ট্রাম্পের শুল্কনীতিতে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত ভিয়েতনাম

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কঠোর শুল্কনীতি নিয়ে ইতোমধ্যেই বিশ্বজুড়ে চাঞ্চল্য ছড়িয়ে পড়েছে। তবে সবচেয়ে বড় চাপে পড়তে যাচ্ছে ভিয়েতনাম।

আগামী ৯ এপ্রিল থেকে দেশটির রফতানির ওপর ৪৬ শতাংশ ‘পারস্পরিক’ শুল্ক কার্যকর করতে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। এর মূল কারণ হিসেবে তুলে ধরা হচ্ছে—২০২৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভিয়েতনামের ১২৩ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য উদ্বৃত্ত।

যদিও ভিয়েতনামের অনেকেই শুল্ক বৃদ্ধির শঙ্কা করছিলেন, তবু ট্রাম্প প্রশাসনের এমন কড়াকড়ি সিদ্ধান্তে অনেকেই বিস্মিত। এরই মধ্যে এর প্রভাব পড়তে শুরু করেছে দেশটির অর্থনীতিতে। শুল্ক ঘোষণার পরদিনই হো চি মিন স্টক ইনডেক্সে রেকর্ড পতন ঘটে—একদিনেই সূচক হারায় সাত শতাংশ, যা গত ২০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বড় ধাক্কা।

এই পরিস্থিতিতে ভিয়েতনামের সামনে এখন বড় চ্যালেঞ্জ—বিশ্ববাজারে নিজের অবস্থান ধরে রাখা এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে নতুনভাবে বাণিজ্য সম্পর্ক নির্ধারণ করা।

ট্রাম্পের এই শুল্ক ভিয়েতনামের রপ্তানিনির্ভর অর্থনৈতিক কাঠামোর একেবারে গোড়ায় আঘাত করবে। গত এক দশকে (মহামারি বাদে) দেশটির অর্থনীতি গড়ে সাত শতাংশ হারে বেড়েছে, এর পেছনে মূল ভূমিকা রেখেছে চীন থেকে উৎপাদন স্থানান্তর। যুক্তরাষ্ট্রে বিক্রি ভিয়েতনামের মোট রপ্তানির ৩০ শতাংশ এবং মোট জিডিপির ২৭ শতাংশ।

চীনে প্রকৃত মজুরি বাড়ায় বহু প্রতিষ্ঠান অপেক্ষাকৃত সস্তা শ্রম এবং দক্ষ জনশক্তির কারণে ভিয়েতনামকে বেছে নেয়। অনেকে ‘চায়না-প্লাস-ওয়ান’ কৌশলের অংশ হিসেবে সরবরাহ চেইনের একটি অংশ ভিয়েতনামে গড়ে তোলে। স্যামসাং ও নাইকির মতো কোম্পানিগুলো বড় বিনিয়োগ করেছে সেখানে। বিশেষ করে পাদুকা, খেলনা ও ক্রীড়া সামগ্রীর শিল্প সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে—ভিয়েতনামে উৎপাদিত এই পণ্যের যথাক্রমে ৩৭ ও ৫২ শতাংশই যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়।

এর ফলে দেশটির ওপর মার্কিন শুল্কের প্রভাব ভয়াবহ হতে পারে। অক্সফোর্ড ইকোনমিকসের এক পূর্বাভাস বলছে, ‘সেরা পরিস্থিতিতে’—যেখানে যুক্তরাষ্ট্রে মন্দা না হয়, বাণিজ্যিক পাল্টা প্রতিক্রিয়া না আসে এবং অনিশ্চয়তায় বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত না হয়—তাতেও ২০২৬ সাল নাগাদ ভিয়েতনামের উৎপাদন ৩ দশমিক ৫ শতাংশ কমে যাবে। এর অর্থ, দেশটির প্রবৃদ্ধির হার প্রায় অর্ধেকে নেমে আসবে।
পাশাপাশি, ‘চায়না-প্লাস-ওয়ান’ কৌশলের যৌক্তিকতাও দুর্বল হয়ে যাবে। কারণ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সঙ্গে চীনের শুল্ক ব্যবধান কমে এসেছে।

