তিতুমীর: ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী সৈনিক

তিতুমীর। যার প্রকৃত নাম সৈয়দ মীর নিসার আলী। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম বিপ্লবী সৈনিক। উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম শহীদ বীর যোদ্ধা। তিনি সবচেয়ে বেশি বিখ্যাত তার ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লার জন্য, যেখান থেকে তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম গড়ে তুলেছিলেন। ২০০৪ সালে বিবিসির শ্রোতা জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালিদের তালিকায় তার স্থান ছিল ১১তম।

১৭৮২ সালের ২৭ জানুয়ারি পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগণা জেলার চাঁদপুরে জন্মগ্রহণ করেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। তার বাবা সৈয়দ মীর হাসান আলীর পূর্বপুরুষরা ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে আরব দেশ থেকে ভারতে এসেছিলেন। কারও কারও মতে তার পূর্বপুরুষেরা ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা.) এর বংশধর।

প্রথম দিকে তিনি গ্রামের একটি স্কুলে পড়ালেখা করতেন। পরে তিনি স্থানীয় একটি মাদ্রাসায় ভর্তি হন। আঠারো বছর বয়সে তিনি পবিত্র কোরআনের একজন হাফেজ হয়ে যান। একই সঙ্গে কোরআন, হাদিস ও ইসলামী জ্ঞানের উপর তিনি পাণ্ডিত্য অর্জন করেন। এছাড়া বাংলা, আরবি ও ফার্সি ভাষায় তার ভালো দক্ষতা ছিল।

পেশাগত জীবনে তিনি প্রথমে একজন কৃষক ছিলেন। কিন্তু একসময় তার সব জমিজমা হারিয়ে যায়। এরপর তিনি কলকাতায় চলে যান এবং একজন পালোয়ান হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করেন। এই সময় স্থানীয় একজন জমিদারের পক্ষে কাজ করতে গিয়ে তাকে কারাগারে যেতে হয়।

মুক্তির পর ১৮৮২ সালে তিনি হজ্জ করতে সৌদি আরব ভ্রমণে যান। সেখানে ইসলামি চিন্তাবিদ সৈয়দ আহমেদ বেরলভির সঙ্গে তার দেখা হয়। তার প্রভাবে তিনি তরিকায়ে মোহাম্মদিয়া আন্দোলনে যোগ দেন এবং একজন ওয়াহাবি ধর্মপ্রচারক হিসেবে কাজ শুরু করেন।

১৮২৭ সালে তিনি হজ্জ থেকে ফিরে এসে নদীয়া ও চব্বিশ পরগনার মুসলমানদের কাছে ধর্মপ্রচার শুরু করেন। ধর্মীয় আচার হিসেবে মাজারে যাওয়া, মোমবাতি জ্বালানো ইত্যাদি শিরক ও বিদআতমূলক আচরণের বিরুদ্ধে তিনি প্রচারণা চালিয়ে যান।

এই সময় স্থানীয় জমিদার ও ভূস্বামীদের বিরুদ্ধে গ্রামের নিপীড়িত অসহায় কৃষকদেরকে সংগঠিত করতে লাগলেন। মসজিদ ও দাড়ির উপর কর দাবি করার প্রতিবাদ করেন। স্থানীয় জমিদারদের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে তিনি অভিযোগ দাখিল করেন। কিন্তু তিনি কোনো বিচার পাননি। এই বিষয়কে কেন্দ্র করে জমিদারদের সঙ্গে তিনি দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়েন।

তিতুমীর খুব ভালো লাঠিয়াল ছিলেন। তাই জমিদারদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি তার অনুসারীদের নিয়ে একটি মুজাহিদ দল গঠন করেন। তিনি নিজে এই দলের সদস্যদের প্রশিক্ষণ দেন। তার এই উদ্যোগে জমিদাররা তিতুমীরের বিরুদ্ধে ক্ষেপে যায়। তিতুমীরকে প্রতিরোধ করতে তারা ব্রিটিশদের সঙ্গে হাত মিলায়।

স্থানীয় জমিদারদের সহযোগিতায় ব্রিটিশ সৈন্যরা তিতুমীরের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করে। কিন্তু তিতুমীর অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে তাদের পরাজিত করেন।

ধীরে ধীরে তিতুমীরের অনুসারীদের সংখ্যা ১৫ হাজার ছাড়িয়ে যায়। তখন ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি বারাসাত শহরের কাছে নারিকেল বাড়িয়ায় ঐতিহাসিক বাঁশের কেল্লা তৈরি করেন। এখান থেকে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। একসময় চব্বিশ পরগণা, নদীয়া ও ফরিদপুর তিতুমীরের নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। তিতুমীরের অনুসারীদের গেরিলা আক্রমণের ফলে অনেকগুলো ছোট ছোট যুদ্ধে জমিদার ও ব্রিটিশ বাহিনী পরাজিত হয়।

