কতটা স্বার্থপর হলে অপরকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া যায়?

সহজভাবে বলতে গেলে ‘কোয়ারেন্টাইন’ বলতে ‘বিচ্ছিন্ন থাকা’ বোঝায়। বিশ্বজুড়ে কোভিড-১৯ মহামারীর সময়ে সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- এই ‘কোয়ারেন্টাইন’ বা বিচ্ছিন্ন থাকা। এর একমাত্র উদ্দেশ্য এই প্রাণঘাতী রোগটির বিস্তার ঠেকানো। এটা নিয়ে বিদেশ ফেরত মানুষদের এতো অনীহা কেন? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পাওয়া সত্যিই কঠিন।

সম্প্রতি দেশে ফেরা প্রবাসীদের অধিকাংশ ব্যক্তিকে হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়েছে, হাতে গোনা কিছু লোককে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টাইনে রাখা হয়েছে। হোম-কোয়ারেন্টাইনে যাকে পাঠানো হচ্ছে, তিনি নিজের বাড়িতেই থাকবেন। শুধু অন্য সবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকবেন, যাতে করে তিনি সংক্রমিত হয়ে থাকলেও রোগটি অন্য কারো মাঝে না ছড়ায়। এটি অনেকেই মানছেন না, পরিবার-পরিজনের সঙ্গে অন্তরঙ্গ সময় কাটাচ্ছেন, হাটে-বাজারে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। হয়তো নিজের অজান্তেই রোগটি ছড়িয়ে দিচ্ছেন প্রিয়জনসহ আরও অনেকের মাঝে। কতটা স্বার্থপর হলে অপরকে এভাবে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া যায়?

বাংলাদেশে এই তো কিছুদিন আগেও কোভিড-১৯ রোগটির অস্তিত্ব ছিলনা। তারপর ইউরোপ-আমেরিকার সংক্রমিত দেশগুলি থেকে প্রবাসীরা দেশে ফিরলেন, অনেকেই কোয়ারেন্টাইন বা হোম কোয়ারেন্টাইনের ধার ধারলেন না। ইউরোপ-আমেরিকা ফেরত কয়েকজনের শরীরে কোভিড-১৯ শনাক্ত হলো, এদের অনেকেই এর আগে এখানে সেখানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। এদের অধিকাংশই আমাদের রেমিটেন্স যোদ্ধা, কিন্তু ভেবে দেখেন চন্দ্র বিজয় করে পৃথিবীতে ফিরে আসার পর নীল আর্মস্ট্রংদেরকেও তো কোয়ারেন্টাইনে থাকতে হয়েছিল। তাতে তাদের মর্যাদা কমেনি বরং বেড়েছে।

শনিবার পর্যন্ত বাংলাদেশে করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া দুই ব্যক্তির কেউ প্রবাসী নন, কিন্তু কোনো প্রবাসীর দ্বারা সংক্রামিত হয়েছেন। সব থেকে ভয়ের ব্যাপার হলো মিরপুরে করোনায় আক্রান্ত হয়ে মৃত ব্যক্তির পরিবারের কেউ বিদেশ ফেরত ছিলেন না। প্রথম থেকেই কোয়ারেন্টাইন বা হোম-কোয়ারেন্টাইন সঠিকভাবে মেনে চলা হলে হয়তো এইসব সংক্রমণ বা মৃত্যু ঠেকানো সম্ভব হতো। কিন্তু নূন্যতম আত্মসংযমের অভাবে রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে।

একজন আদর্শ নাগরিকের তিনটি প্রধান গুণ হলো- বুদ্ধি, বিবেক আর আত্মসংযম। এই তিন গুণের মধ্যে একটির উপস্থিতিতেও আপনি প্রয়োজনে কোয়ারেন্টাইন বা হোম কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বাধ্য হবেন। কতটা নির্বোধ, বিবেকহীন আর আত্মসংযমহীন হলে আমরা নিজেদের প্রিয়জনকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিতে পারি? এর জন্য কতটা অসচেতন হওয়া প্রয়োজন হয়? আপনি রাষ্ট্রযন্ত্র-ব্যবস্থা সবকিছু নিয়ে সমালোচনা করছেন, নাগরিক হিসেবে সেই অধিকারও আপনার আছে, সেই সঙ্গে আদর্শ নাগরিকের গুণাবলিও থাকা প্রয়োজন। অধিকারে সঙ্গে কর্তব্যের একটা অবিচ্ছিন্ন সম্পর্ক আছে।

