নির্বাচনের আগে পরে

আমাদের দেশের সবচেয়ে বড় ঘটনা হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ। যারা এই কথাটা বিশ্বাস করেন না কিংবা কথাটাকে যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ মনে করেন না, তাদের এই লেখাটির বাকী অংশ পড়ার কোনও প্রয়োজন নেই।

যারা এখনও পড়ছেন তারাও নিশ্চয়ই একটু অবাক হচ্ছেন। শুধু মার্চ মাসে না হয়, ডিসেম্বর মাসে গলা কাঁপিয়ে মুক্তিযুদ্ধের কথা বলার কথা, আমি এই অবেলায় মুক্তিযুদ্ধের প্রসঙ্গ তুলে আনছি কেন? বলা যেতে পারে এটা আমার একটা দুর্বলতা (কিংবা কে জানে, হয়তো এটা আমার একটা শক্তি!) আমি কখনোই মুক্তিযুদ্ধের বিষয়টা আমার মাথা থেকে সরাতে পারি না। মুক্তিযুদ্ধের সময়টুকু একেবারে নিজের চোখে দেখেছি বলে আমার ভেতরে (এবং আমার মতো অন্যদের ভেতরে) এমন একটা মৌলিক পরিবর্তন ঘটে গেছে। যেখান থেকে আমরা কখনোই আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারব না। সেই সময়টুকু ছিল একটা বিস্ময়কর সময়। মানুষ যে কতো ভালো হতে পারে, কতো নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগী হতে পারে, সেটা আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়।

আবার ঠিক একইভাবে মানুষ যে কতো খারাপ হতে পারে, কত নৃশংস এবং অমানুষ হতে পারে সেটাও আমরা দেখেছি মুক্তিযুদ্ধের সময়। তাই আমি জেনে হোক, না জেনে হোক, সবসময় সবকিছু বিচার করি আমার ‘মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার’ দিয়ে।

এদেশে যখন কোটাবিরোধী আন্দোলন শুরু হয়েছিল, আমার কাছে তখন সেটা একটা যৌক্তিক আন্দোলন মনে হয়েছিল। আমি তাদের পক্ষে লিখেছি এবং কথা বলেছি। হঠাৎ করে একদিন দেখি এই আন্দোলনকারী একজন নিজের বুকে ‘আমি রাজাকার’ লিখে সগর্বে দাঁড়িয়ে আছে মুহূর্তে আমার মন বিষিয়ে গেল।

আমি শুধু যে এই আন্দোলন নিয়ে সমস্ত উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম তা নয়, আমার মনে হতে থাকলো নিশ্চয়ই আমরা কোথাও বড় কোনো ভুল করেছি তা না হলে কেমন করে বাংলাদেশের তরুণ প্রজন্ম নিজেকে রাজাকার হিসেবে ঘোষণা দিতে পারে? কম বয়সী ছেলেমেয়ে আমার কিছু পাঠক আছে তাদের জন্যে প্রতি বছর বইমেলার আগে আমার কয়েকটা বই লিখতে হয়। এই বছর সবকিছু ফেলে বই মেলার আগেই আমি রাজাকার নিয়ে একটি বই লিখেছি। আমার মনে হয়েছে রাজাকার কী ‘চিজ’ সেটা আমার সবাইকে জানানো উচিৎ, যেন ভবিষ্যতে কেউ এই দেশের মাটিতে দাঁড়িয়ে নিজেকে রাজাকার পরিচয় দেওয়ার নির্বোধ দু:সাহস দেখাতে আগ্রহী না হয়।

কাজেই এই বছর যখন নির্বাচন এগিয়ে আসছে আমি আবার আমার চোখে মুক্তিযুদ্ধের ফিল্টার লাগানো চশমাটি পরে ডানে-বায়ে তাকাতে শুরু করেছি। কী দেখছি সেটি আলোচনা করার জন্য আমার এই লেখা।

