ইরানের মিলিটারি স্যাটেলাইট ও মাল্টিপোলার বিশ্বব্যবস্থা

পরাশক্তিগুলো মহাকাশে মিলিটারি স্যাটেলাইট হয়ত হরহামেশাই পাঠাচ্ছে, কিন্তু এটা আর এমন কি এমনটাই হয়তো ভাবেন সামরিক বিশ্লেষকরা। পৃথিবীতে আর্থিকভাবে অবরুদ্ধ থাকা ইরানিরা গেল ২২ এপ্রিল মহাকাশে মিলিটারি স্যাটেলাইট পাঠিয়ে বিশ্বমোড়লদের চোখ তুলেছে কপালে। করোনা যুদ্ধে পুরো বিশ্ব যখন লকডাউন অবস্থায় আছে ঠিক তখনই ইরানের সবচেয়ে এলিট ফোর্স আইআরজিসি ভূপৃষ্ঠ হতে ৪৩০ কি.মি. উপরে সফলভাবে নূর-১ মিলিটারি স্যাটেলাইটটি স্থাপন করেছে, যা প্রতি ৯০ মিনিটে একবার পুরো পৃথিবী প্রদক্ষিণ করে সিগনাল পাঠাতে শুরু করেছে ইতোমধ্যে।

মিলিটারি স্যাটেলাইটটি কাশেদ নামক একটি মিসাইলের সাহায্যে দ্বিস্তর বিশিষ্ট লিকুইড-সলিড ফুয়েলের মাধ্যমে উৎক্ষেপণ করা হয়। ভূপৃষ্ঠের ৪৩০ কি.মি. উপরের অরবিটে অবস্থান করে এটি ইতোমধ্যে সিগনাল পাঠাতে শুরু করেছে বলে জানিয়েছে ইরান। এর সিগনাল রিসিভের জন্য ইরান তিনটি রিসিভার স্টেশন বসিয়েছে তাদের মাটিতে। এর নাম দেয়া হয়েছে নূর-১। কারণ বর্ধিত ক্ষমতার নূর-২ নামীয় আরো একটি মিলিটারি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের জন্য প্রস্তুত রয়েছে বলে জানিয়েছে আইআরজিসি।

জনাথন ম্যাকডাওয়েল নামে একজন স্যাটেলাইট বিশেষজ্ঞ জানিয়েছে, এই স্যাটেলাইটের মাধ্যমে গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহ করা, সিগনাল ইন্টেলিজেন্স, কমিউনিকেশন, অপারেশন প্ল্যানিং এর ক্ষেত্রে ইরান বহুদূর এগিয়ে যাবে যা পূর্বে কল্পনাতীত ছিল। পূর্বে ইসরায়েলের অভ্যন্তরে ইরানের পক্ষে যেখানে তথ্য সংগ্রহ করা অসম্ভব ছিল তা এখন সম্ভব হবে স্যাটেলাইটের মাধ্যমে। এমনকি বিশ্বের যেকোনো প্রান্তের উপগ্রহ ছবি তোলা সম্ভব হবে এর মাধ্যমে। তবে বলাই বাহুল্য ইসরায়েল থাকবে তাদের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে।

এর আগেও ইরানের স্পেস এজেন্সি চারটি স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ করেছিল মহাকাশে। কিন্তু মার্কিনীদের চোখে সন্ত্রাসী হিসেবে পরিগণিত আইআরজিসি যে মহাকাশ গবেষণায় এতোটা এগিয়েছে তা মার্কিন-ইসরায়েলিদেরও কখনো উল্লেখ করতে শোনা যায়নি। ইরানের এই স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণের ফলে সবচেয়ে বেশী মনঃক্ষুণ্ণ হয়েছে ট্রাম্প ও তার সহযোগীরা। ট্রাম্প জানিয়েছে, ইরানে কে কি করছে তা ইরানীদের চেয়েও বেশী তিনি জানেন এবং সম্প্রতি তিনি পারস্য উপসাগরে ইরানের গানবোটগুলিকে ধ্বংস করে দেয়ার জন্য আগাম নির্দেশ দিয়ে রেখেছেন তার নৌবাহিনীকে। মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী মাইক পম্পেও এটিকে জাতিসংঘের ২২৩১ নম্বর কার্যবিবরণীর বরখেলাপ ঘোষণা করে নিরাপত্তা পরিষদের মাধ্যমে ব্যবস্থা নেয়ার কথা বলেছেন।

জার্মানি ও যুক্তরাজ্য এই উৎক্ষেপণের জন্য উদ্বেগ প্রকাশ করেছে এবং মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতা এতে ব্যাহত হবে মর্মে বিবৃতি দিয়েছে। যদিও ইরান বলছে জার্মানি নিজেই দুদিন আগে আমেরিকার কাছে নিউক্লিয়ার বোমা নিক্ষেপণযোগ্য বিমান চেয়ে তাদের কপটতার বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। সুতরাং তাদের উদ্বেগ ভণ্ডামি ছাড়া আর কিছুই নয়। তবে এক্ষেত্রে ইসরায়েলি সামরিক বিশ্লেষকরা বোধ হয় এখনো এই স্যাটেলাইটের ঘোর কাটাতে পারেনি। কারণ ইসরায়েলি মিডিয়াগুলি বিরলভাবে এই খবর প্রকাশ থেকে বিরত থেকেছে। এমনিতেই ক্রমবর্ধমান ইরানের প্রযুক্তির বিকাশে উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন ইসরায়েলের জেনারেলরা।

