করোনায় কর্ম হারিয়ে শহিদুলদের জীবন চলছে যেমন

এরই নাম জীবনযুদ্ধ! একদিকে করোনার শঙ্কা, অন্যদিকে চাকরি হারিয়ে নতুন জীবিকা নির্বাহের মধ্য দিয়ে সংসার চালানোর প্রাণান্তকর চেষ্টা। লজ্জা, শঙ্কায় কেউ কেউ পরিবারকে জানাতেই পারছেন না, ঠিক কি উপায়ে রোজগার করছেন তিনি। বেঁচে থাকার তাগিদে কেউ হয়েছেন সবজি বিক্রেতা, কেউবা বসেছেন মৌসুমী ফলের ভ্রাম্যমাণ দোকান নিয়ে। কেউ যাত্রী টানছেন মোটর সাইকেলে।

ক্ষুধার জ্বালা মেটাতে বই খাতা ফেলে রিকশা নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন কোন কোন শিক্ষার্থী। কেউ করছেন ব্যবসা বদল। তাতেও কি শেষ রক্ষা হয়েছে? কারো বাসা ভাড়া বাকি, মুদির দোকানের টালিখাতায় বাড়ছে বকেয়ার দীর্ঘ সারি। তবুও তাদের দুচোখ জুড়ে স্বপ্ন। কোন এক কালে হয়তো কেটে যাবে এই মহামারী। আবার ফিরবে সুদিন।

ডাকনাম বাবু। থাকেন রায়ের বাজারে। এই রায়ের বাজার লকডাউন হয়ে আছে সেই কবে থেকে। লকডাউনে উল্টেপাল্টে গেছে রায়ের বাজারের মানুষগুলোর জীবন জীবিকা। যেমন এই বাবু। যে কেউ তাকে দেখে সবজি বিক্রেতা মনে করতেই পারেন। কিন্তু বাবু সবজি বিক্রেতা কোনো কালেই ছিলেন না। রায়ের বাজারের একটি রেস্টুরেন্টে ৫ বছর ধরে কাজ করতেন বাবু। এখন সে করোনায় চাকরি হারিয়ে হয়েছেন সবজি বিক্রেতা। কিন্তু সবজি বিক্রির টাকায় বাসা ভাড়া আর বাজার সদাই নিয়ে বাবু হিমশিম খাচ্ছেন।

বাবু বলেন, ভোর চারটা বাজে ঘুম থেকে উইঠা মাল কিন্না নিয়া আইতে অই। হেই রাইত সাতটা আটটা বাজে কাম শ্যাষ কইরা বাসায় যাইতে। আয় ইনকাম তেমনডা অইনা। হ্যারপরও কিছু করার নাই, জীবন এইডাই। চাকরি বাকরির যে অবস্থা ভাই, কাম এইডা কইরাই খাইতে অইবো।

এতো গেলে বাবুর গল্প। এবার শুনুনু ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র জিহাদের জীবন সংগ্রামের ফিরিস্তি। সকাল হলেই রিকশার পেডেল চেপে রাস্তায় বেরিয়ে পড়ে কিশোর জিহাদ। মোহাম্মদপুরে বসবাস করে জিহাদ। করোনার আগে জিহাদকে কাজ করতে হতো না। তার বাবা মা তাকে স্কুলে পাঠাতেন। কিন্তু করোনার প্রাদুর্ভাবে আয় রোজগার না থাকায় কচি পায়ের নিচে বাবা মা তুলে দিয়েছে রিকশার প্যাডেল। কারণ স্কুল বন্ধ থাকায় রিকশা চালিয়ে যা দু চার টাকা রোজগার হয়, তাই যেন অনেক কিছু।

জিহাদ জানায়, আমার বাবা আগে যেরকম রোজগার করতো, এখন আর তেমন পারে না। করোনার কারণে আব্বার কাম কাজ নাই। এজন্যই আমি রিকশা চালাই। আগে স্কুলে পড়তাম।