মাত্র ১৪ দিনের কোয়ারেন্টাইন, মাত্র দুই সপ্তাহ নিঃসঙ্গ কাটাতে হবে, এতেই এতো অনীহা? বিদেশ থেকে ফিরেছেন মানেই আপনি সংক্রামিত হয়েছেন এমনটা নয়। আবার আপনার কোনো লক্ষণ দেখা দেয়নি, এর মানে কিন্তু এটাও নয় যে আপনি সংক্রমিত হননি। আমরা সবাই জানি, কোভিড-১৯ রোগটি ১৪ দিন পর্যন্ত মানবদেহে সুপ্ত অবস্থায় থাকতে পারে। তাই পরিবার-পরিজনের নিরাপত্তার খাতিরেই এই দু’সপ্তাহের বিচ্ছিন্ন জীবন মেনে নিতে হবে।

আপনাকে জেলবন্দী করা হচ্ছে না, পরিবার-পরিজন-সমাজের বৃহত্তর স্বার্থে আপনি নিজের ক্ষুদ্রতর স্বার্থ ত্যাগ করছেন। নিজে থেকেই সাবধানতা অবলম্বন করবেন, অপরকে নিজের সংস্পর্শে আসতে দেবেন না। এমনটাই হবার কথা ছিল, অথচ পরিস্থিতি সম্পূর্ণ বিপরীত; মানুষকে ঘরে তালাবন্ধ করে হোম-কোয়ারেন্টাইনে রাখা যাচ্ছে না, সন্দেহভাজন ব্যক্তিরা হাসপাতাল থেকেও পালিয়ে যাচ্ছেন!

এভাবে চলতে থাকলে কোভিড-১৯ রোগটির বিস্তার সীমিত রাখা সম্ভব হবে না। একজন, দুইজন করে মৃত্যু মিছিল বাড়তে থাকবে। আমাদের দেশের মতো জনবহুল একটা দেশে কোভিড-১৯ ব্যাপক বিস্তার লাভ করলে সেটা কতটা ভয়ানক হতে পারে আজকে হয়তো অনেকেই ভাবতে পারছি না। আজকে দুই সপ্তাহের জন্যে যারা হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকতে পারছেন না, সারাদেশ অনির্দিষ্টকালের জন্য লকডাউন করা হলে তখন কী করবেন?

স্যাটেলাইট-ইন্টারনেটের যুগে আমরা জেনে গেছি কোভিড-১৯ আক্রান্ত হলে সব থেকে বেশি মৃত্যুঝুঁকিতে থাকেন শিশু, বয়স্ক আর দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্তরা। তবে তরুণ-যুবাদের কেউ যে মারা যাচ্ছেন না এমনটা কিন্তু নয়, সময় থাকতে সাবধান হতে হবে। আপনি এই তালিকায় নেই বলে সব নিয়মকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ভাইরাস ছড়াতে সহায়তা করতে পারেন না। নূন্যতম বিবেকবোধ থাকলে আপনাকে ভাইরাসটির বিস্তারের বিরুদ্ধে দাঁড় করিয়ে দেবে।

সুতরাং ভাইরাসটির বিস্তার রোধের নিয়মগুলি মেনে চলা আমাদের সবার কর্তব্য। বিদেশ ফেরত হলে বা সর্দি-কাশির মতো কোনো উপসর্গ দেখা দিলে সঙ্গে সঙ্গে নিজেকে বিচ্ছিন্ন করুন। হোম-কোয়ারেন্টাইনে থাকুন, প্রয়োজনে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজে বাঁচুন, অপরকে বাঁচতে দিন।

