্টোবর) জুলাই জাতীয় সনদ স্বাক্ষর হবে। জুলাই সনদের স্বাক্ষর ছাড়াও কমিশনের পক্ষ থেকে আগামী ১৮-১৯ অক্টোবরের মধ্যে একটি পূর্ণাঙ্গ প্রতিবেদন প্রকাশ করা হবে। কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজ বলেছেন, জাতীয় ঐক্যের মাধ্যমে ফ্যাসিবাদের পরাজয় সবচেয়ে বড় অর্জন। এই ঐক্য অক্ষুণ্ন রাখার কোনো বিকল্প নেই। এ ছাড়া দলগুলোকে এক জায়গায় আনা সরকার ও কমিশনের জন্য বিরাট সাফল্য মনে করেন বিশ্লেষক।
এরই মধ্যে ছয়টি সংস্কার কমিশনের ৮৪টি সংস্কার প্রস্তাব নিয়ে জুলাই জাতীয় সনদের চূড়ান্ত খসড়া প্রস্তুত হয়েছে। তবে সনদের বাস্তবায়ন পদ্ধতি নিয়ে ঐকমত্য হয়নি। এ কারণে ঝুলে যায় জুলাই সনদ প্রণয়ন। সনদ বাস্তবায়নের উপায় ঠিক করতে ঐকমত্য কমিশন বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক বৈঠক করেছে। এর পাশাপাশি কমিশন গত ১১ সেপ্টেম্বর থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা শুরু করে।
গত বুধবার পর্যন্ত মোট পাঁচ দিন দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছে কমিশন। এর মধ্যে গত রবিবার (৫ অক্টোবর) জুলাই জাতীয় সনদ বাস্তবায়নের জন্য জনগণের সম্মতি নিতে গণভোট আয়োজনের বিষয়ে দলগুলো ঐকমত্য হয়। কিন্তু গণভোট কবে ও কীসের ভিত্তিতে হবে, ভিন্নমতের প্রস্তাবগুলোর কী হবে—এগুলো নিয়ে দলগুলোর মধ্যে মতভিন্নতা ছিল। এমন অবস্থায় গত বুধবার বিকেল ৩টার দিকে দলগুলোর সঙ্গে মুলতবি আলোচনা শুরু করে জাতীয় ঐকমত্য কমিশন। শুরুতে কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ দলগুলোকে গণভোটের সময় ও পথ-পদ্ধতি নিয়ে সুনির্দিষ্ট মতামত দেওয়ার আহ্বান জানান। তবে দীর্ঘ আলোচনায় দলগুলো কমবেশি আগের অবস্থানই তুলে ধরে। ফলে শেষ পর্যন্ত ঐকমত্য হয়নি।
মোস্তফা ফিরোজ বলেন, গণভোট কবে হবে—এ নিয়ে এখনো মতভেদ রয়ে গেছে। কেউ কেউ মনে করছেন, যদি রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাব অনুযায়ী গণভোট নির্বাচনের আগে হয়, তাহলে সেটার প্রভাব জাতীয় নির্বাচনে পড়তে পারে। আবার অনেকে মনে করছেন, যদি একই দিনে নির্বাচন ও গণভোট অনুষ্ঠিত হয়, তাহলে গণভোটের গুরুত্ব কমে যাবে। এই মতপার্থক্য দূর করার দায়িত্ব এখন মূলত ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ওপরই পড়েছে। বলা যায়, পুরো বিষয়টির ভার এখন তার কাঁধে। তাকেই সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলে একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছাতে হবে। যদি তিনি তা সফলভাবে করতে পারেন, তাহলে সেটি রাজনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা হবে; আর ব্যর্থ হলে, সেটি রাজনীতির জন্য এক নেতিবাচক সংকেত বয়ে আনবে।
কেএন/টিকে