বাবু, জিহাদদের মত একই রকম গল্প কাউছারেরও। দীর্ঘ ১৩ বছর রেন্ট এ কার ও ফটোকপি ব্যবসা করে আসছেন রাজধানীর কাঠালবাগানের কাউসার হোসেন। ফটোকপি দোকানের রোজগার দিয়েই চলতো তার পাঁচ সদস্যের সংসার। কিন্তু করোনার প্রভাবে সেই ব্যবসায় এখন ঝিমিয়ে পড়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় ফটোকপির কাজ এখন নেই বললেই চলে। এছাড়া করোনার প্রাদুর্ভাবে রেন্ট এ কার ব্যবসায় নেমেছে ঘোঁর আঁধার।

কিন্তু তার পরও বসে নেই কাউসার। একই দোকানে এখন তিনি মাস্ক, হ্যান্ড গ্লাভস, স্যানিটাইজারসহ স্বাস্থ্য সুরক্ষার মাল তুলেছেন। কিন্তু তারপরও বেচাবিক্রি তেমন একটা নেই।

কাউছার বলছিলেন, ফটোকপির ব্যবসা বাণিজ্য নাই, ভার্সিটি, স্কুল, কলেজ বন্ধ। কাস্টমার আইবো কোত্থেইকা। তাই এখন ফটোকপির পাশাপাশি মাস্ক, স্যানিটাইজার বিক্রি শুরু করছি। খুব খারাপ একটা অবস্থার মধ্যে পইড়া গেছি। ৩/৪ মাসের দোকান ভাড়া বাকি পড়েছে। বাসা ভাড়াও বাকি পড়েছে।

আসাদুজ্জামান। মোহাম্মদপুরে বসবাস করেন। একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের মার্কেটিংয়ে কাজ করতেন। করোনার ছোবলে দুই মাস আগে সেই চাকরি হারিয়ে তিনি এখন বেকার।

করোনাকালে জীবন সংগ্রামের অভিজ্ঞতা ও বাস্তবতা জানাতে আসাদুজ্জামান বলেন, আত্মসম্মানে লাগে, তারপরও কিছু করার নেই। এখন ভোরে বাসা থেকে বের হই রাত ৯টা দশটায় বাসায় আসি। নানা ভাবে আয় রোজগারের চেষ্টা করি। কোনো দিন রোজগার পাঁচশ টাকাও হয়, আবার কোনো দিন হয়ই না। খুব কষ্টে আছি। পরিবার চালাতে গিয়ে এতো কষ্টের কখনো পড়িনি।

দশ বছর একটি কোম্পানিতে গাড়ি চালিয়েছেন কামরাঙ্গীরচরের শহিদুল। করোনায় তিনিও চাকরি হারা হয়েছেন। বাবা-মা, স্ত্রী, সন্তান নিয়ে তার ৬ সদস্যের সংসার। এই সংসার এতোদিন ভালোই চালিয়েছেন তিনি। কিন্তু চাকরি চলে যাওয়ায় এখন পড়েছেন মহা বিপদে। করোনার কারণে নতুন চাকরিও তিনি আর পাচ্ছেন না। তাই উপায়ন্তর না পেয়ে হয়েছেন মৌসুমী ফল বিক্রেতা।

শহিদুল বলেন, ময়মনসিংহ থেকে কাঁঠাল এনে এই জায়গায় বেঁচতাছি। এখন কি করবো বলেন, কাম কাজ নেই। যা আগে ইনকাম করতাম তা তোর আর এখন হবে না। তাই এখানে দুইটাকা চারটাকা যায় আসে তাই দিয়েই সংসার চালানোর চেষ্টা করি।