নির্বাচনের তিনটা পর্যায়, নির্বাচনের আগে, নির্বাচনের সময় এবং নির্বাচনের পরে। এখন পত্র-পত্রিকায়, সংবাদ-মিডিয়া, টক শো আলোচনা সবকিছুই হচ্ছে নির্বাচনের সময় পর্যায়টি নিয়ে। জোট তৈরি হচ্ছে, ফ্রন্ট তৈরি হচ্ছে, জোট থেকে কেউ বের হয়ে যাচ্ছে, কেউ ঢুকে যাচ্ছে। নূতন নূতন দফা তৈরি হচ্ছে, দাবি তৈরি হচ্ছে ইত্যাদি ইত্যাদি।

আমার কেন জানি মনে হয়, নির্বাচনের সময় কী একেবারে এক কথায় বলে দেওয়া সম্ভব পারলে আদায় করে নাও! শুধু যে বাংলাদেশের জন্যে সেটা সত্যি তা নয়, সারা পৃথিবীর জন্যেই এটা সত্যি, পৃথিবীতে কেউ যুক্তি-তর্ক শুনে ভালো মানুষের মতো কিছু ছেড়ে দেয় না, তার কাছ থেকে আদায় করে নিতে হয়।

ছোট বাচ্চা গলা ফাটিয়ে না চেঁচানো পর্যন্ত মাও তার বাচ্চাকে দুধ খাওয়ায় না! কাজেই নির্বাচনের সময় কী চায়, না চায়- তার দাবি দাওয়া নিয়ে আমাদের কিছু বলার নেই। আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছি সেই দাবি দাওয়া আদায় করা সম্ভব হয় কীনা সেটা দেখার জন্য।

তবে নির্বাচনের আগের সময় এবং নির্বাচনের পরের সময়টুকু নিয়ে আমার আগ্রহ আছে, কিছু বলারও আছে।

নির্বাচনের আগের সময় নিয়ে আমার খুবই মৌলিক একটা প্রশ্ন, যারা বাংলাদেশ চায় নাই তাদের কী বাংলাদেশের নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অধিকার আছে? উদাহরণ জামাতে-ইসলামী। একাত্তরে তারা শুধু পত্রপত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেনি, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পদলেহী হয়ে হাতে অস্ত্র নিয়ে রাজাকার বাহিনী আর বদর বাহিনী তৈরি করে মানুষ মেরে গ্রাম জ্বালিয়ে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছিল। স্বাধীনতার পর এই দেশে তাদের রাজনীতি করার অধিকার ছিল না, প্রাণ বাঁচানোর জন্য গর্তে লুকিয়েছিল। তখন এলো পনেরোই অগাস্ট উনিশ শ পঁচাত্তর, বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করেই শেষ হয়ে গেল না, জেলখানায় চার নেতাকে হত্যা করে আওয়ামী লীগকে পুরোপুরি নেতৃত্বহীন করে দেওয়ার চেষ্টা করা হলো।

তখন এই দেশের ইতিহাসের সবচেয়ে ভয়ংকর ঘটনাটি ঘটল, বাংলাদেশ অ্যাবাউট টার্ন করে পুরোপুরি উল্টোদিকে পাকিস্তানের পথে যাত্রা শুরু করল। নেতৃত্ব দিলেন জেনারেল জিয়াউর রহমান। জেলখানা থেকে যুদ্ধপরাধীরা ছাড়া পেয়ে গেল, তারা রাজনীতি করা শুরু করল। আমাদের এতো স্বপ্নের বাংলাদেশটি জানি কেমন হয়ে গেল। মিলিটারি জেনারেল হয়ে দেশ শাসন করলে ভালো দেখায় না, গণতন্ত্রের ভান করতে হয় তাই জন্ম নিল বিএনপির।

