ইসলামপুরে ৩টি পরিবারের সঙ্গে প্রতিবেশীদের মেলামেশা বন্ধ

জামালপুরের ইসলামপুর পৌরসভার উত্তর দরিয়াবাদ গ্রামে বসবাস করেন শিরিনা আক্তার। ৩২ বছর বয়সী এই নারীর উচ্চতা মাত্র ৩০ ইঞ্চি। মেরুদণ্ড বাঁকা, পিঠের ওপর বিশাল কুজো আর মুখভর্তি লম্বা দাড়ি তার। প্রথম দেখায় যে কেউ তাকে পুরুষ ভেবে ভুল করতে পারে।

মুখভর্তি লোম নিয়েই জন্ম হয় শিরিনা আক্তারের। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তার শারীরিক উচ্চতা তেমন না বাড়লেও মুখের লোম বেড়ে দাড়িতে রূপান্তরিত হয়। কয়েক বছর আগে নেত্রকোনার এক ছেলের সাথে বিয়ে হয় শিরিনার। সংসারে একটি সন্তানও আছে। কিন্ত স্বামী শিরিনাকে আর তার বাবার বাড়ি থেকে নিজ বাড়িতে নিয়ে যাচ্ছেন না। আর্থিক সংকট আর সামাজিকভাবে বিড়ম্বনার শিকার হয়ে বাবার বাড়িতে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন এই নারী।

শুধু শিরিনা আক্তার নয়, তিনটি পরিবারে নারী-পুরুষ মিলিয়ে ১২ জন সদস্যের মুখজুড়ে লম্বা লোম নিয়ে কষ্ট আর বিরম্বনার মধ্যে জীবনযাপন করছে তারা। বংশগতভাবে এসব পরিবারের সদস্যরা মুখ এবং শরীরে লম্বা লোম নিয়ে কষ্ট করলেও অর্থের অভাবে চিকিৎসা করাতে পারছেন না। তাদের দুই পরিবারের মানুষের মুখ ভর্তি লোম আর অস্বাভাবিক শারীরিক গঠনের জন্য প্রতিনিয়তই সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হতে হয়।

তাদের শরীরজুড়ে অধিক পরিমাণে লোম থাকায় প্রতিবেশীদের কেউ তাদের সঙ্গে মিশতে চায় না। বিপত্তি ঘটে বিবাহ বন্ধনেও। তাদের সন্তানদের সঙ্গে অন্য শিশুরা খেলতে চায় না। অন্যের বাড়িতে কাজ করতে গেলেও তাদের কাজে নিতে চায় না। আবার বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে গেলেও তাদের বৈষম্যের শিকার হতে হয়।

তিন পরিবারের ১২ জন হলো- উত্তর দরিয়াবাদ গ্রামের সিরাজ শেখের মেয়ে শিরিনা বেগম (৩২), তার স্ত্রী কমিলা বেগম (৬৫), ছেলে করিম শেখ (৪২) তছির উদ্দিনের ছেলে জোনাব আলী (৫০), জোনাব আলীর মেয়ে আলিয়া (৮), জুলেখা আক্তার (২২), আকরাম (১৭), নজরুল (২৫), তাজমীন (১২), মমতাজ মন্ডল (৫৫), তার ছেলে আকাশ মন্ডল (১৭) ও আছাদ মন্ডল (২২)। এদের মধ্যে কয়েকজন বাড়িতে থাকলেও বাকিরা ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকায় কাজ করেন।

শিরিনার বাবা সিরাজ শেখ মারা যাওয়ার পর বাড়তে থাকে পরিবারের অভাব অনটন। অভাবের সংসারে যেখানে দুই বেলা খাবার জুটে না সেখানে চিকিৎসা করানোটা অসাধ্য হয়ে পড়ে তাদের। একই অবস্থা কমিলা বেওয়া, ভাই করিম শেখ, চাচা জোনাব আলী মন্ডলসহ তিন পরিবারের ১২ সদসস্যের।

শিরিনা আক্তার বলেন, আমার সারা শরীরে লোম। ঘর থেকে বের হলে এলাকার মানুষ কাছে আসতে চায় না, মিশতে চায় না, ভয় পায়। কয়েক বছর আগের শুধু একটা প্রতিবন্ধী কার্ড আছে। সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্টে দিন পার করছি। সরকার যদি কোনো অনুদান দেয় তাহলে চলতে পারবো।

শিরিনার মা কমিলা বেগম বলেন, আমার বাবার এ রকম লোম ছিল। আমাদের অনেক আর্থিক সমস্যা। অন্যের জমিতে থাকি। মানুষের সাথে মিশতে পারি না। সামাজিক কোনো অনুষ্ঠানে গেলে আমাদের অবহেলা করে।

