পূর্বের মহামারীগুলো থেকে যেসব শিক্ষা পেয়েছে মানব সমাজ

কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে মানব জীবন বিপর্যস্ত। উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা প্রতিদিনের নিত্যসঙ্গী হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা কোয়ারেন্টাইন সহ নতুন নতুন অনেক শব্দ ও ব্যবস্থা প্রত্যক্ষ করেছি, বন্ধ হয়ে গেছে স্কুল-কলেজ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, মাস্ক এখন দৈনন্দিন জীবনের বাস্তবতা।

তবে মানব সভ্যতার ইতিহাসে এটিই প্রথম মহামারী নয়। এর আগেও মহামারীর বিস্তার মানুষ দেখেছে এবং সেসব মহামারী থেকে নানা অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। এসব মহামারী থেকে লব্ধ অনেক জ্ঞান আমাদের আজকের এই মহামারী পরিস্থিতিতে বহুভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে।

সামাজিক বিচ্ছিন্নতা

বিউবুনিক প্লেগ বা ব্ল্যাক ডেথ চলাকালীন সময়ে ২৪ জুলাই, ১৩৭৭ সালে বন্দর নগরী রাগুসায় (আজকের ডাব্রোভনিক, ক্রোয়েশিয়া) সর্ব প্রথম কোয়ারেন্টাইন আইন পাস হয়েছিল। এতে বলা হয়েছিল, “যারা প্লেগ-আক্রান্ত অঞ্চল থেকে আসছেন তারা রাগুসা বা এর জেলাগুলোতে প্রবেশ করতে পারবে না। যদি না তারা জীবাণুমুক্ত হওয়ার উদ্দেশ্যে ম্রকান দ্বীপে বা কাভাত শহরে একমাস থেকে আসে।” চিকিত্সকরা সেই সময় পর্যবেক্ষণ করেছিলেন যে ব্যক্তিদের বিচ্ছিন্ন করে দিয়ে বা কোয়ারেন্টাইনে রেখে ব্ল্যাক ডেথের বিস্তার কমিয়ে আনা যেতে পারে।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শেষে আমেরিকান সৈন্যদল ফিরে আসার পর ১৯১৮ সালের ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী বা স্প্যানিশ ফ্লু আমেরিকাতে ছড়িয়ে পড়লে ‘কোয়ারেন্টাইন’ প্রথা এটি প্রতিরোধে বিশেষ ভূমিকা রাখে। সান ফ্রান্সিসকোতে, নৌপথে আগমনকারীদেরকে কোয়ারেন্টাইনে রাখার বিশেষ বন্দোবস্ত করা হয়েছিল। সান ফ্রান্সিসকো এবং সেন্ট লুইসে সামাজিক জমায়েত নিষিদ্ধ করা হয়েছিল, থিয়েটার এবং স্কুল বন্ধ ছিল।

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে খাবার ও পানীয় সংগ্রহ

কোভিড-১৯ এর আগেও ইতালি মহামারী প্রত্যক্ষ করেছে। ইতালীয় প্লেগ (১৬২৯-১৬৩১) চলাকালীন সময়ে, টসকানির ধনী নাগরিকরা ওয়াইন গ্রহণের জন্য একটি অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করেছিলেন, যা ওয়াইন উইন্ডো বা বুচেতে দেল ভিনো হিসেবে পরিচিত।

এই উইন্ডোগুলো ব্যবহার করে ক্রেতারা শপে না ঢুকে ওয়াইন গ্রহণ করতেন। সপ্তদশ শতাব্দীর মদ বিক্রেতারা এমনকি অর্থ গ্রহণের সময় ভিনেগারকে জীবাণুনাশক হিসাবেও ব্যবহার করেছিলেন। আমরা বর্তমানে যেমন হ্যান্ডস্যানিটাইজার ব্যবহার করছি।

ফ্লোরেন্স শহরে এমন প্রায় দেড় শতাধিক ওয়াইন উইন্ডো রয়েছে এবং বর্তমানে কোভিড-১৯ মহামারী চলাকালীন সময়ে ওয়াইন থেকে শুরু করে কফি কিংবা অন্য যেকোনো পণ্য সামগ্রী সরবরাহের জন্য সেগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে।

মাস্কের ব্যবহার

ব্ল্যাক ডেথের মহামারীর সময় রোগীদের চিকিত্সায় নিয়োজিত চিকিত্সকরা এক ধরনের প্লেগ মাস্ক ব্যবহার করতেন। এটি অন্ততপক্ষে তাদের মুখ এবং নাক আংশিকভাবে আবৃত করে রাখতো।

সেই সময় চিকিত্সকরা মায়সমা তত্ত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এই তত্ত্বমতে বাতাসে দুর্গন্ধের সাথে রোগ ছড়িয়ে পড়ে। তাই তাদের ওই মাস্কগুলোতে সুগন্ধিযুক্ত নানা ধরণের ভেষজ লাগানো থাকত।

১৯১৮ সালে ইনফ্লুয়েঞ্জা মহামারী চলাকালীন সময়ে জনসাধারণের মধ্যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়া বন্ধ করতে মাস্ক ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। ১৯১৮ সালের সেপ্টেম্বরে সান ফ্রান্সিসকোতে মাস্ক ব্যবহার বাধ্যতামূলক হয়ে যায়।

