কোয়ারেন্টিনে করোনাযোদ্ধা ঢাকা মেডিকেল ছাত্রীর ১৪ দিন

মানুষটা ছিল বেশ সাধাসিধে। বয়স ত্রিশের মত হবে, নিতান্তই মধ্যবিত্ত একজন মানুষ। চারপাশের এত কেসের মধ্যে নিজ থেকে হেঁটে হেঁটে আসা এই মানুষটাকে আলাদা করে চোখে পড়ার কথা ছিল না আমার। কিন্তু সময়টা যে করোনার আর মানুষটার মুখের কাপড়ের খাকি রঙের মাস্ক, সবমিলিয়ে সূক্ষ্ম একটা অস্বস্তি কাজ করছিলো আমার মনে। তখনো কি আমি জানতাম আমার সামনের এই মানুষটার কোভিড ১৯ পজিটিভ।

দিনটা ছিল শুক্রবার, ১৩ই মার্চ, সময়টা সন্ধ্যা। আমাদের মেডিসিন ইউনিটের ডাবল এডমিশান ছিল সেদিন। খুব ব্যস্ত একটা সময় পার করছিলাম আমরা সবাই। আমি ছিলাম ডক্টরস ডেস্কে, উনি আসলেন, উনার হাতের ইমার্জেন্সি থেকে কাটা টিকিটটি দেখালেন। হিস্ট্রি নিতে আমি উনার সমস্যা জিজ্ঞেস করলাম, উনি বললেন, জ্বর আর শ্বাসকষ্ট গত ২ দিন ধরে। উনাকে ট্রাভেলিং হিস্ট্রি জিজ্ঞেস করাতে উনি বললেন, উনি ইতালি থেকে বাংলাদেশে এসেছেন গত ৭ মার্চ। আমার হাতে উনার দেওয়া টিকিটটা তখনো ধরা ছিল, চমকে ওটার দিকে তাকাতেই দেখলাম লেখা "came from Italy"। ওই মূহুর্ত থেকে মনে হলো সব থমকে গেছে। আমি আর আমার খুব কাছে এই মাস্ক পরা মানুষটা, মাঝখানে একটা ডেস্কের তফাৎ শুধু। আমার মাথায় অন্য সবকিছু কোথায় চলে গিয়ে ক'টা কথাই শুধু ঘুরপাক খাচ্ছিলো- সাধারণ দেখতে এই মানুষটা, চারপাশের অগনিত সুস্থ অসুস্থ মানুষের জন্য উনার মুখের কাপড়ের এই মাস্কটি কি যথেষ্ট? আমার মুখের সার্জিকাল মাস্ক, এটা কি আমার জন্য যথেষ্ট?

স্বীকার করতে লজ্জা নেই ঝুলিতে প্রায় একবছর ইন্টার্নির অভিজ্ঞতা থাকলেও আমি ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। সময়টা একদম শুরুর, তখনো ডিএমসিএইচে স্ট্রংলি করোনা সাসপেক্টেড কেস আসেনি। একজন দুজন যারা শ্বাসকষ্টের পেশেন্ট ছিলেন তারা এন্টিবায়োটিকেই ভালো রেসপন্স করছিলেন। দেরি না করে আমি আমাদের ইউনিটের আরএমও শরীফ ভাইয়াকে ডিউটি রুম থেকে ডেকে আনি। আমরা মানুষটাকে IEDCR এ রেফার করে দেই। মানুষটা চলেও যায়। তবুও মনের ভুল কিনা জানিনা ইউনিটের বাতাস বড় বেশি গুমোট মনে হলো, মানুষটা গেছে তার ছুঁয়ে দেওয়া বাতাস তো না।পরদিন শরীফ ভাই আমার কাছে এসে জানান, গতদিনের মানুষটার করোনা পজিটিভ, আমি যেন সাবধানে থাকি। গতকাল পেশেন্টটির হিস্ট্রি নেওয়ার সময় ভাইয়ার মুখে কোন মাস্কও ছিল না। তিনি সেদিন রাত থেকেই কোয়ারেন্টিনে চলে যান।

