আসামে বহুবিবাহ নিষিদ্ধের নতুন আইন নিয়ে রাজ্যজুড়ে বিতর্ক

আসামের মুখ্যমন্ত্রী হিমন্ত বিশ্বশর্মা রোববার গৌহাটিতে রাজ্য মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর ঘোষণা করেছেন, রাজ্যে বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করতে একটি নতুন আইন আনা হচ্ছে।

তার বক্তব্য অনুযায়ী, এই প্রস্তাবিত আইন বহুবিবাহকে দণ্ডনীয় অপরাধ হিসেবে গণ্য করবে এবং সর্বাধিক সাত বছরের কারাদণ্ডের বিধান থাকবে। একই সঙ্গে ভুক্তভোগী নারীর ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থাও রাখা হয়েছে। তবে এই ঘোষণার পরই রাজ্যজুড়ে প্রশ্ন উঠেছে- আসলে এই আইন সমতা আনার জন্য, নাকি বিভাজন গভীর করার জন্য?

বিশ্বশর্মা স্পষ্ট করে জানিয়েছেন, এই আইনটি আসামের তফসিলি উপজাতি (ST) সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না এবং রাজ্যের ছয়টি নির্ধারিত উপজাতি এলাকায়ও তা অবিলম্বে কার্যকর হবে না। তার কথায়, ‘এটি সবাইকে প্রযোজ্য হবে, তবে আদিবাসীদের জন্য নয়।’

 আরও বলা হয়েছে, ২০০৫ সালের আগে যেসব সংখ্যালঘু মুসলমান বাসিন্দা ওই নির্ধারিত এলাকায় বসবাস করছেন, তারাও এই আইনের আওতার বাইরে থাকবেন। ফলে এই ব্যতিক্রমী ধারা নিয়ে সমাজের বিভিন্ন অংশে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে।

আইনটি আপাতদৃষ্টিতে নারী অধিকার ও সামাজিক সংস্কারের নামে উপস্থাপিত হলেও, সমালোচকদের মতে, এর অন্তর্নিহিত উদ্দেশ্য অন্যত্র। আসামে বহুদিন ধরেই ধর্মভিত্তিক জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রশ্ন রাজনীতির কেন্দ্রে।

বিশ্বশর্মা এদিনও ২০০১ থেকে ২০১১ সালের জনগণনা উদ্ধৃত করে বলেন, হিন্দু জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার কমেছে, অথচ মুসলমান জনসংখ্যা বিভিন্ন ব্লকে বেড়েছে। ফলে নতুন এই আইনকে জনসংখ্যা-নিয়ন্ত্রণের ছদ্মবেশে রাজনৈতিক বার্তা দেওয়ার চেষ্টা হিসেবে দেখছেন অনেকে।

বিশ্লেষকদের মতে, সরকার যে ছাড়ের বিধান রেখেছে তা আসলে আইনকে দুর্বল করে দিয়েছে এবং প্রশাসনিক প্রয়োগে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করবে। কেন একজন নাগরিকের জন্য আইন একরকম, আরেকজনের জন্য অন্যরকম হবে-এই প্রশ্নই এখন আলোচনার কেন্দ্রে।

বিশেষ করে যখন মুখ্যমন্ত্রী নিজেই বলেছেন এটি `সবার জন্য আইন', তখন নির্দিষ্ট গোষ্ঠীকে ছাড় দেওয়া কতটা সাংবিধানিক, সে নিয়েও সংশয় দেখা দিয়েছে।

আসাম সরকার দাবি করছে, এটি ‘সামাজিক শুদ্ধিকরণ’-এর অংশ, কিন্তু মানবাধিকার সংগঠনগুলো বলছে, সরকার আসলে নির্দিষ্ট ধর্মীয় গোষ্ঠীর ওপর নজরদারি জোরদার করতে চাইছে।
তাদের মতে, আইনটি বাস্তবায়িত হলে তা পারিবারিক বিষয়ে সরকারের অতিরিক্ত হস্তক্ষেপের নজির তৈরি করবে এবং ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিসর সংকুচিত করবে।

বিশ্বশর্মা এদিন আরও বলেছেন, রাজ্যে অস্ত্র লাইসেন্স অনুমোদন প্রক্রিয়া শুরু হবে ফেব্রুয়ারির মধ্যে এবং জমি বিক্রির উপর নতুন নিয়ন্ত্রণ চালু হবে। প্রশাসনিক এই পদক্ষেপগুলিকে কেন্দ্র করে তার বক্তব্যে একধরনের কঠোর রাষ্ট্রনীতির ইঙ্গিত স্পষ্ট হয়েছে- যা অনেকেই মনে করছেন উত্তর-পূর্বাঞ্চলে একধরনের নতুন রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তুলছে।

রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, এই বিলটি শুধুমাত্র বহুবিবাহ নিষিদ্ধ করার নয়, বরং সামাজিক মানচিত্র পুনর্লিখনের প্রচেষ্টা। আইনের পেছনে থাকা সংখ্যাতত্ত্ব ও নির্বাচনী রাজনীতির প্রভাব অস্বীকার করা যাচ্ছে না। আসামে জনসংখ্যা ভারসাম্যের প্রশ্নে এই পদক্ষেপের প্রভাব ভবিষ্যতে রাজ্য রাজনীতির গতি নির্ধারণ করতে পারে।

মানবাধিকারকর্মীরা সতর্ক করেছেন- এমন আইন বাস্তবায়নের ফলে একদিকে সমাজে অবিশ্বাস বাড়বে, অন্যদিকে আইন প্রয়োগকারী সংস্থার ক্ষমতা সীমা অতিক্রমের আশঙ্কা থাকবে।
তারা বলছেন, ‘নারীর অধিকার রক্ষার নাম করে যদি সরকার নাগরিকদের ধর্ম বা জাতিগত পরিচয়ে ভাগ করে দেয়, তাহলে তা আসলে ন্যায়বিচার নয়, বৈষম্য।’

আসামের নতুন আইন তাই এখন একাধিক স্তরে বিতর্কের জন্ম দিয়েছে- এটি কি সামাজিক সংস্কারের পথে এক ধাপ এগোনো, নাকি বৈষম্যমূলক রাজনীতির নতুন অধ্যায়? উত্তর খুঁজছে আসামের সাধারণ মানুষ, এবং নজর এখন রাজ্যপালের সিলমোহরের দিকে।

টিজে/টিকে


Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেখে নিন বিপিএলের দলগুলোর অধিনায়কের নাম Dec 25, 2025
img
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন গণতন্ত্রে আস্থা ও বিশ্বাসকে আরো সুদৃঢ় করবে : মাহফুজ আলম Dec 25, 2025
img
তারেক রহমানের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনে জিএম কাদেরের শুভেচ্ছা Dec 25, 2025
img
তারেক রহমানের প্রত্যাবর্তন বহুদলীয় গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে : হাসনাত Dec 25, 2025
img
অভিনেতা দেবের জন্মদিন আজ Dec 25, 2025
img
তারেক রহমানের আগমন ঘিরে স্মৃতিসৌধে বাড়তি প্রস্তুতি Dec 25, 2025
img
৯ জানুয়ারি ঢাকায় ইসলামী আন্দোলনের মহাসমাবেশ Dec 25, 2025
img
নরসিংদীতে কৃষক লীগের সাধারণ সম্পাদক গ্রেপ্তার Dec 25, 2025
img
কপিল শর্মার অনুষ্ঠানে কেন অনুপস্থিত স্মৃতি? Dec 25, 2025
img
গুজরাটের সুরাটে ১০ তলা থেকে পড়ে গিয়েও বেঁচে গেলেন এক ব্যাক্তি! Dec 25, 2025
তারেক রহমানকে নিয়ে যে বার্তা দিলেন মিজানুর রহমান ও জামায়াত আমীর Dec 25, 2025
img
সালথায় আ.লীগ ছাড়লেন ২ নেতা Dec 25, 2025
img
শীত নিয়ে ঢাকাসহ সারাদেশের জন্য দুঃসংবাদ আবহাওয়া অফিসের Dec 25, 2025
img
দিনাজপুরে নতুন ভোটার ১ লাখ ৫৫ হাজার ১৮ জন Dec 25, 2025
img
কুমার শানুর ৫০ কোটি টাকার মানহানির মামলায় মুখ খুললেন রীতা Dec 25, 2025
img
মেসির মতো বিশ্বকাপ জিতুক রোনালদো : ফ্রাঙ্ক লেবোফ Dec 25, 2025
img
রজনীকান্তের জেলার ২-তে দেখা দেবেন শাহরুখ খান Dec 25, 2025
মেহরিন হয়ে গেল কেয়ার নতুন পরিচয়! Dec 25, 2025
img
জামায়াতের জোটে থাকছে না চরমোনাই পীর Dec 25, 2025
img
নাইম শেখের পারিশ্রমিক নিয়ে শঙ্কা, আশ্বাস দিল বিপিএল গভর্নিং কাউন্সিল Dec 25, 2025