নিকুঞ্জে মাদকের ভয়াবহ দাপট : ধ্বংসের পথে তরুণ প্রজন্ম

দিনের আলোয় রাজধানীর নিকুঞ্জ যেন পরিচিত, নিরাপদ আর শান্ত এক আবাসিক এলাকা। শিশুদের স্কুলে যাওয়া, অফিসগামী মানুষের ব্যস্ততা, সন্ধ্যায় পরিবারের হাঁটাহাঁটি-সবকিছুই বাহ্যত স্বাভাবিক। কিন্তু এই চেনা দৃশ্যপটের আড়ালেই গড়ে উঠেছে এক ভয়ংকর অদৃশ্য সাম্রাজ্য। রাত নামলেই নিকুঞ্জের অলিগলি, খালি জায়গা, ভাসমান দোকান ও নির্জন কোণে সক্রিয় হয়ে ওঠে মাদকের কালো কারবার। প্রকাশ্যেই চলে সেবন ও কেনাবেচা-যা এলাকাবাসীর কাছে এখন আর গোপন নয়, বরং এক ধরনের ‘ওপেন সিক্রেট’।

একসময় যে নিকুঞ্জ ছিল শান্তিপূর্ণ বসবাসের প্রতীক, আজ সেখানে মাদকের সহজলভ্যতা তৈরি করেছে গভীর আতঙ্ক ও সামাজিক অস্থিরতা। লাগামহীন এই মাদক আগ্রাসনে ধীরে ধীরে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে এলাকার কিশোর ও তরুণ প্রজন্মকে। নেশার জালে আটকে যাচ্ছে সম্ভাবনাময় জীবন, ভেঙে পড়ছে পরিবার, আর সমাজে বাড়ছে অপরাধের ভয়াবহতা। স্থানীয়দের মতে, মাদকই আজ নিকুঞ্জ এলাকার অধিকাংশ অপরাধের মূল জ্বালানি।

চুরি, ছিনতাই, রাহাজানি থেকে শুরু করে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা-সবকিছুর পেছনেই ঘুরেফিরে আসছে মাদকের নাম। নিকুঞ্জের টানপাড়া, জামতলা, পশ্চিমপাড়া, সরকারবাড়ি ও পুরাতন বাজার এলাকাজুড়ে মাদকসেবীদের অবাধ বিচরণ এখন নিত্যদিনের চিত্র। মাদকসেবীরা নেশার অর্থ জোগাড় করতে অপরাধে জড়িয়ে পড়ছে-এমন অভিযোগ আর কেবল ধারণার পর্যায়ে নেই; বরং এটি এলাকাবাসীর প্রতিদিনের বাস্তব অভিজ্ঞতা।



ইতিহাস বলে, একটি জাতির সবচেয়ে বড় শক্তি তার তরুণ সমাজ। রাষ্ট্রের অগ্রযাত্রা, সামাজিক পরিবর্তন কিংবা মুক্তির প্রতিটি অধ্যায়ে তরুণদের ভূমিকা ছিল অনস্বীকার্য। অথচ আজ সেই তরুণ সমাজই মাদকের আগ্রাসনে দিশেহারা।

নিকুঞ্জের মতো একটি আবাসিক এলাকায় যখন তরুণরা মাদক ব্যবসার হাতিয়ার কিংবা নিয়মিত সেবনে জড়িয়ে পড়ছে, তখন তা শুধু একটি এলাকার সমস্যা নয়-এটি ভবিষ্যৎ প্রজন্ম ও সামাজিক নিরাপত্তার জন্য ভয়াবহ অশনিসংকেত।

