চীন-যুক্তরাষ্ট্র পাল্টা-পাল্টি পদক্ষেপ, বাণিজ্য যুদ্ধে নতুন মোড়

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন উভয়ই সমুদ্রগামী শিপিং সংস্থাগুলোর ওপর অতিরিক্ত বন্দর ফি নেওয়া শুরু করেছে। খেলনা থেকে শুরু করে অপরিশোধিত তেল পর্যন্ত সবকিছু বহন করে এসব সংস্থা। এর ফলে বিশ্বের দুই বৃহত্তম অর্থনীতির মধ্যে বাণিজ্য যুদ্ধের একটি প্রধান ক্ষেত্র হয়ে উঠেছে সমুদ্রপথ ।

গত সপ্তাহে, চীন যখন বিরল মৃত্তিকা রপ্তানি নিয়ন্ত্রণের একটি বড় সম্প্রসারণের ঘোষণা করে এবং মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প চীনা পণ্যের ওপর শুল্ক তিনগুণ পর্যন্ত বাড়ানোর হুমকি দেন, তখন সর্বাত্মক বাণিজ্য যুদ্ধ আসন্ন বলে মনে হয়েছিল।

তবে সপ্তাহান্তে, উভয় পক্ষই তাদের আলোচক দলগুলোর মধ্যে সহযোগিতা এবং একটি সমাধানের পথ খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনা তুলে ধরে ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে।

চীন জানিয়েছে, তারা মার্কিন মালিকানাধীন, পরিচালিত, নির্মিত বা পতাকাযুক্ত জাহাজগুলোর ওপর বিশেষ চার্জ নেওয়া শুরু করেছে। তবে তারা স্পষ্ট করে দিয়েছে যে, চীনা-নির্মিত জাহাজগুলো এই শুল্ক থেকে মুক্ত থাকবে।

রাষ্ট্রীয় সম্প্রচার মাধ্যম সিসিটিভি জানায়, চীন ছাড়ের জন্য নির্দিষ্ট বিধানগুলো বিশদভাবে বর্ণনা করেছে, যার মধ্যে মেরামতের জন্য চীনা শিপইয়ার্ডে প্রবেশকারী খালি জাহাজগুলিও অন্তর্ভুক্ত।

মার্কিন পরিকল্পনার মতোই, চীন-আরোপিত এই নতুন ফিগুলো একটি একক যাত্রার জন্য বা এক বছরের মধ্যে প্রথম পাঁচটি যাত্রার জন্য প্রথম প্রবেশ বন্দরে সংগ্রহ করা হবে।

অ্যাথেন্স-ভিত্তিক এক্সক্লুসিভ শিপব্রোকার্স নামের একটি গবেষণা নোটে বলা হয়েছে, “এই পাল্টা-পাল্টি সমতা উভয় অর্থনীতিকে একটি সামুদ্রিক কর আরোপের আবর্তে আটকে দিয়েছে, যা বৈশ্বিক পণ্য পরিবহনের বিচ্যুতি ঘটাতে পারে।”

শুরু থেকে পাল্টা আক্রমণ
এ বছরের শুরুতে ট্রাম্প প্রশাসন চীনের বৈশ্বিক সামুদ্রিক শিল্পে একচেটিয়া কর্তৃত্ব কমাতে এবং মার্কিন জাহাজ নির্মাণকে শক্তিশালী করতে চীন-সম্পর্কিত জাহাজগুলির ওপর ফি আরোপের পরিকল্পনা ঘোষণা করে।

সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন-এর প্রশাসনের সময় একটি তদন্ত এই সিদ্ধান্তে পৌঁছেছিল যে, চীন বৈশ্বিক সামুদ্রিক, লজিস্টিকস এবং জাহাজ নির্মাণ খাতে প্রভাব বিস্তার করার জন্য অন্যায্য নীতি এবং অনুশীলন ব্যবহার করে, যা এই শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগুলোর পথ পরিষ্কার করে।

গত সপ্তাহে চীন পাল্টা জবাব দেয় এবং ঘোষণা করে যে, মার্কিন ফি যে দিন থেকে কার্যকর হবে, সেই দিন থেকেই তারা মার্কিন-সম্পর্কিত জাহাজগুলির ওপর নিজস্ব বন্দর ফি আরোপ করবে।

স্বাধীন ড্রাই বাল্ক শিপিং বিশ্লেষক এড ফিনলে-রিচার্ডসন বলেন, “আমরা বিঘ্নতার উত্তাল পর্যায়ে আছি, যেখানে সবাই চুপিসারে বিভিন্ন মাত্রার সাফল্যের সঙ্গে কাজ চালানোর চেষ্টা করছে।” তিনি জানান, তিনি এমন খবর শুনেছেন যে, চীনা নয় এমন জাহাজের মার্কিন জাহাজ মালিকরা তাদের কার্গোগুলি (পণ্যবাহী মাল) যাওয়ার পথেই অন্যান্য দেশের কাছে বিক্রি করার চেষ্টা করছেন, যাতে জাহাজগুলি দিক পরিবর্তন করতে পারে।

