হাসপাতাল থেকে উঠে যেভাবে দেশের দায়িত্বভার কাঁধে নিলেন, জানালেন ড. ইউনূস

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃত্বে সংঘটিত গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট যখন শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটলো, তখনও ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস। এর মধ্যেই তাকে ফোন করে দেশ পরিচালনার দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় সমন্বয়করা। চিকিৎসাধীন থাকা অবস্থায় এমন একটি চ্যালেঞ্জিং দায়িত্ব নেওয়ার জন্য কীভাবে নিজের মনকে প্রস্তুত করলেন, জুলাই বিপ্লবে আন্দোলনকারী ছাত্র-জনতার বিজয় কীভাবে তার চিত্তকে আলোড়িত করেছিল, সেসব নিয়েই সম্প্রতি খোলামেলা কথা বলেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূস।

বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বার্ষিক সম্মেলন উপলক্ষে সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের দাভোস সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা। সে সময় ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিন্যান্সিয়াল টাইমসের বৈদেশিকবিষয়ক প্রধান ভাষ্যকার গিডেয়েন রাখমানের উপস্থাপনায় একটি পডকাস্টে এ বিষয়ে কথা বলেন তিনি।

‘রাখমান রিভিউ’ নামের ওই পডকাস্ট অনুষ্ঠানে ড. ইউনূসের সেই আলাপচারিতা লিখিত আকারে প্রকাশ করা হয়েছে গতকাল বৃহস্পতিবার (৩০ জানুয়ারি)।

সেখানে ড. ইউনূস বলেন, আমি যখন প্রথম ফোনকল পাই, তখন আমি প্যারিসের হাসপাতালে ছিলাম। আমার ছোট্ট একটি অস্ত্রোপচার করা হয়েছিল। তখন তারা (ছাত্রনেতারা) ফোন দিল। যদিও আমি বাংলাদেশে কী ঘটছে, সেসব খবর প্রতিদিন মুঠোফোনে দেখতাম। তখন তারা বলল, “তিনি (শেখ হাসিনা) চলে গেছেন। এখন আমাদের সরকার গঠন করতে হবে। দয়া করে, আমাদের জন্য সরকার গঠন করুন।” আমি বলেছিলাম, না, আমি সেই ব্যক্তি নই। আমি এর কিছুই জানি না। আমি এর সঙ্গে যুক্ত হতেও চাই না।

কারা আপনার সঙ্গে যোগাযোগ করেছিল—এমন প্রশ্নের জবাবে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, ‘শিক্ষার্থীরা। আমি তাদের কাউকেই চিনতাম না। কখনো তাদের সম্পর্কে শুনিনি। কাজেই আমি তাদের বিকল্প কাউকে খোঁজার বিষয়ে বোঝানোর চেষ্টা করছিলাম। তাদের বলেছিলাম, বাংলাদেশে অনেক ভালো নেতা আছেন। তোমরা তাদের খুঁজে নাও। তারা বলছিল, “না, না, না, আপনাকেই থাকতে হবে। আমরা কাউকে পাইনি।” আমি বলেছিলাম, জোরালো চেষ্টা করো। তারা বলল, “আমাদের হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই।” তখন বলেছিলাম, অন্তত একটা দিন চেষ্টা করো। না পেলে ২৪ ঘণ্টা পর আমাকে আবার ফোন করো।

প্রধান উপদেষ্টা বলেন, তারা (ছাত্রনেতারা) আমাকে আবারও ফোন করল; বলল, “আমরা অনেক চেষ্টা করেছি। কিন্তু সম্ভব হয়নি। আপনাকে অবশ্যই দেশে ফিরতে হবে।” শেষ পর্যন্ত আমি বললাম, দেখো, তোমরা রাজপথে জীবন দিয়েছো। প্রচুর রক্তক্ষয় হয়েছে। তোমরা সম্মুখসারিতে আছো। যেহেতু তোমরা এসব করতে পেরেছ, এখন ইচ্ছা না থাকলেও তোমাদের জন্য আমারও কিছু করা উচিত। আর এটাই সেই সময়। সরকারের সংস্কার করতে হবে। আমি রাজি। তোমরা কি একমত? তারা আর কোনো কথা বলেনি।

সেই দিনের অভিজ্ঞতা জানাতে গিয়ে ড. ইউনূস বলেন, ঘণ্টা দুয়েক পর হাসপাতালের একজন নার্স এলেন। তিনি আমাকে একটি ফুলের তোড়া উপহার দিলেন। আমি বললাম, এটা কেন? তখন ওই নার্স বললেন, “আপনি বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’, আমরা এটা জানতাম না।” আমি বললাম, এটা আপনি কোথা থেকে জানলেন? তখন তিনি বললেন, “সব গণমাধ্যমে, সব টেলিভিশনে সংবাদ প্রচার হচ্ছে, আপনি বাংলাদেশের ‘প্রধানমন্ত্রী’।” আমি বললাম, আমি আপনার কাছ থেকেই এটা জানলাম।’