আমার মেয়েটাকে মানুষ বেশি অবহেলা করে। তাকে বিয়ে দিছি কিন্ত জামাই নিয়ে যায় না।

জোনাব আলী জানান, আমার ঘরে ছয় সন্তানের মধ্যে ৫জনের শরীরেই আমার মতো এরকম লোম। সরকারের পক্ষ থেকে কোন সহায়তা পায়নি। মানুষের কাছে গেলে তাড়ায়ে দেয়। ছেলেদের বিবাহ করাবো তাও পারতেছিনা লোমের কারনে। না পাই কাজ করে খেতে, না পাই সামাজিক মর্জাদা। খুবই সমস্যার মধ্যে আছি।

জোনাব আলীর স্ত্রী নুরেজা বেগম বলেন, আমার ভাইয়েরা তার সঙ্গে বিয়ে দিছে। এখন আমার বাবা-মা অবহেলা করে। কাছে আসতে চায় না। আবার লোম থাকায় কেউ কাজেও নিতে চায় না। সংসারে অভাব লেগেই থাকে। এক সন্তান ছাড়া সবারই শরীরে লোম।

জোনাব আলীর চাচাতো বোন জমিলা বেগম বলেন, আমার দাদার থেকে এ রকম লোম শুরু হইছে। আবার কিছু মানুষের লোম এ রকম না। এদের শরীরে লোম থাকায় মানুষ অবহেলা করে। তাদের কাজে নিতে চায় না। বাচ্চাদের স্কুলে ভর্তি করতে চায় না। খুব সমস্যা।

প্রতিবেশী সফিউল্লাহ বলেন, এরা খুবই অসহায় পরিবার। তাদের পরিবারে দুটি মেয়ে আছে তাদের কেউ বিবাহ করতে চায় না। সরকারের পক্ষ থেকে সহায়তা করতে তাদের জন্য অনেক উপকার হয়।

ইসলামপুর উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা মো. রুহুল আমিন দেশের একটি গণমাধ্যমকে জানান, ওই পরিবারের কয়েকজন অফিসে এসেছিলেন তাদের প্রতিবন্ধী কার্ড করে দেওয়া হয়েছে। যারা বাকি রয়েছে তারা অফিসে এলে কার্ড করে দেওয়া হবে।

ইসলামপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) মো. তৌহিদুর রহমান দেশের একটি গণমাধ্যমকে বলেন, উনাদের বিষয়টি বংশগত। কয়েকজনকে ইতোমধ্যে প্রতিবন্ধী ভাতার ব্যবস্থা করা হয়েছে। তাদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তার বিষয়ে উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
এবার জামায়াতের বিরুদ্ধে নাহিদের তোপ : মাসুদ কামাল Oct 20, 2025
img
চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে : বিএনপি Oct 20, 2025
img
জবি ছাত্রদল নেতা জুবায়েদের খুনিদের গ্রেপ্তার দাবিতে বংশাল থানা ঘেরাও Oct 20, 2025
img
চট্টগ্রামে মধ্যরাতে বহুতল ভবনে আগুন Oct 20, 2025
img
জুলাই সনদের আইনি ভিত্তি না হলে ওই সনদ কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে : জুমা Oct 20, 2025
img
নিজের এক্স প্রোফাইল থেকে পিএসএল টিমের নাম মুছে ফেললেন রশিদ Oct 20, 2025
img
বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক Oct 20, 2025
img
জুলাই সনদে যারা সই করেছে তারা এই দেশকে ধারণ করে না : হান্নান মাসউদ Oct 20, 2025
img
রিশাদকে নিয়ে নান্নুর মন্তব্যে Oct 19, 2025
img
তিনি যা বানাচ্ছেন তা কেউ কখনো করেননি : রণবীর সিং Oct 19, 2025
img
প্রয়োজন শেষে রূপ বদলালেন ড. ইউনূস : জিল্লুর রহমান Oct 19, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টির আভাস Oct 19, 2025
img
চাকসুতে নির্বাচিতদের শপথ গ্রহণের সম্ভাব্য সময় বৃহস্পতিবার! Oct 19, 2025
img
৪৯তম বিশেষ বিসিএসের ফল প্রকাশ, উত্তীর্ণ ১২১৯ জন Oct 19, 2025
img
জয়া আহসান এখন শুধু একটি নাম নয়, ব্র্যান্ড! Oct 19, 2025
img
যুদ্ধবিরতির পর গাজায় ইসরায়েলি হামলায় প্রাণ গেল ৫১ জনের , আহত অন্তত ১৫০ Oct 19, 2025
img
নতুন বাড়িভাড়া গ্রহণ করে শিক্ষকরা ক্লাসে ফিরে যাবেন: প্রত্যাশা শিক্ষা উপদেষ্টার Oct 19, 2025
সকাল বরকত পূর্ণ করার ৫টি উপায় | ইসলামিক টিপস Oct 19, 2025
দীর্ঘ বিরতির পর শূণ্য রানে ফিরলেন কোহলি Oct 19, 2025
পূর্ণিমা সতর্ক করেছেন, সব মানুষ বিশ্বাস করার যোগ্য নয়! Oct 19, 2025