অরুন্ধতী রায়: এক মানবতাবাদী ঔপন্যাসিক

কাছের মানুষেরা তাকে ডাকেন রায় বলে। স্থাপত্যের বন্ধুরা তাকে ডাকেন এস এ রায় (সুজানা অরুন্ধতী রায়) বলে। অপরিচিতদের কাছে তিনি অরুন্ধতী। স্থাপত্যের ছাত্রী অরুন্ধতী প্রথমে ঝুঁকেছিলেন চলচ্চিত্রে। দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসের লেখক অরুন্ধতী রায়ের বাবার ভিটা বাংলাদেশের বরিশালে। ১৯৮৫ সালে ‘মাসি সাহিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। পরে চিত্রনাট্য লিখতে শুরু করেন। তার চিত্রনাট্য ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারও পায়।  প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’ এর জন্য ১৯৯৭ সালে ম্যান বুকার পুরস্কার পান অরুন্ধতী। তার দ্বিতীয় উপন্যাস ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব দ্য আটমোস্ট হ্যাপিনেস’ প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালে। কাশ্মিরের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ভারত সরকারের অবস্থানের কট্টর সমালোচক অরুন্ধতী মাওবাদী আন্দোলন নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বড় একটি অংশের সঙ্গে বাহাসে জড়িয়ে ‘ভারতবিরোধী’ আখ্যা পান।

মানুষের অধিকার নিয়ে কথা বলতে গিয়ে যারা অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন কলম, যাদের কলমের কালির ছোঁয়ায় অঙ্কিত হয়েছে নির্যাতিত মানুষের করুণ ছবি, যাদের ক্ষুরধার লেখনী পুঁজিবাদী শোষণের বিরুদ্ধে এক আতঙ্কের নাম, তাদেরই একজন অরুন্ধতী রায়।

বুকার পুরস্কার বিজয়ী একজন বিখ্যাত ভারতীয় উপন্যাসিক এবং মানবাধিকারকর্মী। তার প্রথম উপন্যাস ‘দ্য গড অব স্মল থিংস’-এর জন্য তিনি সবচেয়ে বেশি পরিচিত। লেখালেখির পাশাপাশি বিভিন্ন পরিবেশ এবং মানবাধিকার বিষয়ক কর্মকাণ্ডে সঙ্গে জড়িত রয়েছেন তিনি।

১৯৬১ সালের ২৪ নভেম্বর ভারতের মেঘালয় রাজ্যের রাজধানী শিলংয়ে অরুন্ধতী রায় জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা রঞ্জিত রায় একজন হিন্দু বাঙালি এবং মা ম্যারি রায় একজন সিরিয়ান খ্রিস্টান। রঞ্জিত রায় ছিলেন একজন চা শিল্পপতি। আর ম্যারি রায় ছিলেন একজন নারী অধিকারকর্মী। যিনি ভারতীয় খ্রিস্টান নারীদের পিতার সম্পত্তিতে সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় কাজ করে গেছেন।

অরুন্ধতী রায় তার দ্য গড অব স্মল থিংস বইটি উৎসর্গ করেছিলেন তার মা ও তার ভাইকে। দুই বছর বয়সে বাবার সঙ্গে মায়ের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। পরে মা ছোট অরুন্ধতী ও তার ভাইকে নিয়ে কেরালায় ফিরে আসেন। দুই সন্তান নিয়ে মায়ের সংগ্রাম শুরু হয়।

অরুন্ধতীর শৈশব কেটেছে কেরালার আয়ামানাম এলাকায়। স্থাপত্য বিদ্যা নিয়ে দিল্লির পরিকল্পনা ও স্থাপত্য বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। স্থাপত্য বিদ্যায় পড়লেও শুরুর দিকে টেলিভিশন ও চলচ্চিত্র শিল্পে কাজ করা শুরু করেন। ১৯৮৫ সালে ‘মাসি সাহিব’ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছিলেন তিনি। এরপর চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্য লেখার কাজে হাত দেন। ইলেকট্রিক মুন (১৯৯২) এবং ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ান্স (১৯৮৯) চলচ্চিত্র দুটির চিত্রনাট্য লেখেন তিনি।

