জোয়ান অব আর্ক: এক ফরাসি বীর কন্যার গল্প

জোয়ান অব আর্ক। এক ফরাসি বীর যোদ্ধা, সেনাপতি ও বিপ্লবী। ব্রিটিশ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সকে বিজয়ী করতে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এই বীর কন্যা। ইতিহাসের এই শহীদ মহানায়িকার বীরত্বেই ঐতিহাসিক শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধে ফ্রান্সের কাছে ইংল্যান্ড পরাজিত হয়।

১৪১২ সালে ফ্রান্সের উত্তর-পূর্বে ডমরেমি অঞ্চলে এক দরিদ্র কৃষক পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন জোয়ান অব আর্ক। বাবা জেক এর খামার থেকে তিনি কৃষি কাজ শেখেন এবং মা ইসাবেলর কাছ থেকে শেখেন সেলাইর কাজ। শৈশবে তিনি ছিলেন খুব ধার্মিক একজন কিশোরী। তিনি এমন এক অঞ্চলে জন্মগ্রহণ করেন, যেখানে ফ্রান্স-ইংল্যান্ড যুদ্ধের কারণে চরম দরিদ্রতা বিরাজ করছিল।

শৈশবে তিনি খুব ধার্মিক জীবনযাপন করতেন। তবে বারো বছর বয়সে তিনি রহস্যময় জীবন শুরু করেন। কেননা তিনি বলতে থাকেন যে, তিনি ঈশ্বরের কাছ থেকে ফ্রান্সকে পুনর্গঠন করার নির্দেশ পেয়েছেন। সেই থেকে তিনি দেশের জন্য যুদ্ধে অংশ নেয়ার লক্ষ্য স্থির করেন। এই সময় বিখ্যাত ফরাসি ধর্মগুরু সেইন্ট মাইকেল ও সেইন্ট ক্যাথরিনের কাছ থেকে তিনি ফ্রান্সকে নেতৃত্ব দেয়ার উৎসাহ পান।

এর আগে ১৩৩৭ সালে ইংল্যান্ডের রাজা তৃতীয় অ্যাডওয়ার্ড অবৈধভাবে ফ্রান্সের সিংহাসন দাবি করেন। এতে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের মধ্যে যুদ্ধ লেগে যায়, যা ১৪৫৩ সাল পর্যন্ত চলে। ইতিহাসে এটি শতবর্ষব্যাপী যুদ্ধ নামে পরিচিত।

১৪১৫ সালে ইংল্যান্ডের রাজা হ্যানরি পঞ্চম এক যুদ্ধে ফরাসিদের পরাজিত করে ফ্রান্স দখল করেন। এর ফলে ১৪২৮ সালের দিকে ফ্রান্স অসংখ্য খণ্ডে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এই সময়টায় ফ্রান্সে কোনো জাতীয় ঐক্য ছিল না। জাতীয় কোনো শক্তিশালী নেতৃত্বও ছিল না। ফ্রান্সের নেতৃত্বে ছিলেন চার্লস দ্যা পনথু, যার নেতৃত্ব ছিল অত্যন্ত দুর্বল।

এই সময় ফ্রান্সকে নেতৃত্ব দিতে দৃঢ় সংকল্প করেন জোয়ান অব আর্ক। তখন তিনি কৃষক পরিবারের ষোল বছরের এক কিশোরী মাত্র। তাকে কীভাবে যুদ্ধের নেতৃত্ব দেবেন রাজা? এ বিষয়টা নিয়ে তিনি ভাবলেন এবং শহরে চলে যান। তিনি একজন সেনা কমান্ডারকে বললেন যেন তাকে রাজা চার্লসের সঙ্গে দেখা করিয়ে দেন। কিন্তু কমান্ডার তার কথায় ঠাট্টা করলেন। তবুও তিনি হাল ছেড়ে দিলেন না।

এক পর্যায়ে কিছু স্থানীয় নেতার সহায়তায় তিনি রাজার দেখা পান। প্রথমে রাজা সংশয়ে পড়লেন যে তিনি কীভাবে একজন তরুণ কিশোরীর হাতে একটি দেশের সেনাবাহিনীর নেতৃত্ব তুলে দেবেন? এই কিশোরী কি আসলেই একজন ঈশ্বরের দূত নাকি একজন উন্মাদ? যাইহোক একটা সময় তিনি দেখলেন তার হারানোর কিছু নেই। তাই তিনি জায়ান অব আর্ককে বিশ্বাস করলেন এবং কিছু সৈন্য দিয়ে তাকে অরলিন্স শহরে পাঠালেন, যা ইতোমধ্যে ইংল্যান্ডের দখলে রয়েছে।

ইতোমধ্যে অরলিন্সবাসী ঘটনাটি জানতে পায়। তারা খুব আশাবাদী হয় যে, ঈশ্বর তাদের জন্য একজন দূত পাঠিয়েছেন যিনি তাদেরকে ইংরেজদের কবল থেকে মুক্ত করবেন। তাই তিনি যখন সৈন্য নিয়ে অরলিন্সে পৌঁছলেন শহরবাসী তাকে সাদরে বরণ করল। ধীরে ধীরে ফরাসি সৈন্যরা শহরে এসে পৌঁছল। শুরু হল যুদ্ধ। যুদ্ধে তিনি কিছুটা আহত হয়েছিলেন। তারপরও থামেন নি। তিনি বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে থাকেন এবং ফরাসিদের দিকনির্দেশনা দেন।