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, নিকুঞ্জ এলাকায় অন্তত এক ডজনের বেশি স্থানে প্রকাশ্যে মাদক কেনাবেচা ও সেবন চলছে। এর মধ্যে রয়েছে-টানপাড়া পশ্চিমপাড়া রোডের নজরুলের মেছ, পশ্চিমপাড়ার শেষ মাথা, জামতলা মসজিদের মেছ সংলগ্ন খালি জায়গা, জামতলা আলীজানের টেক, আইজ্জার বস্তি, এটিএনের খালি জায়গা ও তার চারপাশ, জামতলা পিলার খায়েরের বাড়ির পূর্ব পাশ সংলগ্ন খালি জায়গা, পেট্রোবাংলা সংলগ্ন বিএনপি অফিসের আশপাশ, ১৮ নম্বর রোডের পশ্চিম পাশ, জানে আলম স্কুলের পশ্চিম পাশ সংলগ্ন রাস্তা, বিআরটিসির সামনে ভাসমান দোকানগুলো এবং নিকুঞ্জ-২-এর ১৩ থেকে ১৭ নম্বর রোডের পূর্ব পাশ। এসব এলাকায় দিনের নির্দিষ্ট সময়ের পর মাদকসেবীদের আনাগোনা প্রকাশ্য রূপ নেয়।

এলাকাবাসীর অভিযোগ, ৫ আগস্ট পরবর্তী সময়ে নিকুঞ্জে মাদকের বিস্তার কয়েকগুণ বেড়ে গেছে। দ্রুত অর্থ উপার্জনের লোভে অনেক ভালো ও সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান পর্যন্ত এই অবৈধ কারবারে জড়িয়ে পড়ছে। প্রশাসনের কার্যকর নজরদারি ও গোয়েন্দা তৎপরতার অভাবে মাদক ব্যবসায়ীরা আরও সংগঠিত ও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে বলেও অভিযোগ উঠেছে।

অনুসন্ধানে উঠে এসেছে, কিছু মাদক কারবারি রাজনৈতিক সাইনবোর্ড ব্যবহার করে নিজেদের আড়াল করছে। যুবদলের নাম ব্যবহার করে নূর হোসেন লাল তার ভাই বাবুলকে দিয়ে প্রকাশ্যে মাদক ব্যবসা করাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে।

একইভাবে স্বেচ্ছাসেবক দলের নাম ভাঙিয়ে একাধিক মামলার আসামি মোফাবাবু তার ভাই জিসানকে দিয়ে বিভিন্ন ধরনের মাদক বিক্রি করছে বলে স্থানীয়রা জানায়। অটোরিকশা নিয়ন্ত্রণে প্রভাবশালী হিসেবে পরিচিত তোফাজ্জল হোসেন বাবুর্চির ছেলে দেলোয়ারের নামও মাদক বিক্রেতাদের তালিকায় উঠে এসেছে।

এছাড়া টানপাড়ার মুসলিম কাঁচা বাজার সংলগ্ন নবী হোসেন ও সবুজ, মধ্যপাড়ার কাঠমিস্ত্রি রিপন, আইজ্জার বস্তির খোরশেদ ও আসিফ এবং জামতলায় দীর্ঘদিন ধরে মাদক ব্যবসায় জড়িত মানিকের নামও এলাকাবাসীর কাছে পরিচিত।

স্থানীয়দের ভাষ্য, এদের বিরুদ্ধে সামাজিকভাবে বিভিন্ন সময় প্রতিবাদ ও উদ্যোগ নেওয়া হলেও কার্যকর ফল আসেনি। থানা পুলিশের পক্ষ থেকে নেওয়া কিছু উদ্যোগকে অনেকেই লোকদেখানো বা আইওয়াশ হিসেবে দেখছেন।

বর্তমান পরিস্থিতিতে এলাকাবাসীর জোর দাবি-নিকুঞ্জে মাদক ব্যবসায়ীদের উৎপাত বন্ধ করতে এখনই বিশেষ ও ধারাবাহিক অভিযান চালাতে হবে। শুধু অভিযান নয়, প্রয়োজন নিয়মিত টহল, গোপন নজরদারি, চিহ্নিত হটস্পটে স্থায়ী ব্যবস্থা এবং যুব সমাজকে সম্পৃক্ত করে সামাজিক প্রতিরোধ গড়ে তোলা।