‘ইন হুইচ অ্যানি গিভস ইট দোস ওয়ান্স’ চলচ্চিত্রটি স্থাপত্যবিদ্যার ছাত্রী হিসেবে তার অভিজ্ঞতার আলোকেই নির্মিত। আর এ ছবিতে অরুন্ধতী নিজেও অভিনয় করেছেন। এই চলচ্চিত্রের চিত্রনাট্যের জন্য ১৯৮৮ সালে ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান।

একজন ধর্ষিতা নারী ফুলন দেবীর জীবনী নিয়ে ‘ব্যান্ডিট কুইন’ নামে একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন শেখর কাপুর। ১৯৯৪ সালে এই ছবির সমালোচনা করে তিনি বেশ পরিচিত হয়ে ওঠেন।

‘দ্য গ্রেট ইন্ডিয়ান রেপ ট্রিক’ শিরোনামে ছবির পর্যালোচনায় তিনি অনুমতি ছাড়া একজন জীবন্ত নারীর ধর্ষণের ঘটনাকে ভিন্নভাবে উপস্থাপন করার অভিযোগ করেন।

তিনি ১৯৯২ সালে দ্য গড অব স্মল থিংস উপন্যাসটি লিখতে শুরু করেন। ১৯৯৬ সালে উপন্যাস লেখার কাজ শেষ হয় এবং বইটি বাজারে আসে ১৯৯৭ সালে। এই বইটি মূলত তার আত্মজীবনীমূলক একটি উপন্যাস। যেখানে তিনি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তার আয়ামানামের শৈশবের অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।

১৯৯৭ সালে এই বইয়ের জন্য সাহিত্যের অস্কারখ্যাত ‘বুকার পুরস্কার’ পান তিনি। বইটি ১৯৯৭ সালে নিউইয়র্ক টাইমস কর্তৃক নির্বাচিত বইগুলোর মধ্যে একটি হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়। একই বছর টাইম ম্যগাজিনের সেরা পাঁচ বইয়ের তালিকায় স্থান করে নেয় অরুন্ধতীর এই উপন্যাস।

এটি কেবল কল্পকাহিনি নির্ভর কোনো উপন্যাস নয়। এই বইয়ে আছে ইতিহাসের কথা, আছে শাশ্বত প্রেমের গল্প। ইতিহাস আর প্রেমকে এক সুতোয় গেঁথে শ্রেণিবৈষম্য, জাতপাতের বিভেদ, লুম্পেনদের সঙ্গে স্থানীয় বুর্জোয়াদের আঁতাত, পুলিশি নৃশংসতা, গণতান্ত্রিক সুবিধাভোগী ও চরমপন্থীদের দৌরাত্ম্য, প্রেমের মৃত্যুকে অত্যন্ত মানবিক দৃষ্টিকোণ থেকে তুলে ধরেছেন।

মানুষ প্রতিনিয়ত নিয়তির কাছে ধরা। মানুষ নিয়তির কাছে আশ্রয় নেয়, স্বপ্ন দেখায়, অবশেষে এই নিয়তির কাছেই মানুষের পরাজয় ঘটে, নিয়তিই মানুষকে ধ্বংস করে। পুরো উপন্যাস জুড়ে ইতিহাস আর প্রেমের খেলাছলে এভাবেই তিনি নিয়তির নিষ্ঠুরতাকে জীবন্ত করে তুলে ধরেছেন। যা লেখককে নিয়ে গেছে এক অন্য উচ্চতায়।

তিনি যখন দ্য গড অব স্মল থিংস-এর পান্ডুলিপি প্রকাশককে দেন তখন তা প্রকাশের আগেই পাঁচ লাখ পাউন্ড পেয়েছিলেন অরুন্ধতী। এই এক বই অরুন্ধতী রায়কে বিশ্বসেরা লেখকদের কাঁতারে তুলে দিয়েছে।