পাল্টা-পাল্টি পদক্ষেপ

বিশ্লেষকরা আশা করছেন, চীন-মালিকানাধীন কন্টেইনার ক্যারিয়ার কসকো মার্কিন ফি দ্বারা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যা ২০২৬ সালে এই খাতের প্রত্যাশিত ৩.২ বিলিয়ন ডলার ব্যয়ের প্রায় অর্ধেক বহন করবে।

মার্স্ক, হাপাগ-লয়েড এবং সিএমএ সিজিএম এর মতো প্রধান কন্টেইনার লাইনগুলি তাদের মার্কিন শিপিং রুট থেকে চীন-সম্পর্কিত জাহাজগুলি সরিয়ে তাদের ঝুঁকি কমিয়েছে। কৃষি, জ্বালানি এবং মার্কিন শিপিং শিল্প থেকে প্রবল আপত্তির পরে বাণিজ্য কর্মকর্তারা প্রাথমিকভাবে প্রস্তাবিত স্তর থেকে ফি কমিয়েছেন এবং বিপুল সংখ্যক জাহাজকে ছাড় দিয়েছেন।

মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধির কার্যালয় (ইউএসটিআর) রয়টার্সের মন্তব্যের অনুরোধে তাৎক্ষণিকভাবে সাড়া দেয়নি।

চীনের বাণিজ্যমন্ত্রী মঙ্গলবার জানিয়েছে, “যদি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সংঘাত বেছে নেয়, তবে চীন শেষ পর্যন্ত তা চালিয়ে যাবে; যদি তারা আলোচনা বেছে নেয়, তবে চীনের দরজা খোলা আছে।”
একটি সম্পর্কিত পদক্ষেপে বেইজিং মঙ্গলবার দক্ষিণ কোরিয়ার জাহাজ নির্মাণকারী সংস্থা হানহা ওশান -এর পাঁচটি মার্কিন-সম্পর্কিত সহায়ক সংস্থার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে। চীন বলেছে, এই সংস্থাগুলি চীনা বাণিজ্য অনুশীলন সংক্রান্ত মার্কিন তদন্তকে সাহায্য ও সমর্থন করেছে।

বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ জাহাজ নির্মাণকারী হানহা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফিলি শিপইয়ার্ড এর মালিক এবং মার্কিন নৌবাহিনীর জাহাজ মেরামত ও সংস্কারের চুক্তি জিতেছে। এর প্রতিষ্ঠানগুলি একটি মার্কিন-পতাকাযুক্ত এলএনজি ক্যারিয়ারও তৈরি করবে।

হানহা জানিয়েছে, তারা ঘোষণাটি সম্পর্কে অবগত এবং সম্ভাব্য ব্যবসায়িক প্রভাব নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। হানহা ওশানের শেয়ার প্রায় ৬ শতাংশ কমে গেছে।

চীন তার শিপিং এবং জাহাজ নির্মাণ শিল্পে মার্কিন তদন্ত কীভাবে প্রভাবিত করেছে তা নিয়েও একটি তদন্ত শুরু করেছে।

সাংহাই-ভিত্তিক একজন বাণিজ্য পরামর্শক বলেছেন যে নতুন ফিগুলি উল্লেখযোগ্য অস্থিরতা সৃষ্টি নাও করতে পারে।

এই পরামর্শক রয়টার্সকে নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, “আমরা কী করতে যাচ্ছি? শিপিং বন্ধ করে দেব? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাণিজ্য এমনিতেই বেশ বিঘ্নিত, কিন্তু কোম্পানিগুলি একটি পথ খুঁজে নিচ্ছে।”

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র গত শুক্রবার ইথেন এবং তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাস (এলপিজি) বহনকারী চীন-পরিচালিত জাহাজগুলির দীর্ঘমেয়াদি চার্টারারদের জন্য একটি বিশেষ ছাড় ঘোষণা করেছে, তাদের জন্য পোর্ট ফি ডিসেম্বর ১০ পর্যন্ত স্থগিত করেছে।

এদিকে, জাহাজ ট্র্যাকিং সংস্থা ভর্টেক্সা ৪৫টি এলপিজি বহনকারী ভিএলজিসি চিহ্নিত করেছে, যা চীনের পোর্ট ফির আওতায় আসবে। এটি মোট ফ্লিটের ১১ শতাংশ।

ক্লার্কসনস রিসার্চ একটি প্রতিবেদনে বলেছে, চীনের নতুন পোর্ট ফি বিশ্বব্যাপী ট্যাঙ্কার ক্ষমতার ১৫ শতাংশ তেলের ট্যাঙ্কারগুলিকে প্রভাবিত করতে পারে।