হোম-কোয়ারেন্টাইন অবশ্যই কোনো মজার বিষয় নয়, আমি সেটা ভালো করেই জানি। সম্প্রতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে ফেরার পর আমিও স্ব-প্রণোদিত হয়ে হোম-কোয়ারেন্টাইনে আছি। তবে বিশ্বাস করুন, হোম-কোয়ারেন্টাইন ভয়ানক বিচ্ছিরি রকমের কোনো ব্যাপার নয়। বই পড়ে, গান শুনে, সিনেমা দেখে বা লেখালেখির মতো প্রিয় কাজগুলি করতে করতে দুই সপ্তাহ অনায়াসে পার করে দেয়া যাবে।

এখনো হয়তো খুব বেশি দেরি হয়ে যায়নি, এখনো হয়তো আরেকটু দায়িত্বশীল হলে এই মহামারীটি ঠেকিয়ে দেয়া সম্ভব। আশাকরি জাতি হিসেবে আমরা এখনো এতটা স্বার্থপর হয়ে যাইনি, যতটা স্বার্থপর হলে অপরকে নিজ দায়িত্বে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া যায়।

 

লেখক: তরুণ সাংবাদিক।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
চাঁদপুরে সরকারি চাল মজুতের দায়ে বিএনপি নেতাকে জরিমানা Sep 16, 2025
উত্তাল ফরিদপুর! থানা ও উপজেলা পরিষদে হামলা, অফিসার্স ক্লাবে আগুন Sep 16, 2025
আমি তুষার বলছি - বাংলাদেশকে এখানেই আসতে হবে Sep 16, 2025
এই যে ভণ্ডামি, প্রতারণা কেন করছেন আপনারা? Sep 16, 2025
তরুণদের সক্রিয়তায় সব সমস্যার সমাধান সম্ভব: প্রধান উপদেষ্টা Sep 16, 2025
অর্থ পাচার রোধে যে কঠোর নীতিতে হাঁটছে সরকার Sep 16, 2025
img
নুরের ওপর হামলাকারীদের বিচারের দাবিতে রাজধানীতে মশাল মিছিল Sep 16, 2025
img

ডিআইজি রেজাউল করিম

যারা ফ্যাসিস্ট তাদের আমরা আইনের আওতায় আনব Sep 16, 2025
img
আর্থিক সুবিধা নেওয়ায় কর কর্মকর্তা মাসুদুর রহমানকে বরখাস্ত Sep 16, 2025
img
পেলেকে ছাড়িয়ে রেকর্ড দামে বিক্রি হলো মেসির রুকি কার্ড Sep 16, 2025
img
জামায়াত আমিরের সঙ্গে শিল্প মালিক প্রতিনিধিদের সৌজন্য সাক্ষাৎ Sep 16, 2025
img
মিয়ানমারে অবৈধভাবে পণ্য পাচারের সময় ১১ জনকে আটক করেছে নৌবাহিনী Sep 16, 2025
img
চবিতে ‘হোস্টেল সংসদ’ নির্বাচনের ঘোষণা Sep 16, 2025
img
সাতক্ষীরা সীমান্তে ১৫ বাংলাদেশিকে বিজিবির কাছে হস্তান্তর করল বিএসএফ Sep 16, 2025
img
বিশ্ববাজারে ফের বাড়ল স্বর্ণের দাম Sep 16, 2025
img
দুই জয়ে ‘বি’ গ্রুপের শীর্ষে শ্রীলঙ্কা, খালি হাতে বিদায় নিল হংকং Sep 16, 2025
img
ভোজ্যতেল আমদানিতে ব্যয় বৃদ্ধি করল এনবিআর Sep 16, 2025
img
ইভ্যালি থেকে বেরিয়ে একই কৌশলে প্রতারণা, নারী গ্রেপ্তার Sep 16, 2025
img
এশিয়া কাপ জিতেনি বাংলাদেশ গুগোল করে নিশ্চিত হলেন ট্রট Sep 16, 2025
img
ড. ইউনূস ব্যর্থ হলে বাংলাদেশের স্বপ্ন বিনষ্ট হবে : রাশেদ খান Sep 16, 2025