যুদ্ধে ব্যয় না করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ খরচ করলে বিশ্ব রক্ষা পাবে: প্রধানমন্ত্রী

যুদ্ধে ব্যয় না করে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় অর্থ খরচ করলে বিশ্ব রক্ষা পাবে বলে মন্তব্য করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সোমবার (২২ এপ্রিল) রাজধানীর চীন মৈত্রি সম্মেলন কেন্দ্রে ন্যাপ এক্সপো-২০২৪ এবং বাংলাদেশ ক্লাইমেট ডেভলাপমেন্ট পার্টনারশিপের (বিসিডিপি) উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশে সংঘটিত ১৯৭০ সালে মহাপ্রলয়ংকরী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসে প্রায় পাঁচ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়েছিল। ’৯১ সালে আরেকটি ঘূর্ণিঝড়ে দুই লাখ মানুষ মারা যায়। কিন্তু ২০২৩ সালে ঘূর্ণিঝড় ‘মোখা’য় কোনো প্রাণহানি ঘটেনি। এটি জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন এবং দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাসে বাংলাদেশের সক্ষমতার বহিঃপ্রকাশ।

তিনি বলেন, গত ১৫ বছরে পার্বত্য ও শাল বনাঞ্চলের প্রায় এক লাখ ২৭ হাজার ৫৪৮ হেক্টর এলাকায় বৃক্ষরোপণসহ ৮৯ হাজার ৮৫৩ হেক্টর উপকূলীয় বন সৃজন করা হয়েছে। স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে আমরা সামাজিক বনায়ন বিধিমালা ২০১০ (সংশোধিত) প্রণয়ন করেছি। জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারের জন্য কক্সবাজার জেলায় আমরা বিশ্বের বৃহত্তম ‘খুরুশকুল বিশেষ আশ্রয়ণ প্রকল্প’ নির্মাণ করেছি।

প্রকল্পটির আওতায় ১৩৯টি বহুতল ভবন নির্মাণ করে চার হাজার ৪০৯টি জলবায়ু উদ্বাস্তু পরিবারকে পুনর্বাসনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, এছাড়াও আমরা জলবায়ু উদ্বাস্তু, প্রাকৃতিক দুর্যোগে ভূমিহীন, গৃহহীন, সমাজের পিছিয়ে পড়া অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষকে জমিসহ ঘর প্রদান করেছি এবং তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করা হয়েছে। এ পর্যন্ত আমরা প্রায় ৪২ লাখ মানুষকে পুনর্বাসন করেছি। ঢাকায় গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপ্টেশনের দক্ষিণ এশিয়া আঞ্চলিক অফিসের মাধ্যমে সর্বোত্তম অনুশীলনগুলো ভাগ করে নেয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে।

সরকারপ্রধান বলেন, বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণে আমাদের অবদান শূন্য দশমিক ৪৮ শতাংশের কম হলেও এর নেতিবাচক প্রভাবে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশসমূহের মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের এই বিরূপ প্রভাব আমাদের সম্ভাব্য উন্নয়ন এবং অর্থনৈতিক সমৃদ্ধির জন্য হুমকি হিসেবে দেখা দিয়েছে। অব্যাহত বৈশ্বিক উষ্ণায়নের ফলে সমুদ্রতলের উচ্চতা, লবণাক্ততা বৃদ্ধি পাচ্ছে। এর ফলে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল যা দেশের মোট আয়তনের প্রায় ১২-১৭ শতাংশ, এ শতাব্দীর শেষদিকে সমুদ্রগর্ভে নিমজ্জিত হওয়ার ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে।

বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমিত রাখার আহ্বান জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসে বাংলাদেশ ২০১৫ সালে ‘Intended Nationally Determind Contribution (INDC)’ প্রণয়ন করে এবং ২০২১ সালে তা হালনাগাদ করে ইউএনএফসিসিসিতে জমা দেয়। এতে আমরা শর্তহীন ৬ দশমিক ৭৩ এবং শর্তযুক্ত ১৫ দশমিক ১২ শতাংশ গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাসের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশে আমরা জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার হ্রাস করে নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার বৃদ্ধি করেছি, যাতে গ্রিন হাউস গ্যাস নিঃসরণ হ্রাস পায়। এ পর্যন্ত প্রায় ৬০ লাখ সোলার হোম সিস্টেম স্থাপন এবং গ্রামাঞ্চলে ৪৫ লাখেরও বেশি উন্নত চুলা বিতরণ করা হয়েছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০২৩ সালে মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্ল্যান (এমসিপিপি) প্রণয়ন করেছি। এতে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলা করে বিপদাপন্নতা থেকে সহিষ্ণুতা এবং সহিষ্ণুতা থেকে সমৃদ্ধি পর্যায়ে পৌঁছানোর লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়া এমসিপিপিতে অভিযোজন ও প্রশমন কার্যক্রমে স্থানীয় জনগণের স্বপ্রণোদিত অংশগ্রহণ, প্রকৃতিভিত্তিক সমাধান ও সমাজের সকলের অংশগ্রহণের ওপর গুরুত্বারোপ করা হয়েছে। বাংলাদেশ ইতোমধ্যে জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (এনএপি) ২০২২-২০৫০ প্রণয়ন করেছে। ২০২২ সালের অক্টোবরে এটি ইউএনএফসিসিসিতে দাখিল করা হয়েছে। এ পরিকল্পনায় আমরা ১১টি জলবায়ু ঝুঁকিযুক্ত এলাকাতে ৮টি খাতে ১১৩টি অগ্রাধিকারমূলক কার্যক্রম চিহ্নিত করেছি।