এদিকে, জেফরিজর বিশ্লেষক ওমর নকটা অনুমান করেছেন, বিশ্বব্যাপী ফ্লিটের ১৩ শতাংশ অপরিশোধিত তেলের ট্যাঙ্কার এবং ১১ শতাংশ কন্টেইনার জাহাজ এই ফি দ্বারা প্রভাবিত হবে।

বাণিজ্য যুদ্ধ পরিবেশ নীতিকে গ্রাস করছে

গুরুত্বপূর্ণ খনিজগুলির রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ করার জন্য চীনের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ হিসাবে, ট্রাম্প শুক্রবার চীন থেকে আসা পণ্যগুলির ওপর অতিরিক্ত ১০০ শতাংশ শুল্ক আরোপের হুমকি দিয়েছেন এবং ১ নভেম্বরের মধ্যে “যে কোনো এবং সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সফটওয়্যারের” ওপর নতুন রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ আরোপের কথা বলেছেন।

এর কয়েক ঘণ্টা পরে, প্রশাসনের কর্মকর্তারা সতর্ক করে দেন যে এই সপ্তাহে সমুদ্রগামী শিপিং থেকে পরিবেশ উষ্ণকারী গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন কমানোর জন্য জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক সামুদ্রিক সংস্থা (আইএমও)-এর একটি পরিকল্পনার পক্ষে ভোট দেওয়া দেশগুলিকে নিষেধাজ্ঞা, বন্দর নিষেধাজ্ঞা বা শাস্তিমূলক জাহাজ চার্জের সম্মুখীন হতে হতে পারে।

চীন প্রকাশ্যে আইএমও-এর এই পরিকল্পনাকে সমর্থন করেছে।
অ্যাথেন্স-ভিত্তিক এক্সক্লুসিভ জানিয়েছে, “বাণিজ্য এবং পরিবেশ নীতি উভয়কেই অস্ত্রে পরিণত করা এই ইঙ্গিত দেয় যে, শিপিং বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি নিরপেক্ষ পথ থেকে সরে এসে রাষ্ট্রীয় কৌশলের একটি সরাসরি উপকরণে পরিণত হয়েছে।”

সূত্র: আল জাজিরা

ইএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img

নারী ক্রিকেট

হারের পর জরিমানাও গুনলো ভারত Oct 15, 2025
img
চাকসু নির্বাচন নিয়ে অহিংস শিক্ষার্থী ঐক্য প্যানেলের ৮ অভিযোগ Oct 15, 2025
img
জাল টাকার প্রচলন রোধে বাংলাদেশ ব্যাংকের সতর্কবার্তা Oct 15, 2025
img
ট্রাম্পের মুখে শান্তির কথা মানায় না: ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী Oct 15, 2025
img
বিএনপিকে বিবেচনায় নিন, এইটা আমার শেষ ভোট: ফখরুল Oct 15, 2025
img
৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ Oct 15, 2025
img
রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জরুরি বৈঠকে ঐকমত্য কমিশন Oct 15, 2025
img
খুলনা-কুষ্টিয়া মহাসড়ক সংস্কারের দাবিতে ইবি শিক্ষার্থীদের অবরোধ Oct 15, 2025
img
আগামী অ্যাশেজে অস্ট্রেলিয়ায় সেঞ্চুরি করতে প্রস্তুত জো রুট Oct 15, 2025
img
তিন গোয়েন্দার জনক রকিব হাসান আর নেই Oct 15, 2025
img
পাটব্যাগ চালু করতে শত কোটি টাকার ফান্ড নিয়ে কাজ করছে সরকার : বাণিজ্য উপদেষ্টা Oct 15, 2025
img
অন্যের বস্তায় আম ভরে জামায়াতের আত্মতৃপ্ত রাজনীতি : রনি Oct 15, 2025
img
রাকসু ভোটের আগের দিন ক্যাম্পাসে ক্রিকেট উৎসব Oct 15, 2025
img
চাকসু নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়াল এক প্যানেল Oct 15, 2025
img
নারায়ণগঞ্জকে মুক্তির জায়গা হিসেবে দেখতে চাই : আসিফ নজরুল Oct 15, 2025
img
মানুষ বোঝে এক ভোট এক প্রার্থী: মির্জা ফখরুল Oct 15, 2025
img
শিক্ষার্থীদের উচ্ছ্বাস দেখে গায়ের ঘাম শুকিয়ে গেছে : চবি উপাচার্য Oct 15, 2025
img
মিরপুরে গার্মেন্টস ও কেমিক্যাল গুদামের মালিকের হদিস মিলছে না Oct 15, 2025
img
অস্ট্রেলিয়া সিরিজে দলে জায়গা না পেয়ে শামির মন্তব্য Oct 15, 2025
img
সাবেক এমপি কবিরুল হক মুক্তি কারাগারে Oct 15, 2025