ঐ মূহুর্ত থেকে আমি আমার হাসপাতালের পরিচিত জগতের মধ্যে থেকেও আলাদা অন্য একজন হয়ে গেলাম। পরদিন আমার ইউনিটের হেড রোবেদ আমিন স্যার আমাকে ফোন দিলেন, আমাদের গোটা মেডিসিন বিভাগের হেড মুজিব স্যার আমার সাথে কথা বললেন। সবার এক কথা, আমি যেন খুব সাবধানে থাকি, আমি যেন কোয়ারেন্টিনে চলে যাই। রোবেদ আমিন স্যার আমাকে কোয়ারেন্টাইনের প্রতিটি নিয়ম বুঝিয়ে বললেন। মার্চের ২২ তারিখ শেষ হওয়ার কথা ছিল আমার ইন্টার্নশিপ, একদম শেষ সময়ে নিয়তির এমন আয়োজন দেখে আমি হতবিহ্বল হয়ে পড়লাম। ঢাকা মেডিকেলের হোস্টেলে থেকে কোয়ারেন্টিনে থাকা সম্ভব না। বাসায় যে যাবো, আম্মুর হাইপ্রেশার, বাবার হার্টের অসুখ। নিজেকে অতটা দূর্বল আগে কখনো লাগেনি। চিন্তাশক্তি স্থবির হয়ে থাকা মাথাতেই প্রথমে যেটা এলো সেটাই করলাম, মুখে মাস্ক লাগিয়ে টাকার আর কাঁধের ব্যাগটা নিয়ে চলে এলাম কুমিল্লায়, আমার বাসায়। বাসায় যখন পৌঁছুলাম, আমার বাবা মা কেউই ছিলেন না সেখানে। আমার ছোট ভাই দরজা খুলে দিলো। আমি সোজা ঢুকে গেলাম আমার রুমে, শুরু হলো আমার কোয়ারেন্টিনের দিনগুলো।

বাবা মা যখন আসলেন বাসায়, মা খুব ঘাবড়ে গিয়েছিলেন। না জানি তার মেয়ের কি হয়ে গেছে। আমি বোঝাতে পারবো না সেই সময়টা কেমন ছিল। দরজার এপাশ থেকে ওপাশে বাবা মায়ের সাথে কথা বলা, তাদের বোঝানো। আমি কোনদিন ভাবিনি আমার বাসায় থেকে আমি আমার বাবা মায়ের চেহারা কখনো দেখতে পারবো না। কড়া নিয়ম ছিল আমার, দরজার ওপাশে আমার বাবা মা যেন ঘোরাঘুরিও না করে। খাবার নিয়ে আসতো আমার ভাই, দরজার ওপাশে মেঝেতে রেখে দরজায় টোকা দিয়ে দূরে সরে যেত। আমি দরজা অল্প ফাঁকা করে প্লেটটা টেনে নিতাম। একদিন না, দুইদিন না, চৌদ্দটা দিন, তার বিয়াল্লিশ বেলার খাবার আমি এভাবে খেয়েছি। বাবা সকাল বিকাল ভিডিও কল দিতেন। ছোটভাই দুটো অকারণে বন্ধ দরজার ওপাশে ঘুরঘুর করতো। নিয়ম করে নামাজ আদায় করতাম, কোরআন শরীফ তেলওয়াত করতাম। প্রতিদিন অজস্র মেসেজ পেতাম, "আপু দোয়া করি। আপনার কিচ্ছু হবে না।" মা বাবা নিয়ম করে জায়নামাজের পাটিতে দোয়া করতেন আমার জন্য, সারাজীবন জ্বালাতন করা ভাইদুটোও নরম স্বরে কথা বলতো দরজার ওপাশ থেকে। আমার ইউনিটের সব স্যার, সিনিয়র ভাইয়া আপু নিয়ম করে খোঁজ নিতেন আমার। আমার কোয়ারেন্টিনের মাঝেই শরীফ ভাই একদিন ফোন দিয়ে জানালেন, আমাদের ঐ পেশেন্টের স্ত্রী আর ছোট বাচ্চারও করোনা পজিটিভ ধরা পড়েছে। নিজেই আছি এই রিস্কে তবু আত্মা কেঁপে উঠলো। আমাদের সারাদেশে না জানি কত হাজার হাজার মানুষ না জেনে সাথে করে নিয়ে বেড়াচ্ছেন এই ভাইরাসটাকে, ছড়িয়ে যাচ্ছেন নিজের অজান্তে।