অবশেষে ফরাসিরা ইংরেজ সেনাদের প্রতিহত করতে সক্ষম হয়। অরলিন্স যুদ্ধে তার এই বিজয়ে ইংরেজরা শহর ছেড়ে পালিয়ে যায়। পরে তিনি রিম শহরে অভিযান পরিচালনা করেন এবং ইংরেজদের বিতাড়িত করেন। ফলে এক সময় পুরো ফ্রান্স ইংরেজদের থেকে দখলমুক্ত হয়। অবশেষে সমগ্র ফ্রান্সের সম্রাট হন রাজা চার্লস। আর জোয়ান অব আর্কের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

পরবর্তীতে তিনি জানতে পারেন যে, কাম্পিন শহর বার্গানডান্সদের দ্বারা আক্রান্ত হয়েছে। তিনি একটি ছোট সৈন্যদল নিয়ে সেখানে অভিযান চালান। কিন্তু ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে বার্গানডান্সরা তাকে আটক করে ফেলে এবং ইংল্যান্ডের কাছে বিক্রি করে দেয়।

দুর্ভাগ্যক্রমে জীবন বাজি রেখে যে রাজাকে তিনি ফ্রান্সের সিংহাসনে বসিয়েছিলেন, সেদিন সেই রাজা চার্লস একটিবারের জন্যও তাকে বাঁচানোর চেষ্টা করেন নি।

ইংরেজরা তাকে বিচারের আওতায় নিয়ে আসে। তবে তার কোনো অপরাধ খুঁজে পাচ্ছিল না। অবশেষে তারা জানতে পারে তিনি কিশোরী হয়েও একজন পুরুষের ছদ্মবেশ ধরেছিলেন। এই বিষয়টাকে কেন্দ্র করে তারা তাকে ধর্মদ্রোহী সাব্যস্ত করে।

শাস্তি স্বরূপ ১৪৩১ সালের ৩০ মে তাকে একটি শূলে বেঁধে জীবন্ত জ্বালিয়ে দেয়া হয়। মৃত্যুকালে তিনি ছিলেন মাত্র ১৯ বছরের এক তরুণী। যাকে বলা হত ‘দ্যা মেইড অব অরলিন্স’ বা অরলিন্সের কুমারী।

মৃত্যুর পূর্বে তিনি একটি ক্রুশ হাতে নেন। তিনি তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের ক্ষমা করে দেন এবং তার জন্য ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করতে বলেন। ফরাসিদের জন্য তার এ আত্মত্যাগে তিনি হয়ে যান ইতিহাসের এক অন্যতম মহানায়িকা।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দীপিকার মেয়ের মতো, ভারতী কাকে লেহেঙ্গা পরাতে চান! Oct 30, 2025
img
যুক্তরাজ্যে ক্রেন দিয়ে পুরো এটিএম তুলে নিয়ে গেল চোরদল Oct 30, 2025
img
আমার দীর্ঘদিনের বন্ধুর সঙ্গে থাকতে পারা সত্যিই সম্মানের : ট্রাম্প Oct 30, 2025
img
হাইতিতে হারিকেন মেলিসার তাণ্ডব, প্রানহানি কমপক্ষে ২০ Oct 30, 2025
img
প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্য বড় সুখবর, বরাদ্দ দেয়া হলো ১৩২ কোটি টাকা Oct 30, 2025
img
বিশ্বকাপে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করলো দক্ষিণ আফ্রিকার নারী দল Oct 30, 2025
img
নাগরিকদের তথ্য চেয়ে এসএমপির গণবিজ্ঞপ্তি জারি Oct 30, 2025
img
রোহিঙ্গা শিশুদের জন্য শিক্ষার পথ প্রসারিত করলো কসোভো Oct 30, 2025
img
প্রেক্ষাপট উপস্থাপনায় জাকিয়া বারী মম Oct 30, 2025
img
জাতীয় নির্বাচনের আগে ‘হ্যাঁ’ ‘না’ পোস্টে ফেসবুক সরগরম, কিন্তু কেন? Oct 30, 2025
img
ট্রাম্পের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষ করে আনন্দিত শি জিনপিং Oct 30, 2025
img
৩১ সংস্থা প্রধানদের সঙ্গে ইসির বৈঠক আজ বিকেলে Oct 30, 2025
img
আমাদের দেশ থেকে যৌতুক প্রথা নির্মূল করার সময় এসেছে : রাজকুমার রাও Oct 30, 2025
img
তৃতীয় টি-টোয়েন্টির জন্য দল ঘোষণা করল বিসিবি Oct 30, 2025
img
পাকিস্তানের আকাশে বিরল মেঘের দৃশ্য Oct 30, 2025
img
বাংলাদেশকে হোয়াইটওয়াশ করতে চায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ Oct 30, 2025
img
ভারত-পাকিস্তানকে ২৫০ শতাংশ শুল্ক আরোপের কড়া বার্তা দিয়েছিলাম : ট্রাম্প Oct 30, 2025
img
ঢাকায় বজ্রসহ বৃষ্টি আভাস Oct 30, 2025
img
দেশের ৮ বিভাগে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে বজ্রসহ বৃষ্টির আভাস Oct 30, 2025
img

গাজায় প্রাণহানি চলছে

দুপুরে যুদ্ধবিরতি কার্যকরের ঘোষণা দিয়ে সন্ধ্যায় আবার ইসরায়েলের হামলা Oct 30, 2025