বিএনপির নেতা কর্মী সমর্থক- তারা কি এই রাজনৈতিক দলটির এই জন্ম ইতিহাসের গ্লানি অস্বীকার করতে পারবে? এখানেই কি শেষ? বাংলাদেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলা শুরু হলো, টেলিভিশনে রাজাকার বলা যাবে না, পাকিস্তান সেনাবাহিনী বলা যাবে না, হানাদার বাহিনী বলতে হবে, দেশের স্থপতি বঙ্গবন্ধুকে শুধু টেলিভিশন নয়, সম্ভব হলে পুরো দেশ থেকে নির্বাসন দেয়া হলো। এখানেই শেষ নয়, আমরা দেখলাম একদিন জামাতে ইসলামী ও বিএনপি এর জোট হয়ে গেল। সিন্দাবাদের সেই বুড়োর মতন জামাতে ইসলামী সেই যে বিএনপি এর ঘাড়ে চেপে বসে তার গলা চিপে ধরেছে সেখান থেকে আর তাদের মুক্তি নেই।

নির্বাচনের আগে এখন নানা রকম জোট হচ্ছে, নানা রকম ফ্রন্ট হচ্ছে, এই সময়ে আমি যদি একেবারে পরিষ্কার বাংলায় শুনতে চাই মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ নিয়ে তাদের বক্তব্য কী- কেউ কি আমার মুখ বন্ধ করতে পারবে? আমি কী বলি তাতে কিছু আসে যায় না। কিন্তু কেউ আমার বিশ্বাস থেকে এক বিন্দু সরাতে পারবে না। যত বড় জোট কিংবা যত বড় ফ্রন্টই হোক না কেন তাদেরকে পরিষ্কার করে সোজা বাংলায় বলতে হবে- এই নির্বাচনে তাদের সাথে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধী যুদ্ধাপরাধীর দল জামাতে ইসলামী আছে কী নেই। যতক্ষণ সেটি না হচ্ছে, কারো জন্যে আমার ভেতরে কোনো সম্মানবোধ নেই, কোনো বিশ্বাস নেই।

এবারে আমি নির্বাচনের পরের পর্যায়টি নিয়ে। সবাই কী জানে যতই নির্বাচন এগিয়ে আসছে, এই দেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষজনের বুকের ভেতর এক ধরনের অশান্তি, এক ধরনের দুর্ভাবনা দানা বাঁধতে শুরু করেছে? সবার কী মনে আছে, শেষবার যখন জামাত-বিএনপি নির্বাচনে জয় লাভ করেছিল তখন এই দেশের মাটিতে কী ঘটেছিল? মানুষের ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক রূপটি আমি প্রথম দেখেছিলাম উনিশ শ একাত্তর সালে।

জুন-জুলাই মাসে নানা জায়গায় তাড়া খেয়ে আমরা গহীন একটা গ্রামে একজন ধর্মভীরু মানুষের বাড়িতে আশ্রয় নিয়েছি। সেই গহীন গ্রামেও একদিন পাকিস্তান মিলিটারি হানা দিয়েছে, মানুষকে গুলি করে মারছে বাড়ি পুড়িয়ে দিচ্ছে। ঠিক তখন দেখলাম একজন হিন্দু যুবক, তার স্ত্রীর কোলে একটি ছোট শিশু, ভয়ংকর আতঙ্কে প্রাণ বাঁচাতে ছুটে যাচ্ছে। আমার মা তাদের থামালেন, অভয় দিলেন তারপর তাদের একটু টাকা পয়সা দিলেন। পাশেই একজন দাাঁড়িয়ে ছিল, সে অবাক হয়ে আমার মাকে বলল, “এরা হিন্দু, এদেরকে সাহায্য করলে কোনো সওয়াব হবে না! কেন এদের টাকা পয়সা দিচ্ছেন?” আমার মা কী উত্তর দেবেন জানেন না, অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলেন।

বলা যেতে পারে সেই প্রথমবার আমি টের পেলাম মানুষকে ধর্ম দিয়ে ভাগ করে ফেলা যায়। নিজ ধর্মের মানুষের জন্যে গভীর মমতা এবং ভালোবাসা থাকা সম্ভব, আবার অন্য ধর্মের মানুষকে একেবারে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা না করা সম্ভব। যখন অন্য ধর্মের মানুষকে মানুষ হিসেবেই বিবেচনা করা হয় না, তখন তাদের প্রতি কী পরিমাণ নৃশংসতা করা সম্ভব সেটা আমরা দেখেছি। নির্বাচনের পর ঠিক সেই ব্যাপারটা ঘটেছিল, ভবিষ্যতে আবার ঘটবে না সেটা কে গ্যারান্টি দিতে পারবে?