ইরানের এই মিলিটারি স্যাটেলাইট মাল্টিপোলার এই পৃথিবীর ক্রমশ দূরে সরতে থাকা পোলগুলোকে আরো ভারসাম্যপূর্ণ করবে বলে মনে করছে রাশিয়ান বিশ্লেষকরা। সংঘাতপূর্ণ মধ্যপ্রাচ্যে এই স্যাটেলাইট ইরানের অবস্থানকে আরো সুদৃঢ় করবে এবং পুরো বিশ্বে রাশিয়া, চায়না ও ইরানের বলয়ে আরো রাষ্ট্রকে যোগ দিতে উৎসাহিত করবে। সিরিয়া, লেবানন ও প্যালেস্টাইনে তাদের প্রক্সি ফোর্সগুলোকে আরো সক্ষমভাবে অপারেশন পরিচালনার ক্ষেত্রে সাহায্য করবে। সোলেইমানির মৃত্যুতে তাদের যে ক্ষতি হয়েছে তা কিছুটা হলেও লাঘব করবে এই স্যাটেলাইট।

ইরানের মনোবল বৃদ্ধির ক্ষেত্রে স্যাটেলাইটটি একটি মাইলফলক হলেও মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের শত্রু দেশগুলিকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষ সাধনে হয় উৎসাহিত করবে। অন্যথায় আরো গভীরভাবে পশ্চিমা দেশগুলির উপর নির্ভরশীল করবে যা অচিরেই আরো জটিল করবে অস্ত্রের বেচাবিক্রি ও মধ্যপ্রাচ্যের তেলের ব্যবসা। মধ্যপ্রাচ্য হাজার বছর ধরেই ছিল সংঘাতময় আর একবিংশ শতাব্দীতে নতুনভাবে যোগ হয়েছে ইরান বনাম ইসরায়েলের দ্বৈরথ। ইসরায়েলের একমাত্র ভরসা মার্কিনীরা। কিন্তু ক্রমশ ক্ষয়িষ্ণু তাদের অর্থনীতি এবং অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক টানাপোড়েন তাদেরকে ইসরায়েলের হয়ে আরেকটি যুদ্ধের অবতারণা করা সত্যিই কঠিন হবে। ইরানের এই স্যাটেলাইট একটি সূচক মাত্র সামরিক বিবেচনায়, এর ফলে অদূর ভবিষ্যতে হানাহানি ঠেকাতে ইসরায়েল এবং ইরানকে একটি সমঝোতাপূর্ণ অবস্থানে আসতে দেখলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবেনা এই ঘটনার প্রেক্ষাপটে।

লেখক: সিনিয়র সহকারী সচিব,
গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
কুমিল্লায় নিষিদ্ধ ছাত্রলীগের ৪৪ নেতাকর্মীকে আটক করেছে পুলিশ Nov 16, 2025
img
পুলিশকে কামড়ে পালিয়েছেন ছাত্রদল নেতা Nov 16, 2025
img
শেখ হাসিনার রায় আগামীকাল, সরাসরি সম্প্রচার করবে বিটিভি Nov 16, 2025
img

বাংলাদেশ দূতাবাস, মানামা

বাহরাইন প্রবাসীদের জন্য বিশেষ সচেতনতামূলক মোবাইল কনস্যুলার ক্যাম্পের আয়োজন Nov 16, 2025
img
ভোটারদের কেন্দ্রে আনা ও নিরাপদ নির্বাচনি পরিবেশের জন্য দলগুলোর সহযোগিতা গুরুত্বপূর্ণ: সিইসি Nov 16, 2025
img
ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের নিচে সবুজায়ন করবে ডিএনসিসি Nov 16, 2025
img
১৫০ কিমি গতিতে বোলিং করতে পারি: শাহীন আফ্রিদি Nov 16, 2025
img
বাংলাদেশ এক পা এগোলে, পাকিস্তান দুই পা এগিয়ে আসবে: মাওলানা ফজলুর Nov 16, 2025
img
যুক্তরাজ্যে স্থায়ী নাগরিকত্ব পেতে সময় লাগবে ২০ বছর! Nov 16, 2025
img
যারা একসময় মজলুম ছিল, তারা এখন জালিম সাজছে: তথ্য উপদেষ্টা Nov 16, 2025
img
মিঠুনদা আমার বাবার মতো: দেব Nov 16, 2025
img
নিজের প্রতি বিশ্বাসই শাহরুখকে কিং করেছে: শিল্পা শেট্টি Nov 16, 2025
img
ইরান ভয়াবহ সংকটে, মসজিদে দোয়া Nov 16, 2025
img
রাজধানীর নিউ ইস্কাটনে ককটেল বিস্ফোরণে পথচারী আহত Nov 16, 2025
img
অনিয়মের প্রমাণ পায়নি বিসিবি Nov 16, 2025
img
বৈষম্য দূর করতে প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ: সেলিমা রহমান Nov 16, 2025
img

জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬টি দলের সঙ্গে ইসির সংলাপ শুরু Nov 16, 2025
img

মো. ফখরুল ইসলাম

‘তারেক রহমান প্রধানমন্ত্রী হলে নোয়াখালী হবে সিঙ্গাপুর’ Nov 16, 2025
img
সিলেট শহীদ শামসুদ্দিন হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্সে মধ্যরাতে আগুন Nov 16, 2025
img
স্কুলের গুরুত্ব তখনই বোঝা যায়, যখন আমরা স্কুল থেকে বেরিয়ে আসি: সোনাক্ষী সিনহা Nov 16, 2025