চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল এবং ঢাকার কাছে পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের দায়িত্ব দীর্ঘ মেয়াদে বিদেশি দুই প্রতিষ্ঠানের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে। গতকাল সোমবার ঢাকার ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল মিলনায়তনে দুটি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করা হয়েছে।
পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনাল আগামী ২২ বছর পরিচালনা করবে সুইজারল্যান্ডভিত্তিক বিশ্বখ্যাত লজিস্টিক প্রতিষ্ঠান মেডলগ। এ লক্ষ্যে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ও মেডলগের স্থানীয় প্রতিষ্ঠান মেডলগ বাংলাদেশ প্রাইভেট লিমিটেডের মধ্যে কনসেশন চুক্তি সই হয়।
চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান এবং মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম আনিসুল মিল্লাত নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানের পক্ষে চুক্তিতে সই করেন। অনুষ্ঠানে সরকার ও মেডলগের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
ঢাকা-মাওয়া-ভাঙ্গা এক্সপ্রেসওয়ে থেকে অল্প দূরত্বে বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত পানগাঁও টার্মিনাল। এটিকে দেশের অভ্যন্তরীণ পণ্য পরিবহনের কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এই চুক্তি বিশেষ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করছে একটি পক্ষ।
মেডলগ তাদের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে টার্মিনালের বার্ষিক পণ্য সামলানোর ক্ষমতা এক লাখ ৬০ হাজার কনটেইনারে উন্নীত করার পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি বার্জ, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও বিশেষায়িত যানবাহনের মাধ্যমে মাল্টিমোডাল পরিবহন জোরদার করবে বলেও জানিয়েছে। এতে আমদানি-রপ্তানি পণ্যের পরিবহন সময় কমবে এবং সরবরাহ শৃঙ্খল আরো শক্তিশালী হবে। মেডলগ বাংলাদেশের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এ টি এম আনিসুল মিল্লাত বলেন, ‘পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির গতি বৃদ্ধি এবং লজিস্টিক দক্ষতার ক্ষেত্রে নতুন মান গড়ে তোলার অপরিসীম সম্ভাবনা রাখে।
মেডলগের বিশ্বব্যাপী দক্ষতা কাজে লাগিয়ে এবং আমাদের কৌশলগত পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জন করতে পারব এবং অভ্যন্তরীণ লজিস্টিকের ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে এই অঞ্চলের শীর্ষস্থানে নিয়ে যেতে পারব।’
অন্যদিকে একই দিনে দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিদেশি বিনিয়োগ নিশ্চিত হলো চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল প্রকল্পে। ডেনমার্কভিত্তিক এপিএম টার্মিনালস ৩০ বছর মেয়াদি কনসেশন চুক্তিতে নিজস্ব অর্থায়নে এই টার্মিনাল নির্মাণ ও পরিচালনার দায়িত্ব পেয়েছে। মোট ৫৫০ মিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের এই প্রকল্প দেশের অন্যতম বৃহৎ সরকারি-বেসরকারি অংশীদারি উদ্যোগ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ এপিএম টার্মিনাল এবং তাদের স্থানীয় অংশীদার কিউএনএস কনটেইনার সার্ভিসেসকে চুক্তির চিঠি প্রদান করে।
অনুষ্ঠানে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এস এম মনিরুজ্জামান বলেন, ‘এখনই আমাদের সর্বোচ্চ দক্ষতা ও ধারণক্ষমতা বৃদ্ধির প্রয়োজন। চট্টগ্রাম একটি নদী ও ফিডার বন্দর হওয়ায় লজিস্টিকস (যানবাহনের) খরচ অনেক বেশি। প্রতিযোগিতামূলক হতে হলে আমাদের এমন অবকাঠামোর প্রয়োজন, যা দ্রুত বাজারে পৌঁছার সুযোগ করে দেয়। এই টার্মিনাল সেই লক্ষ্য পূরণে সহায়ক হবে।’ নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে অবকাঠামোগত সীমাবদ্ধতা ও জটিলতা চট্টগ্রাম বন্দরের সম্ভাবনার পথে প্রতিবন্ধক হিসেবে কাজ করেছে। লালদিয়া টার্মিনাল নির্মাণের মাধ্যমে বড় জাহাজ ভেড়ানোর সুযোগ তৈরি হবে এবং রপ্তানিকারকদের জন্য বন্দরসেবা আরো নির্ভরযোগ্য হবে। মেয়ার্স্কের মতো অভিজ্ঞ অপারেটরের আগমন আমাদের দৈনন্দিন সমস্যাগুলোর বাস্তব সমাধানে সহায়তা করবে।’
পিপিপি কর্তৃপক্ষের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (প্রতিমন্ত্রী মর্যাদা) আশিক চৌধুরী বলেন, ‘এই প্রকল্প প্রমাণ করে যে বাংলাদেশে পিপিপি এখন কাগজে-কলমে নয়, বাস্তবে রূপ নিচ্ছে। আমরা একটি বিশ্বমানের টার্মিনাল ও পোর্ট পেতে যাচ্ছি এবং এর জন্য সরকারকে কোনো ঋণ নিতে হয়নি। লালদিয়া টার্মিনাল চালু হলে চট্টগ্রাম বন্দরের পণ্য হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৪৪ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি পাবে।’
এপিএম টার্মিনালস চট্টগ্রামের লালদিয়া কনটেইনার টার্মিনাল বাস্তবায়নে ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করছে, যা বাংলাদেশের ইতিহাসে এককভাবে সবচেয়ে বড় ইউরোপীয় ইকুইটি এফডিআই এবং অন্যতম বৃহৎ পিপিপি প্রকল্প। কনসেশন মেয়াদে মোট বিনিয়োগ ৮০০ মিলিয়ন ডলার ছাড়াতে পারে। প্রকল্পে সরকারের কোনো ঋণঝুঁকি থাকছে না। টার্মিনাল চালু হলে বছরে আট লাখ টিইইউ অতিরিক্ত হ্যান্ডলিং সক্ষমতা তৈরি হবে এবং সিপিএ রাজস্ব ভাগাভাগির মাধ্যমে সরাসরি আয় পাবে।
অন্যদিকে সুইস কম্পানি মেডলগ পানগাঁও অভ্যন্তরীণ কনটেইনার টার্মিনালের (পিআইসিটি) জন্য ২২ বছরের কনসেশন চুক্তির অধীনে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ও আধুনিক প্রযুক্তি নিয়ে আসছে। টার্মিনালের বার্ষিক হ্যান্ডলিং সক্ষমতা এক লাখ ৬০ হাজার টিইইউতে উন্নীত হবে।
এবি/টিকে