আমার কোয়ারেন্টিনের চৌদ্দদিন শেষ হয়েছে ক'দিন হলো মাত্র। বাবা মায়ের কাছাকাছি এখনো যেতে ভয় করে। ভালোবাসা আর ভয় দুটো যে এমন জড়িয়ে থাকতে পারে একে অন্যকে আগে জানতাম না। খুব দুঃসময় চলছে বাংলাদেশের। আমি তার কণা মাত্র দেখেছি আর সেটাই ছিল আমার সহ্যের বাইরে। বিশ্বের সর্বাধুনিক দেশগুলো মৃত্যুপুরীতে পাল্টে গেছে রাতারাতি। আমার দেশটা অত্যাধুনিক না, উন্নত না। পর্যাপ্ত পিপিই নেই, ভেন্টিলেটর ব্যবস্থা নেই, সোশাল ডিসট্যান্স মেইনটেনিং নেই, বিদেশ থেকে আসা বহু মানুষ এখনো পলাতক তাও খুব প্রাণপণে বিশ্বাস করি বেঁচে যাবে আমার দেশ, আমার দেশের মানুষগুলো। একদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখবো, সারা পৃথিবী থেকে করোনা নামের এই ভাইরাসটা উবে গেছে, যেন আগে এটা ছিলোই না কখনো। বিশ্বের মানুষ আবার হাসছে, গাইছে, ঘরের বাইরে পা রাখছে।

লেখক: সাদিয়াতুল মুনতাহা জিদনি

ইন্টার্ন চিকিৎসক, ঢাকা মেডিকেল কলেজ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
গাইবান্ধায় আওয়ামী লীগ নেতা ফারুক আটক Oct 14, 2025
img

চাকসু নির্বাচন

৩৫ বছর পর চবি ক্যাম্পাসে ফের ভোটের আমেজ Oct 14, 2025
img
নবাগতদের জন্য অক্ষয়ের সতর্কবার্তা Oct 14, 2025
img
চাঁদপুরের নৌপুলিশের অভিযানে ৪৫ জেলে আটক Oct 14, 2025
img
জিন নয়, জীবনযাপনেই বাড়ছে অকালপক্বতার ঝুঁকি Oct 14, 2025
img
যুদ্ধবিরতি চুক্তিতে ট্রাম্প ও মধ্যস্থতাকারী ৩ নেতার সই Oct 14, 2025
img
জুলাই সনদের চূড়ান্ত অনুলিপি রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে যাচ্ছে আজ Oct 14, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টা ও রোমের মেয়রের সাক্ষাৎ নিয়ে প্রশ্ন জুলকারনাইন সায়েরের Oct 14, 2025
img
যুদ্ধবিরতির জন্য ট্রাম্পের প্রশংসা করলেন বাইডেন Oct 14, 2025
img
দেশের প্রয়োজনে ইলেক্ট্রোরাল অ্যালায়েন্সের দিকে যেতে পারে এনসিপি: সারজিস Oct 14, 2025
img
ক্যাচ ছেড়ে মাশুল গুনতে হলো বাংলাদেশের, হেরেও গর্বিত অধিনায়ক Oct 14, 2025
img
মুক্তি পাওয়া ১৫৪ জন ফিলিস্তিনিকে নির্বাসনে পাঠিয়ে দিচ্ছে ইসরায়েল Oct 14, 2025
img
জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের আজকের পরীক্ষা স্থগিত Oct 14, 2025
img
আমার জীবনে সালমান একজন গার্ডিয়ান অ্যাঞ্জেল: এলি আভরাম Oct 14, 2025
img
বেরোবিতে সহিংসতায় জড়িত ৮ শিক্ষার্থী বহিষ্কার Oct 14, 2025
img
পাকিস্তান এবং ভারত খুব শান্তিতে একসঙ্গে থাকবে : ট্রাম্প Oct 14, 2025
img
নতুন হোয়াটসঅ্যাপ ফিচারে যোগ হবে ফেসবুক প্রোফাইলের লিংক Oct 14, 2025
img
ফেব্রুয়ারির মধ্যে বাংলাদেশ সফরে আসতে চান ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট Oct 14, 2025
img

রাকসু নির্বাচন

শিবির-সমর্থিত প্যানেলের সভার ২শ প্যাকেট খাবার ফেরত পাঠালো নির্বাচন কমিশন Oct 14, 2025
img

বাংলাদেশ-পাকিস্তান জেইসি বৈঠক ২৭ অক্টোবর

পাকিস্তান যাচ্ছেন বাণিজ্য উপদেষ্টা, আসছেন অর্থনীতি বিষয়কমন্ত্রী Oct 14, 2025