যারা এই নিয়ম অমান্য করত তাদের জেল-জরিমানা করা হতো এবং তাদের নাম সংবাদপত্রে ‘মাস্ক স্ল্যাকার’ হিসাবে ছাপা হতো। শুধু তাই নয়, ঘরে কীভাবে মাস্ক বানানো যায় সে বিষয়েও বহু লেখা তখন সংবাদপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

হাত ধোয়া

১৮০০ শতকের মাঝামাঝিতে লুই প্যাস্তুর, জোসেফ লিস্টার এবং রবার্ট কোচের ‘জীবাণু তত্ত্ব’ প্রকাশিত হলে মানুষ বুঝতে পারে যে খালি চোখে দেখা যায় না এমন অদৃশ্য অণুজীবের দ্বারা রোগের বিস্তার ঘটে।

রোগের বিস্তার কমাতে হাত ধোয়া এখন সর্বজন স্বীকৃত। তবে ঘন ঘন হাত ধোয়ার বিষয়টি বিশ শতকের গোঁড়ার দিকে অনেকটাই নতুন ছিল। ব্ল্যাক ডেথ চলাকালীন সময়ে হাত ধোয়ার অনুশীলনকে উত্সাহিত করতে এবং অতিথিদের দ্বারা বাহিত জীবাণু থেকে পরিবারের সদস্যদের রক্ষা করার উদ্দেশ্যে গ্রাউন্ডফ্লোরে বা ঘরে ঢোকার পূর্বেই হাত ধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছিল।

শিক্ষাব্যবস্থায় অভিযোজন

কোভিড-১৯ মহামারীর ফলে শিক্ষা ব্যবস্থা প্রায় বিপর্যস্ত। অনলাইন ক্লাশ প্রভৃতি প্রযু্ক্তি নির্ভর ব্যবস্থায় একে ঠিকিয়ে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে মহামারীর কারণে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ বা শিক্ষা ব্যবস্থায় অভিযোজনের ঘটনা নতুন কিছু নয়।

১৬৬৫ সালে বিউবুনিক প্লেগের প্রাদুর্ভাবের পরে তরুণ আইজাক নিউটনকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তার পরিবারের খামার বাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হয়েছিল। সেই খামারেই তিনি পতিত আপেল প্রত্যক্ষ করেছিলেন, যা তাকে সর্বজনীন মাধ্যাকর্ষণ বল আবিষ্কারে সহায়তা করেছিল। তথ্যসূত্র: হিস্ট্রি.কম।

 

টাইমস/এনজে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
‘ভবিষ্যতে আমার রাজনীতিতে জড়ানোর সম্ভাবনা খুবই কম’ Nov 17, 2025
img
শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডাদেশে ভারতের প্রতিক্রিয়া Nov 17, 2025
img
ভুয়া খবরে ক্ষুব্ধ নোরা Nov 17, 2025
img
নাচ নিয়ে কটাক্ষ, মুখ খুললেন মালাইকা Nov 17, 2025
img
অভিনেত্রী শাওনকে ‘ভারতীয় গুপ্তচর’ অ্যাখ্যা, দ্রুত গ্রেফতার দাবি Nov 17, 2025
img

মিস ইউনিভার্সের মঞ্চ থেকে মিথিলা

‘এখন আমাদের দেশের সম্মানের প্রশ্ন’ Nov 17, 2025
img
১০ বছর আগের সাকা চৌধুরীর সেই ভবিষ্যদ্বাণী ভাইরাল Nov 17, 2025
img
ইসলামী ব্যাংকে ভয়াবহ আগুন Nov 17, 2025
img
ধর্মেন্দ্রর শারীরিক খোঁজ নিতে হেমার বাড়িতে শত্রুঘ্ন-পুনম Nov 17, 2025
img
৫ দিনের শুভেচ্ছা সফরে চট্টগ্রামে পৌঁছেছে রাশিয়ার নৌবাহিনীর জাহাজ ‘গ্রেমেয়াশচি’ Nov 17, 2025
img
দল হিসেবে আ. লীগের বিচার শুরু করতে হবে: নাহিদ ইসলাম Nov 17, 2025
img
নির্বাচন কমিশনের নিয়ত পরিষ্কার : সিইসি Nov 17, 2025
img
কিছু লোক ইচ্ছাকৃতভাবে পরিস্থিতি উত্তেজিত করতে চায়: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Nov 17, 2025
img
৭৭ ক্রিকেটারকে নিয়ে আইপিএলে এবার ২৩৮ কোটি রুপির লড়াই Nov 17, 2025
img
শেখ হাসিনাকে ফেরাচ্ছে না ভারত: বিবিসি Nov 17, 2025
ভারতের সাথে আমরা জিতব: প্লেয়ারদের কনফিডেন্স আছে : অধিনায়ক জামাল Nov 17, 2025
img
আরাধ্যার গ্ল্যামার–বিমুখ জীবন নিয়ে অভিষেকের মন্তব্য Nov 17, 2025
img
শাসক নয়, সেবক হয়ে উঠার রাজনীতি করুন: শিশির মনির Nov 17, 2025
আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে সড়কে ঢাকা জেলা পুলিশ সুপার Nov 17, 2025
img
ধৈর্য, সতর্কতা ও ঐক্য বজায় রাখুন: জামায়াত আমির Nov 17, 2025