নবাবজাদা’দের বাংলাদেশে যাওয়া

করোনাভাইরাসের মহামারির এই সময়ে সারাবিশ্বের মতো বাংলাদেশের মানুষও অনেক উদ্বিগ্ন। কিন্তু এই উদ্বেগের সর্বোচ্চটা মনে হয় প্রবাসীদের দেশে ফেরা নিয়েই। অন্তত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সাম্প্রতিক সময়ে সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হলো প্রবাসীদের দেশে ফেরা। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, প্রবাসীরাই যেন এই রোগ দেশে মহামারি আকারে ছড়িয়ে দিবে, কিছু বিজ্ঞ আর অজ্ঞের কথা এমনটাই মনে হচ্ছে। কিন্তু প্রবাসীদের কথাটা কি একবারও ভেবে দেখেছেন? আসলে এই সময়ে তাদের দেশে না যেয়েও কোন উপায় নেই।

আসুন, কারণগুলো খুঁজে দেখি, কি কারণে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী দেশে যাচ্ছে। ইউরোপ, মধ্যপ্রাচ্য বা আমেরিকাতে যতো বাংলাদেশিরা বাস করেন তাদের বিপুল সংখ্যকই শ্রমজীবী। তাদের মজুরি ঘণ্টা হিসেবে। অর্থাৎ যত ঘণ্টা কাজ ততোতুটুই আয়। কাজ নেই, আয়ও নেই। ইউরোপে ব্রিটেন আর আয়ারল্যান্ড ছাড়া ইতালি, ফ্রান্স, স্পেন, পর্তুগাল আর জার্মানিতেই বেশির ভাগ বাংলাদেশির বাস। ওই দেশগুলোর বর্তমান অবস্থা পুরোই অবরুদ্ধ । যারা সেই সব দেশগুলোতে ভালো চাকুরি করে, তাদের কথা আলাদা। কিন্তু রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি শপসহ অন্য যেসব যায়গায় তারা দৈনিক মজুরি বা ঘণ্টা ভিত্তিক মজুরিতে কাজ করেন তাদের অবস্থা কি ভেবে দেখেছেন? সরকার হয়তো খাবার দিবে, কিন্তু বাড়ি ভাড়াসহ অন্যান্য খরচ মিটাবেন কিভাবে? যারা ট্যাক্সি চালান, তাদের অবস্থাও সঙ্গীন। গাড়িই বের করতে পারছেন না, লিজ মানি উঠানো তো দূরের কথা।

আমি যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে থাকি। এখানকার পরিস্থিতি ব্যাখ্যা করলে আপনারা বুঝতে পারবেন। সরকারি তথ্য মতে, শুধু নিউইয়র্ক সিটিতেই ৭০ হাজারের বেশি বাংলাদেশির বাস। নিউইয়র্কের ট্যাক্সি ওয়ার্কাস এসোসিয়শনের তথ্য মতে, ইয়েলো ক্যাব, উবার, লিফ্ট ও বিভিন্ন কার কোম্পানিতে ৫০ হাজার বাংলাদেশি ড্রাইভার আছে। এই সংগঠনটির ভাইস প্রেসিডেন্ট টিপু সুলতান জানিয়েছেন, “করোনা ভাইরাসের প্রকোপের কারণে নিউইয়র্ক স্টেটে জরুরি অবস্থা জারির পর থেকেই ক্যাবিদের আয় চার ভাগের এক ভাগে নেমে এসেছে। একটি ইয়েলো ক্যাবের সপ্তাহে লিজ মানি এক হাজার ডলার। যাত্রী নেই, আয় নেই, কোথা থেকে দিবে এতো টাকা। এরই মধ্যে হাজারের বেশি ক্যাবি তাদের গাড়ি কোম্পানিগুলোতে জমা দিয়েছে। অবস্থা এই রকম চলতে থাকলে ২৫ হাজারের বেশি ক্যাবিকে বেকার হয়ে যেতে হবে।”

টিপু সুলতানের তথ্যে দেয়া সংখ্যা থেকে আমি অর্ধেকই ধরে নিলাম, অর্থাৎ ১২ হাজার প্রবাসী বাংলাদেশি যদি যুক্তরাষ্ট্রে আয়বিহীন হয়ে পড়েন, তাহলে তারা কই যাবেন? নিজ দেশে যাওয়া ছাড়া তো গতি নেই।

এছাড়াও রেস্টুরেন্ট, গ্রোসারি শপ, সুপার মার্কেটসহ বিভিন্ন জায়গায় দৈনিক ও ঘণ্টা ভিত্তিতে কাজ বেশির ভাগ মানুষই তাদের কাজ হারিয়েছেন কিংবা কর্ম ঘণ্টা কমিয়ে দিতে হয়েছে। এরই মধ্যে প্রশাসন থেকে ঘোষণা দেয়া হয়েছে মঙ্গলবার থেকে সব রেস্টুরেন্ট ও বার বন্ধ করে দিতে। সিটিতে স্কুল বন্ধ করে দেয়া হয়েছে আগামী ২০ এপ্রিল পর্যন্ত।