আমি সব সময়েই স্বপ্ন দেখি আমাদের দেশের সবাই রাজনীতি করতে মুক্তিযুদ্ধকে বুকে ধারণ করে। সেটি তো আর অযৌক্তিক কোনো কথা নয়। বাংলাদেশটার জন্মই হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধ দিয়ে, তাই সেই আদর্শটা নিয়েই যদি রাজনীতি করা হয়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে আমাদের ভেতর কোনো দুর্ভাবনা থাকবে না কোনো দুশ্চিন্তা থাকবে না।

কেন জানি মনে হয় ব্যাপারটা হয়তো খুব কঠিন নয়!

Share this news on:

সর্বশেষ

img
সেবায় নৈতিকতা-মানবিক মূল্যবোধকে প্রাধান্য দেওয়ার আহ্বান বিএমইউ ভিসির Sep 15, 2025
img
গাজা সিটিতে জাতিসংঘের ১০টি ভবন ধ্বংস করেছে ইসরাইল Sep 15, 2025
img
রামেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে প্রাণ গেল ১ জনের, ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি ১৩ Sep 15, 2025
img
ফিফার কাছে রেফারিদের বিরুদ্ধে নালিশ করবে রিয়াল মাদ্রিদ Sep 15, 2025
img
সারা দেশে শুরু হলো একাদশ শ্রেণির ক্লাস Sep 15, 2025
img

জুলাই গণঅভ্যুত্থান

আহত ও শহীদ পরিবারের আত্মকর্মসংস্থান সৃষ্টিতে সহযোগিতা করা হবে: আসিফ মাহমুদ Sep 15, 2025
img
পুলিশে ফের বড় রদবদল Sep 15, 2025
img
আফতাবনগর-বনশ্রীতে ৩ সেতুর নির্মাণ কাজের উদ্বোধন Sep 15, 2025
img
ভুল করলে যৌক্তিক সমালোচনা করতেও ছাড়বেন না : হামিম Sep 15, 2025
img
শুল্ক না কমালে ব্যবসা করা কঠিন হয়ে উঠবে ভারতের Sep 15, 2025
img
সরকারি চাকরিজীবীদের পে-স্কেল নিয়ে নতুন নির্দেশনা প্রধান উপদেষ্টার Sep 15, 2025
img
দেড় মাসে ১১৩ কোটি ডলার কিনেছে বাংলাদেশ ব্যাংক Sep 15, 2025
img
তরুণরা সক্রিয় থাকলে দেশের কোনো সমস্যা অমীমাংসিত থাকতে পারে না : প্রধান উপদেষ্টা Sep 15, 2025
img
বলিউড দুনিয়ার কালো অধ্যায় সামনে আনলেন প্রিয়াঙ্কা চোপড়া Sep 15, 2025
img
ডিজিটাল লেনদেনে কমবে দুর্নীতি ও অর্থ পাচার : গভর্নর Sep 15, 2025
img
জামায়াতে ইসলামীর ৩ দিনের কর্মসূচি ঘোষণা Sep 15, 2025
img
ভারতের আচরণ স্পোর্টসম্যানশিপের পরিপন্থী : মহসিন নাকভি Sep 15, 2025
img
ভাঙ্গায় আসন পুনর্বিন্যাস নিয়ে আবারও দুই মহাসড়ক অবরোধ Sep 15, 2025
img
গুরুতর অভিযোগে গুগলের বিরুদ্ধে মামলা Sep 15, 2025
img
অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধানের মৌলিক রদবদল করার ম্যান্ডেট রাখে না : জিল্লুর রহমান Sep 15, 2025