শুধু বাবু, জিহাদ, কাউসার, শহিদুলই নয়। এখন আমাদের আশেপাশে এমন অসংখ্য গল্প তৈরি হয়েছে। সৃষ্টি হয়েছে অসংখ্য চরিত্র। যে চরিত্রগুলো জীবিকার তাগিদে আত্মসম্মান ভুলে রাস্তায় বেরিয়েছে। প্রতিদিন মানুষ কর্ম হারাচ্ছে। বাড়ছে বেকারত্বের হার। করোনার ভয়াল থাবা আমাদের চারপাশে একটা নিরব দুর্ভিক্ষের আভাস ছড়িয়ে দিয়েছে। জানি না এই আভাস প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায় কিনা। তারপরও আমরা আশাকরি, আবারও সুদিন ফিরে আসবে।

জীবন ও জীবিকা বিনাশী করোনা বিদায় নেবে একদিন। তখন হয়তো আবারও বইখাতা হাতে নিয়ে স্কুলে ফিরবে জিহাদ। তখন হয়তো বাবা মায়ের ওষুধ আর সন্তানের খাবার নিয়ে ঘরে ফিরতে পারবে শহিদুলরা। সেই প্রত্যাশা! 

আমাদের চারদিকে বদলে যাচ্ছে মানুষের পেশা, বেকার হচ্ছেন বহু মানুষ। গোটা দুনিয়াতেই কর্মজীবীরা আজ কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে। এর মাঝেও সুদিনের স্বপ্ন দেখছেন বাবু, জিহাদ, কাউছাররা। কেটে যাবে আধার, ফিরে আসবে আলো, জ্বলমলে মানবসভ্যতা।

 

টাইমস/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
জুলাই আন্দোলনে মূল ভূমিকা ছিল তারেক রহমানের: টুকু Jul 17, 2025
img
নীলফামারী থেকে ঢাকায় ফেরার পথে অবরোধের মুখে ২ উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
টেকসই আর্থিক কার্যক্রমে শীর্ষে ১০ ব্যাংক ও ২ আর্থিক প্রতিষ্ঠান Jul 17, 2025
img
অ্যাতলেটিকোয় যোগ দিলেন আর্জেন্টাইন ফুটবলার থিয়াগো আলমাডা Jul 17, 2025
img
'নিজের এবং দলের প্রতি আত্মবিশ্বাস ছিল'- সিরিজ জয়ের পর লিটন Jul 17, 2025
img
কক্সবাজারে আহত ছাত্রদল নেতা অভির পাশে বিএনপি Jul 17, 2025
img
১৬ জুলাইতেই কেন এনসিপিকে গোপালগঞ্জে যেতে হল?- প্রশ্ন মাসুদ কামালের Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জে সংঘর্ষ: গুলিবিদ্ধ আরেক যুবক ঢাকা মেডিকেলে ভর্তি Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জের ঘটনায় সিলেটে এনসিপির ব্লকেড কর্মসূচি Jul 17, 2025
img
মেহেদীর বোলিংয়ের প্রশংশা করলেন আসালাঙ্কা Jul 17, 2025
img
সড়কে চাঁদা তোলাকে কেন্দ্র করে স্থানীয় জামায়াত-বিএনপি সংঘর্ষ Jul 17, 2025
img
কলম্বোতে মেহেদীর খেলার বিষয়টি আগেই ঠিক করে রেখেছিলেন লিটন Jul 17, 2025
img
সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতিতে কোনো পরিবর্তন আসেনি: পররাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
দ্রুতই আবু সাঈদ হত্যার বিচার হবে, তাঁর বাবা এ বিচার দেখে যেতে পারবেন: আইন উপদেষ্টা Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জের ঘটনা নিয়ে আওয়ামী লীগ ভুয়া তথ্য ছড়াচ্ছে: প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং Jul 17, 2025
img
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট থেকে বিদায় নিচ্ছেন রাসেল Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জে ইন্টারনেট সেবা বন্ধ হয়নি: মন্ত্রণালয় Jul 17, 2025
img
চলতি বছর স্বর্ণের দাম বেড়েছে ২৬ শতাংশ, আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনা Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা Jul 17, 2025
img
গোপালগঞ্জে হামলার ঘটনায় কুষ্টিয়ায় এনসিপির বিক্ষোভ মিছিল Jul 17, 2025