এ বিষয়ে খিলক্ষেত থানার নবাগত ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ আব্দুল আলিম বলেন, মাদকের বিরুদ্ধে খিলক্ষেত থানা পুলিশ জিরো টলারেন্স নীতিতে কাজ করছে। কোনো ধরনের ছাড় দেওয়া হবে না। তিনি আরও বলেন, মাদকের আগ্রাসন থেকে যুব সমাজকে রক্ষা করা পুলিশের অঙ্গীকার। মাদক সংক্রান্ত যে কোনো তথ্য সরাসরি জানালে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুষ্ঠু বিকাশের স্বার্থে শুধু নিকুঞ্জ নয়, পুরো জাতিকেই মাদকের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। নৈতিক শিক্ষা, মানবিক মূল্যবোধ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ হয়ে যুবসমাজ যেন সমাজ ও দেশের কল্যাণে এগিয়ে আসে-সেই লক্ষ্যেই পুলিশ নিয়মিত কাজ করে যাচ্ছে বলেও জানান তিনি।

নিকুঞ্জবাসীর প্রত্যাশা-এই আশ্বাস যেন শুধু বক্তব্যে সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং দ্রুত মাঠপর্যায়ে দৃশ্যমান ও কার্যকর অভিযানের মাধ্যমে মাদকের কালো থাবা থেকে রক্ষা পাক একটি প্রজন্ম এবং একটি এলাকা।

টিকে/

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে রাষ্ট্রপতির শ্রদ্ধা নিবেদন Dec 16, 2025
img
জাতীয় স্মৃতিসৌধে প্রধান উপদেষ্টার শ্রদ্ধা নিবেদন Dec 16, 2025
img
দেশের বাজারে আজ থেকে বাড়তি দামেই বিক্রি হবে স্বর্ণ Dec 16, 2025
img
শেষরাতে পাকিস্তান বিরোধী স্লোগানে উত্তাল জবি Dec 16, 2025
img
বাংলাদেশকে নিয়ে সেমিফাইনালে শ্রীলঙ্কা Dec 16, 2025
img
সেনবাগ ছাত্রদলের আহবায়ক মোহাম্মদ সানাউল্লাহ বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার Dec 16, 2025
img
বিজয়ের দিন দেশে ফিরবেন ভারতে বন্দি ৮ বাংলাদেশি Dec 16, 2025
img
প্রবাসী ভোটার নিবন্ধন চার লাখ ২০ হাজার ছাড়াল Dec 16, 2025
img
রাতেই ২ সতীর্থকে নিয়ে জামনগরে মেসি, অম্বানির আমন্ত্রণে সফর সূচি বদল Dec 16, 2025
img
শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইনের মেয়ে কুমিল্লায় আটক Dec 16, 2025
img

সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সচিব

প্রথাগত শিক্ষার পাশাপাশি স্কিল ডেভেলপের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে Dec 16, 2025
img
বিজয় দিবস উপলক্ষে আজ ৪০ মিনিট বন্ধ থাকবে মেট্রোরেল Dec 16, 2025
৭২ এর সংবিধান দিয়ে যা করেছে আ.লীগ! Dec 16, 2025
রাজশাহীতে বিএনপি নেতাকর্মীরা বিজয় দিবসে শপথ বাক্য পাঠ করলেন Dec 16, 2025
ভারত যেভাবে বাংলাদেশ সঙ্গে যুদ্ধ ঘোষণা করলো? Dec 16, 2025
জুলাই পরবর্তী লড়াই কতটুকু সফল হলো? Dec 16, 2025
img
মেসি-কাণ্ডে মুখ খুললেন শুভশ্রী Dec 16, 2025
আসন্ন নির্বাচন শুধুমাত্র ভোটের বিষয় নয়-দেশের সার্বভৌমত্ব জড়িত: তারেক রহমান Dec 16, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Dec 16, 2025
img
নির্বাচনি প্রচারণা নিয়ে নেতাকর্মীদের সুখবর দিলেন তারেক রহমান Dec 16, 2025