যুক্তরাষ্ট্রের মানুষ এমনিতেই হুজুগে বেশি। আর প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প পুরো আমেরিকা জুরে জরুরি অবস্থা জারির পর তো জনগণ হুমড়ি খেয়ে পড়ে ফুড স্টোরগুলোতে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, এখন আপনি কোন সুপার শপে গেলেও প্রয়োজনীয় খাদ্য সহজে পাবেন না। অন্তত টিস্যু ও টয়লেট পেপার আউট অব স্টক। আর হ্যান্ড সেনিটাইজার ও মাস্ক তো আরো এক সপ্তাহ আগে থেকেই মার্কেট আউট। আর আমাদের বাংলাদেশি সোসাইটি যুক্তরাষ্ট্রে এখনো আর্থিকভাবে এতোটা স্বাবলম্বী নয় যে কোন আয় ছাড়াই দ্বিগুণ কিংবা তিনগুণ দামে খাবার কিনে মাসের পর মাস খেতে পারবে। আবার ধরুন কেউ যদি পরিবারসহ নিউইয়র্ক সিটিতে বাসা ভাড়া করে থাকে তাহলেও তাকে মাসে অন্তত ১৮০০ থেকে দুই হাজার ডলার ভাড়া গুণতে হয়। এখন বলেন, আয়বিহীন এই মানুষগুলো কই যাবে? রোগে আক্রান্ত হলে না হয় সরকারের তরফ থেকে উন্নত চিকিৎসা পাবে। কিন্তু পেটের ক্ষুধা আর জীবন ধারণের ব্যয়টা মিটাবে কে?

ইউরোপ থেকে যখন একজন যাত্রী বাংলাদেশে যাচ্ছেন তাকে ওই দেশের বিমানবন্দরেই করোনা পজিটিভ কি না তার পরীক্ষা করা হয়। আন্তর্জাতিক কোন বিমান সংস্থাই করোনাভাইরাস আছে এমন সন্দেহভাজন কাউকে বহন করবে না, যাতে তাদের ব্যবসায়ী সুনাম নষ্ট হয়। আচ্ছা, দেশে ফিরলে প্রবাসীদের কোয়ারেন্টাইন করবেন ভালো কথা। কিন্তু সরকারি ব্যবস্থাপনাটা একটু উন্নত করলে কি হয়। হাজী ক্যাম্পের ব্যবস্থাপনা নিয়ে এক প্রবাসীর কিছু কটু কথা খুব ভাইরাল করলেন। কিন্তু তার বাচ্চা যে ২২ ঘণ্টা ধরে না খেয়ে ক্ষুধার জ্বালায় কান্না করছিলো সেটা দেখলেন না। করোনা থেকে বাঁচতে গিয়ে দেশে এসে হাজী ক্যাম্পের ডেঙ্গুর আস্তানায় মধ্যে তাদের ঢ়ুকিয়ে দিলেন।

এতো দিন যারা বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার পাঠিয়ে দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখলো, আপনাদের পদ্মা সেতু আর মেট্রোরেলে চড়ার ব্যবস্থা করলো, তাদের খারাপ সময়ে কটু কথা বলার আগে একটু ভেবে দেখবেন।

 

লেখক: যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী সাংবাদিক। 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কুমিল্লায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ Nov 16, 2025
img
পুলিশকে কামড়ে পালিয়েছেন ছাত্রদল নেতা Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনার রায় আগামীকাল, সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি Nov 16, 2025
img

বাংলাদেশ দূতাবাস, মানামা

বাহরাইন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্পের আয়োজন Nov 16, 2025
img
ভোটারদের কেন্দ্রে আনা ও নিরাপদ নির্বাচনি পরিবেশের জন্য দলগুলোর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ: সিইসি Nov 16, 2025
img
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে সবুজায়ন করবে ডিএনসিসি Nov 16, 2025
img
১৫০ কিমি গতিতে বোলিং করতে পারি: শাহীন আফ্রিদি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ এক পা এগোলে, পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে আসবে: মাওলানা ফজলুর Nov 16, 2025
img
যুক্তরাজ্যে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে সময় লাগবে ২০ বছর! Nov 16, 2025
img
যারা একসময় মজলুম ছিল, তারা এখন জালিম সাজছে: তথ্য উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
মিঠুনদা আমার বাবার মতো: দেব Nov 16, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই শাহরুখকে কিং করেছে: শিল্পা শেট্টি Nov 16, 2025
img
ইরান ভয়াবহ সংকটে, মসজিদে দোয়া Nov 16, 2025
img
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী আহত Nov 16, 2025
img
অনিয়মের প্রমাণ পায়নি বিসিবি Nov 16, 2025
img
বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ: সেলিমা রহমান Nov 16, 2025
img

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬টি দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শুরু Nov 16, 2025
img

মো. ফখরুল ইসলাম

‘তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে নোয়াখালী হবে সিঙ্গাপুর’ Nov 16, 2025
img
সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মধ্যরাতে আগুন Nov 16, 2025
img
স্কুলের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে আসি: সোনাক্ষী সিনহা Nov 16, 2025