বইটিকে দ্য নিউইয়র্ক টাইমস অসাধারণ, নৈতিকভাবে তেজস্বীপূর্ণ এবং কল্পনার ক্ষেত্রে অধিক নমনীয় বলে বর্ণনা করেছে।

লস এঞ্জেলস টাইমস এই উপন্যাসকে গুরুত্বপূর্ণ বেগময় উপন্যাস এবং কানাডার টরন্টো স্টার- একটি জীবন্ত ও ঐন্দ্রজালিক উপন্যাস হিসেবে মন্তব্য করেছে। তবে যুক্তরাজ্যে বইটিকে ইতিবাচকভাবে তুলে ধরা হয়নি। অন্যদিকে কেরালার মুখ্যমন্ত্রী ই কে নয়ানের যৌনতার অসংযত বিবরণ তুলে ধরায় ভারতে বইটি সমালোচিত হয়।

তিনি পুঁজিবাদ, এক ভৌতিক কাহিনী, অকুপাই ওয়াল স্ট্রিট, পাওয়ার পলিটিকস, দ্য অ্যালজেব্রা অব ইনফিনিট জাস্টিস, ওয়ার ওয়াক, পাবলিক পাওয়ার ইন দ্য এজ অব অ্যাম্পায়ার, ফিল্ড নোটস অন ডেমোক্র্যাসি, ব্রোকেন রিপাবলিক: থ্রি অ্যাসে সহ বেশ কিছু গ্রন্থ রচনা করেছেন। এসব বইগুলোতে পুঁজিবাদী শাসনব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেছেন তিনি।

২০১৭ সালে ‘দ্য মিনিস্ট্রি অব আটমুস্ট হ্যাপিনেস’ শিরোনামে তার দ্বিতীয় উপন্যাস প্রকাশিত হয়। বিশ্বব্যাপী এই উপন্যাসটি ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়।

‘বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সরকার ও সংস্থাগুলো কর্তৃক সাধারণ নাগরিকগোষ্ঠীর ওপর প্রভাব বিস্তার’- শিরোনামে তিনি একটি প্রবন্ধ লিখেছিলেন। যেখানে তিনি তার জীবন উৎসর্গ ও মুক্তি, ন্যায়বিচার ও সাংস্কৃতিক বৈষম্য দূরীকরণের বিষয়াবলী তুলে ধরেছেন।

এছাড়া বিভিন্ন পরিবেশবাদী কর্মকাণ্ডের সঙ্গেও তিনি জড়িত। তিনি ভারতের নর্মাদায় বাঁধ নির্মাণের কঠোর সমালোচনা করেছিলেন। এ জন্য তাকে আদালতে পর্যন্ত যেতে হয়েছে। এছাড়া ভারতের পরমাণু অস্ত্র এবং ভারতে মার্কিন পাওয়ার জায়ান্ট ‘এনরন’-এর কার্যক্রমের সমালোচনা করে তিনি বেশ কিছু প্রবন্ধ লিখেছেন। মাওবাদীদের সম্পর্কে ইতিবাচক মন্তব্য করায় ব্যাপক সমালোচনার শিকার হয়েছেন। ২০১০ সালে কাশ্মীরের স্বাধীনতা আন্দোলনকে সমর্থন করে মন্তব্য করায় অল্পের জন্য তিনি রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ থেকে রেহাই পান।

যুক্তরাষ্ট্র এবং তালেবানদের মধ্যে হওয়া শান্তি আলোচনায় আফগান নারীদেরকে সম্পৃক্ত করার জন্য দাখিল করা এক পিটিশনে তিনি স্বাক্ষর করেন।

মানবাধিকার নিয়ে তার এই অসামান্য কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০২ সালে লান্নান ফাউন্ডেশন কর্তৃক ‘সাংস্কৃতিক মুক্তি পুরস্কার’ পান তিনি। ২০০৪ সালে ‘সিডনি শান্তি পুরস্কার’, ২০০৬ সালে ইন্ডিয়ান অ্যাকাডেমি অব লেটারস কর্তৃক ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ এবং ২০১১ সালে ‘নরম্যান মেইলার পুরস্কার’ লাভ করেন অরুন্ধতী।