অবশেষে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর ব্রিটিশ ল্যাফটেনেন্ট কর্নেল স্টুয়ার্টের নেতৃত্বে অস্ত্রসজ্জিত এক শক্তিশালী বাহিনী তিতুমীরের বাঁশের কেল্লায় আক্রমণ চালায়। আধুনিক অস্ত্রসজ্জিত এই বাহিনীর সঙ্গে বাঁশ আর লাঠি হাতে তিতুমীরের সৈন্যরা পেরে ওঠতে পারেনি। ব্রিটিশদের আক্রমণে তিতুমীরের বাঁশের কেল্লা ধ্বংস হয়ে যায়। অতঃপর বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করতে করতে এক পর্যায়ে অনেক অনুসারীসহ তিতুমীর শাহাদাত বরণ করেন।

স্বয়ং ব্রিটিশ কমান্ডার তিতুমীর ও তার অনুসারীদের সাহসিকতা এবং বীরত্বপূর্ণ লড়াইয়ের ভূয়সী প্রশংসা করেন। এই ঘটনার বিচারে তিতুমীরের সেকেন্ড-ইন কমান্ডার গোলাম রসুলকে ফাঁসি এবং ৩৫০ জন যোদ্ধাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয় ব্রিটিশ শাসকগোষ্ঠী।

তিতুমীরের আত্মত্যাগ ও স্মৃতির প্রতি সম্মান জানিয়ে পরবর্তীতে ঢাকার জিন্নাহ কলেজের নাম পরিবর্তন করে সরকারি তিতুমীর কলেজ করা হয়। এছাড়া বুয়েটের একটি হলের নামকরণ করা হয় তিতুমীর হল। ১৯৯২ সালে তিতুমীরের ১৬১ তম মৃত্যুবার্ষিকীতে তার নামে একটি স্মারক স্ট্যাম্প প্রকাশ করে বাংলাদেশ সরকার।

তিতুমীর ছিলেন ভারতীয় উপমহাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের এক অন্যতম প্রেরণার উৎস। তার এই দুঃসাহসিক সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে দিয়েছিল এক নতুন শক্তি। নিপীড়িত মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার আন্দোলনের প্রেরণার উৎস হিসেবে তিনি যুগ যুগ ধরে বেঁচে থাকবেন বাংলার মাটি ও মানুষের হৃদয়ে।

 

টাইমস/এএইচ/জিএস

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
রাজধানীতে ট্রাফিক আইন লঙ্ঘনে মামলা ১৭০৯ Nov 01, 2025
img
গণমাধ্যমকে সত্য ও বস্তুনিষ্ঠ সংবাদ পরিবেশন করতে হবে : রিজভী Nov 01, 2025
img
হাঁটুর বয়সী যুবকের সঙ্গে প্রেমের গুঞ্জন অভিনেত্রী মালাইকার Nov 01, 2025
জাকের ব্যর্থতায় ক্ষুব্ধ ইরফান সাজ্জাদের ভাইরাল পোস্ট Nov 01, 2025
রোহিতকে ছাড়িয়ে টি-টোয়েন্টির নতুন রাজা বাবর আজম Nov 01, 2025
img
রবি তেজার অ্যাকশন ও শ্রীলীলার গ্ল্যামারে উড়বে ‘মাস যাত্রা’ Nov 01, 2025
ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাথে আমরা ভালো ব্যাটিং করতে পারিনি : নাজমুল আবেদীন ফাহিম Nov 01, 2025
তারেক রহমানের জন্য দোয়া কামনা তামিম ইকবালের Nov 01, 2025
বিয়ের পর ভাইরাল রাসেল-ঐশীর প্রেমগাথা Nov 01, 2025
img
বিচারকদের বদলি-পদোন্নতির সুস্পষ্ট নীতিমালা করেছে অন্তর্বর্তী সরকার: আইন উপদেষ্টা Nov 01, 2025
বারান্দায় দাঁড়ালেই ছবি! ক্যাটরিনার প্রাইভেসিতে বড় আঘাত Nov 01, 2025
img
জাকির নায়েকের সম্ভাব্য সফর নিয়ে দিল্লির বক্তব্যে ঢাকার বার্তা Nov 01, 2025
জামায়াতকে নিষিদ্ধের দাবি বিএনপির আলালের Nov 01, 2025
কারাগার থেকে ক্যাম্পাস রাজনীতিতে প্রত্যাবর্তন খাদিজার Nov 01, 2025
বাংলাদেশের নির্বাচনে আ.লীগকে রাখার প্রস্তাব দেবে ভারত? Nov 01, 2025
রকার একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকে হেয় করার চেষ্টা করছে : মেজর হাফিজ Nov 01, 2025
সালমান শাহর আসামীরা কেন গ্রেফতার হচ্ছে না? Nov 01, 2025
img
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যমুনায় বৈঠক করলেন তিন বাহিনীর প্রধান Nov 01, 2025
img
সম্পর্ক আরও মজবুত করতে ইরান-তুরস্কের নতুন উদ্যোগ Nov 01, 2025
রাজনৈতিক নেতাদের নিয়ে মন্তব্য করলেন গোবিন্দ চন্দ্র প্রামাণিক Nov 01, 2025