তিনি বলেন, এরও ঘণ্টা দুয়েক পর ওই বোর্ড সদস্যরাদসহ হাসপাতালের প্রধান আসেন। তারা ফুলের তোড়া দিয়ে নতুন ‘প্রধানমন্ত্রী’ হিসেবে আমাকে শুভেচ্ছা জানান। সঙ্গে এটাও বলেন যে বিকেলের আগে আমাকে হাসপাতাল ছাড়ার বিষয়ে অনুমতি দেওয়া হবে না।

অধ্যাপক ইউনূস বলেন, আমি পরিচালককে বলি, ওরা আমাকে চাইছে। দেশে যেতে বলছে। ভ্রমণের জন্য আপনি কি আমাকে প্রস্তুত করে দিতে পারেন? তিনি বললেন, “অবশ্যই, আপনার কথা আমাদের মানতে হবে। আপনি একজন প্রধানমন্ত্রী। আপনার নিরাপদ যাত্রার জন্য আমরা সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করে দেব। প্রয়োজনীয় ওষুধসহ সবকিছু দেব। সার্বক্ষণিক যোগাযোগে থাকব।”

ড. ইউনূস বলেন, এর কয়েক ঘণ্টা পর, সকালে ফরাসি সেনাবাহিনীর বড় একটি দল আমাকে বিমানবন্দরে পৌঁছে দিতে আসে। এটাই ছিল দেশে ফেরার আগের ঘটনাবলি। পুরো জাতি আমার ফেরার উড়োজাহাজের অপেক্ষায় ছিল। বাণিজ্যিক উড়োজাহাজে যাত্রা করেছিলাম। তখন তারা (ছাত্রনেতারা) নতুন সরকারের রূপরেখা দাঁড় করিয়ে ফেলেছে। আমি বিমানবন্দর থেকেই জাতির সামনে ভাষণ দিলাম। সবাইকে ধৈর্য, শান্তি, একতা বজায় রাখতে বললাম। এটাই ছিল পুরো ঘটনার শুরু।

Share this news on:

সর্বশেষ

img
পুরোনো সম্পর্ককে পেছনে ফেলে এবার কি নতুন শুরু লায়লার! Sep 19, 2025
img
ওল্ড ডিওএইচএস থেকে কাউন্সিলর হলেন তামিম Sep 19, 2025
img
আনুশকা শেঠির ঘাটি এবার আসছে অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওতে Sep 19, 2025
img
দেশে স্বর্ণ ও রুপার আজকের বাজারদর Sep 19, 2025
img
আফগানিস্তানের পাঁচ প্রদেশে ইন্টারনেট বন্ধ Sep 19, 2025
img
নাগার্জুনার শততম ছবিতে আবারও আক্কিনেনি পরিবারের মিলন মেলা Sep 19, 2025
img
মোদির জীবনীভিত্তিক চলচ্চিত্র 'মা বন্দে' ঘোষণা Sep 19, 2025
img
জনগণের ভোটেই আমরা সরকার গঠন করতে চাই: আফরোজা আব্বাস Sep 19, 2025
img
জামায়াতের সুরে কথা বলতে গিয়ে বাদ পড়েছে এনসিপি-বাগছাস: জিল্লুর রহমান Sep 19, 2025
img
পুতিনের ওপর আবারও হতাশা প্রকাশ করলেন ট্রাম্প Sep 19, 2025
img
শাহরিয়ার ইমন থেকে সালমান শাহ নামের পেছনের গল্প Sep 19, 2025
img
ব্যক্তিজীবনের প্রেম-বিচ্ছেদ নিয়ে মুখ খুললেন তানিশা মুখার্জি Sep 19, 2025
img
শুরু হলো দৃশ্যম ৩-এর শুটিং Sep 19, 2025
img
রাজনীতির শুরুতেই মামলায় জড়ালেন থালাপতি বিজয় Sep 19, 2025
img
লিবিয়ায় মাফিয়াদের গুলিতে প্রাণ হারালেন মাদারীপুরের জীবন Sep 19, 2025
img
এশিয়া কাপের সুপার ফোরের সময়সূচি প্রকাশ Sep 19, 2025
img
অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে: ড. ইউনূস Sep 19, 2025
img
পাকিস্তান-সৌদি প্রতিরক্ষা চুক্তির পরই তেহরান-রিয়াদের দ্বিপক্ষীয় যোগাযোগ Sep 19, 2025
img
জাতীয় দলের পেসার এবাদত হোসেনের বাবা আর নেই Sep 19, 2025
img
চাকসু নির্বাচনে শিবিরের প্যানেলে ৫ নারী, ১ হিন্দু শিক্ষার্থী Sep 19, 2025