তবে শিল্প শ্রমিকদের প্রতি ভারত সরকারের সহিংস আচরণ ও নিষ্ঠুর নীতি, সামরিকীকরণ বৃদ্ধি এবং অর্থনৈতিক নব্য-উদারীকরণ নীতির প্রতিবাদে তিনি ২০০৬ সালে দেয়া ‘সাহিত্য অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ড’ নিতে অস্বীকার করেছিলেন।

এভাবেই বঞ্চিত ও নিপীড়িত মানুষের অধিকারের জন্য এখনো নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন একবিংশ শতাব্দীর কলম যোদ্ধা অরুন্ধতী রায়।

‘আমার কোনো বিশেষ লক্ষ্য-উদ্দেশ্য নেই। আমি ক্যারিয়ারবাদী ব্যক্তি নই। আর আমি ক্যারিয়ার নামক কোনো জায়গায় যাওয়ার চেষ্টাও করছি না। আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো- সমাজের স্পর্শে থাকা, সমাজের মধ্যেই বেঁচে থাকা, ভিন্ন কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করা’- সংযুক্ত আরব আমিরাতের শারজায় আন্তর্জাতিক বই মেলায় এভাবেই নিজের কথাগুলো তুলে ধরেন অরুন্ধতী রায়।

 

ইন্টারনেট অবলম্বনে লিখেছেন এনামুল হক।

 

টাইমস/এসআই

 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ডেঙ্গুতে আরও একজনের মৃত্যু Jul 03, 2025
img
পরিচালকের বিরুদ্ধে বিস্ফোরক অভিযোগ শার্লিজের Jul 03, 2025
পঞ্চগড়ে দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রার তৃতীয় দিনে যা বললেন নাহিদ Jul 03, 2025
ইতালীয় নাগরিক হত্যাকাণ্ডে জড়িত ৩ জনের যাবজ্জীবন,৪ জন খালাস Jul 03, 2025
ভ্রমণ নিষেধাজ্ঞায় স্তব্ধ দেশের আন্তর্জাতিক পর্যটন! Jul 03, 2025
স্ত্রীর কাছ থেকে কিডনি পেয়েই পরকীয়ায় জড়ালেন স্বামী! Jul 03, 2025
উত্তরসূরি নির্বাচনের ঘোষণা দালাই লামার, বাগড়া দিলো চীন Jul 03, 2025
‘একটা সংলাপও ঠিকমতো বলতে পারো না’ ছেলেকে অমিতাভের খোঁচা Jul 03, 2025
img
সংসদে হিম্মত নিয়ে কথা বলার মতো নেতা আমাদের নেই : ফারুক হাসান Jul 03, 2025
img
ইউক্রেনের হামলায় নিহত রাশিয়ার নৌবাহিনীর উপপ্রধান Jul 03, 2025
img
‘গরুর মাংস খান রণবীর’, ভারতজুড়ে বি-র্ত-ক Jul 03, 2025
img
জায়েদ খানের সঙ্গে আসছেন অভিনেত্রী তানজিন তিশা Jul 03, 2025
img
এডিট করে দে সমস্যা নাই, কিন্তু জাতের কারও ছবি দে: শবনম ফারিয়া Jul 03, 2025
img
কঙ্গনার অভিযোগ, নগ্ন ছবি চাইতেন হৃতিক Jul 03, 2025
img
চলচ্চিত্র অনুদান কমিটি থেকে সরে দাঁড়ালেন মম Jul 03, 2025
img
২ এপ্রিলকে অটিজম সচেতনতা দিবস করার সিদ্ধান্ত Jul 03, 2025
img
বাংকার ধ্বংসে সক্ষম ক্ষেপণাস্ত্র তৈরি করছে ভারত Jul 03, 2025
img
চঞ্চলের গুণমুগ্ধ সাদিয়া, পোস্টে প্রকাশ করলেন কৃতজ্ঞতা Jul 03, 2025
img
জোতার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করলেন রোনালদো Jul 03, 2025
img
গুমের অভিযোগ প্রমাণিত হলে সেনা সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা Jul 03, 2025