ট্রাম্পের ঘোষণা আসার আগেই তার সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা শুরু করেছিল ভিয়েতনাম। ইলন মাস্কের স্টারলিংক ইন্টারনেট সেবা নিয়ে পরীক্ষামূলক চুক্তি হয়েছে; আগামী মে বা জুন থেকে সেখানে গ্রাউন্ড স্টেশন নির্মাণ শুরু হওয়ার কথা। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্রের তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি), গাড়ি, জ্বালানি ও কৃষিপণ্যে একতরফাভাবে শুল্ক কমিয়েছে ভিয়েতনাম। অনেক রাষ্ট্রায়ত্ত ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মার্কিন যন্ত্রপাতি কেনার চুক্তিও করেছে। রাজধানী হ্যানয় থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরে হুং ইয়েন প্রদেশে ট্রাম্প অর্গানাইজেশনের ১ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলারের গলফ কোর্স প্রকল্পের কাজও শুরু হচ্ছে আগামী মাসে।

তবে ভিয়েতনাম আরও এগিয়ে যেতে চায়। গত ৪ এপ্রিল ট্রাম্পের সঙ্গে দেশটির নেতা তো লাম ফোনে কথা বলেন। ট্রাম্প জানান, ভিয়েতনাম যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি সমঝোতা হলে সব শুল্ক শূন্য করতে চায়। যদিও ভিয়েতনামের বিবৃতি ছিল আরও সংযত; তারা পারস্পরিকভাবে শুল্ক শূন্যে নামিয়ে আনার প্রস্তাব দিয়েছে।

সিঙ্গাপুরের ইএসইএএস-ইউসুফ ইশাক ইনস্টিটিউটের এনজুয়েন খাক গিয়াং জানান, এখনই যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একটি বিস্তৃত বাণিজ্য চুক্তি আলোচনার জন্য ভিয়েতনামের কাছে সময়টি অনুকূল বলে বিবেচিত হচ্ছে। এরই মধ্যে দেশটির উপপ্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল ওয়াশিংটনে গেছে পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার শেষ চেষ্টা হিসেবে।

তবে ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি যদি একান্তই প্রতিরক্ষামূলক (প্রোটেকশনিস্ট) হয়, ভিয়েতনামের খুব বেশি কিছু দেওয়ার নেই। শেষ এক বছরে তারা যুক্তরাষ্ট্র থেকে মাত্র ১৬ বিলিয়ন ডলারের পণ্য আমদানি করেছে, যেগুলোর ওপর গড়ে তিন শতাংশ শুল্ক বসানো হয়েছে। এই হার শূন্যে নামালে বার্ষিক প্রায় এক বিলিয়ন ডলার রাজস্ব হারাতে হবে বলে গিয়াংয়ের অনুমান।

কিন্তু এতে যুক্তরাষ্ট্র খুশি হবে কি না, তা অনিশ্চিত। গত ৬ এপ্রিল ট্রাম্পের উপদেষ্টা এবং কট্টর প্রোটেকশনিস্ট পিটার নাভারো অভিযোগ করেছেন, শুল্ক বাদ দিলেও ভিয়েতনামের সঙ্গে ১২০ বিলিয়ন ডলারের ঘাটতি থাকবে, কারণ ‘তারা নানা ধরনের অশুল্ক প্রতারণা করে।’ তিনি ভিয়েতনামকে চীনা পণ্য পুনঃরপ্তানির জন্য একটি ‘কলোনি’ হিসেবেও আখ্যা দেন। এসব অভিযোগ সমাধান করা সহজ নয়, ৪৫ দিনের সময়সীমার মধ্যে তো আরও কঠিন। আর যুক্তরাষ্ট্রকে অতিরিক্ত সুবিধা দিতে গিয়ে ভিয়েতনামের ১৭টি অন্যান্য মুক্ত বাণিজ্য চুক্তিও ঝুঁকিতে পড়তে পারে।

ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গে শেষ পর্যন্ত কোনো সমঝোতা না হলেও ভিয়েতনাম কিছু বিষয়ে ইতিবাচক থাকতে পারে। প্রথমত, প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকারীরা হঠাৎ করে দেশ ছেড়ে যাবে না, কারণ এসব প্রকল্পে স্থায়ী খরচ অনেক বেশি এবং স্থানান্তরের জন্য সময় লাগে। দ্বিতীয়ত, রপ্তানিনির্ভর প্রবৃদ্ধিতে ধাক্কা লাগলে দেশটির মুদ্রা ‘ডং’-এর মান পড়ে যেতে পারে—যা অন্য বাজারে প্রতিযোগিতামূলক অবস্থান মজবুত করতে পারে।

ভিয়েতনামের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সাধারণত ডলার-ভিত্তিক মান বজায় রাখে, তবে এখন তা কিছুটা দুর্বল করতে হতে পারে। তবে ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে ভিয়েতনামকে ‘কারেন্সি ম্যানিপুলেটর’ বলার যে অভিযোগ ছিল, এই পদক্ষেপ নতুন করে সেই বিতর্ক উসকে দিতে পারে।

আরএ/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
দেশে মবের কোনো বিচার হচ্ছে না : মাসুদ কামাল Jul 07, 2025
img
ফের পাকিস্তানি তারকাদের নিয়ে কঠোর অবস্থানে ভারত Jul 07, 2025
img
৫ মাস পর জাতীয় নির্বাচন হবে ধরে নিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছে পুলিশ : স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা Jul 07, 2025
img
বিশ্বে বায়ুদূষণে শীর্ষ শহর কুয়েত সিটি, ঢাকার অবস্থান ২৬তম Jul 07, 2025
img
গাজা ইসরায়েলি বিমান হামলায় প্রাণ গেল আরও ৮১ জনের Jul 07, 2025
img
দেশের জাতীয় নিরাপত্তা রক্ষায় জনগণ ঐক্যবদ্ধ : মির্জা ফখরুল Jul 07, 2025
img
দুপুরের মধ্যে দেশের ৭ জেলায় ৬০ কি.মি. বেগে ঝড়ের পূর্বাভাস Jul 07, 2025
আ.লীগের নাম, তার ইতিহাস, তার অবদান ভুলে যাওয়া সম্ভব নয়: রনি Jul 07, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Jul 07, 2025
সীমান্তে দাদাদের বাহাদুরির দিন শেষ মন্তব্য নাহিদের Jul 07, 2025
img
টেক্সাসে বন্যায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৮২, নিখোঁজ ৪১ Jul 07, 2025
img
আজ ঢাকার যেসব এলাকায় ১১ ঘণ্টা গ্যাস সরবরাহ বন্ধ থাকবে Jul 07, 2025
‘সীমান্তে অনেক বাহাদুরি হয়েছে দাদাদের, সেই দিন শেষ’ Jul 07, 2025
img
‘আমরা আপনাদের নিরাশ করব না, বাংলাদেশকে বিশ্বমঞ্চে নিয়ে যেতে চাই’ সংবর্ধনায় ঋতুপর্ণা-আফঈদার প্রতিশ্রুতি Jul 07, 2025
img
নারী ফুটবলারদের সম্মানে মধ্যরাতে সংবর্ধনা দিল বাফুফে Jul 07, 2025
img
বিএনপির দুইপক্ষের অস্থিরতা, চিলমারীতে পুলিশের টহল জোরদার Jul 07, 2025
img
স্মৃতির ওজন নিয়ে রাম কাপুরের মন্তব্যে তীব্র বিতর্ক Jul 07, 2025
img
মণিরত্নমের পর এবার রণবীরের সঙ্গে! কে এই সারা অর্জুন? Jul 07, 2025
img
পাকুন্দিয়ায় দুর্নীতির অভিযোগে এসিল্যান্ডসহ ২৬ জনের বিরুদ্ধে মামলা Jul 07, 2025
img
জীবন থাকতে বাংলার মাটিতে ফ্যাসিবাদের কোন ধরনের পুনর্বাসনই আমরা হতে দিব না: হাসনাত আবদুল্লাহ Jul 07, 2025