সরকারপ্রধান জানান, আগামী ২৭ বছরে এনএপি গৃহীত কর্মপরিকল্পনাসমূহ বাস্তবায়নের জন্য আমাদের প্রায় ২৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের প্রয়োজন। এজন্য সুনির্দিষ্ট তহবিল ও অতিরিক্ত আর্থিক সংস্থানের ব্যবস্থা গ্রহণে ধনী দেশ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

তিনি বলেন, উন্নত দেশসমূহ ব্যাপক কার্বন নিঃসরণের মাধ্যমে বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধিতে অধিক ভূমিকা রেখে চলেছে। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত জনগণকে রক্ষা করা তাদের নৈতিক দায়িত্ব। আমরা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সম্ভাব্য ক্ষতি হ্রাসে অভিযোজন ও প্রশমন উভয় ক্ষেত্রে উপযোগী কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছি। এক্ষেত্রে ইউএনএফসিসিসি -এর লাস অ্যান্ড ডেমেজ তহবিল থেকে অর্থ প্রাপ্তির জন্য বাংলাদেশ প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে।

এদিন অনুষ্ঠানে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিরাপদ ও সুন্দর পৃথিবী গড়ে তুলতে অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি করা, সহিষ্ণুতা শক্তিশালী করা এবং ঝুঁকি হ্রাসে সমন্বিতভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করাসহ বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী। সেগুলো হলো:

প্রথমত, প্রধান কার্বন-নির্গমনকারী দেশগুলিকে বিশ্বব্যাপী তাপমাত্রা বৃদ্ধি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখতে তাদের নির্গমন হ্রাস করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, উন্নত দেশগুলোর দ্বারা জলবায়ু তহবিলে বার্ষিক ১০০ বিলিয়ন ডলারের প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে হবে। সেই সঙ্গে অভিযোজন এবং প্রশমনের মধ্যে তা সমানভাবে বণ্টন করতে হবে। তৃতীয়ত, উন্নত দেশগুলোকে উন্নয়নশীল দেশগুলোতে প্রযুক্তি স্থানান্তরের পাশাপাশি সবচেয়ে কার্যকর জ্বালানি সমাধানে এগিয়ে আসতে হবে।

চতুর্থত, নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে রূপান্তরের সময়, সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর উন্নয়ন অগ্রাধিকারগুলো তাদের ক্ষতি অনুসারে বিবেচনা করা উচিত। পঞ্চমত, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, লবণাক্ততা বৃদ্ধি, নদী-ভাঙন, বন্যা এবং খরার কারণে বাস্তুচ্যুত মানুষদের পুনর্বাসনের দায়িত্ব সকল দেশকে ভাগ করে নিতে হবে এবং সবশেষে, প্রধান অর্থনীতিসমূহকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটি টেকসই ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করতে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে বিশ্বব্যাপী সকল অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করতে হবে।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
শাট ডাউনের মেয়াদ বাড়তে থাকলে সরকারি কর্মীদের ব্যাপক ছাঁটাই হতে পারে: হোয়াইট হাউস Oct 06, 2025
img
হংকংয়ের বিপক্ষে ম্যাচ খেলতে ঢাকায় পৌঁছেছেন হামজা চৌধুরী Oct 06, 2025
img
এনসিপি বলে এদেশে কিছু থাকবে না: সাংবাদিক ইলিয়াস Oct 06, 2025
img
শেখ সাদির সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক নিয়ে মুখ খুললেন পরীমনি Oct 06, 2025
img
বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেলের দাম বাড়ল ১.৫ শতাংশ Oct 06, 2025
img
এশিয়ার পারমাণবিক শক্তি উন্নয়নের অগ্রদূত বাংলাদেশ: রোসাটম Oct 06, 2025
img
জ্বালানি তেলের নতুন বাজার খুঁজে পেল রাশিয়া Oct 06, 2025
img
নাহিদের আখের গোছানোর অভিযোগে কারা রয়েছেন, প্রশ্ন জাহেদ উর রহমানের Oct 06, 2025
img
সেফ এক্সিট খুঁজতে উপদেষ্টাদের কষ্ট করতে হবে না : রুমিন ফারহানা Oct 06, 2025
img
‘বাপ-বেটা দুজনেই পাগল’, আরিয়ান খান প্রসঙ্গে করণ জোহর Oct 06, 2025
img
হত্যা মামলায় ৪ দিনের রিমান্ডে সাবেক শিক্ষামন্ত্রী দীপু মনি Oct 06, 2025
img
ফিনল্যান্ডের রাষ্ট্রপতির কাছে বাংলাদেশি দূতের পরিচয়পত্র পেশ Oct 06, 2025
img
আঘাত নয়, ভালোবাসা নিয়েই বিদায় নিতে চাই : তাহসান Oct 06, 2025
img
ইন্দোনেশিয়ায় স্কুল ভবন ধস, নিহতের সংখ্যা বেড়ে ৪৯ Oct 06, 2025
img
যেসব মার্কা হাসির খোরাক জোগায় তা ইসির তালিকায় থাকতে পারে না: সারজিস Oct 06, 2025
img
পিআর এর নামে একটি গোষ্ঠী আওয়ামী লীগকে ফিরিয়ে আনতে চায়: সরোয়ার আলমগীর Oct 06, 2025
img
গাজা যুদ্ধ বন্ধে সবাইকে ‘দ্রুত পদক্ষেপ’ নেয়ার আহ্বান ট্রাম্পের Oct 06, 2025
img
ভারতে হাসপাতালে আগুন, ৬ রোগীর মৃত্যু Oct 06, 2025
img
নেপালে ভারী বৃষ্টি ও আকস্মিক বন্যায় নিহত ৪৭ Oct 06, 2025
img
ইনশাআল্লাহ দ্রুতই দেশে ফিরে আসব : তারেক রহমান Oct 06, 2025