সরকারকে ১০ প্রস্তাবনা দিল শিল্পীরা

শুক্রবার (১৮ এপ্রিল) সংস্কৃতি খাতে বাজেট বৃদ্ধি এবং এর কার্যকর ব্যবহারের জন্য নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবনার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির জাতীয় নাট্যশালার সেমিনার কক্ষে ‘সংস্কৃতি খাতে বাজেট পর্যালোচনা ও প্রস্তাবনা’ শিরোনামে একটি  সেমিনার হয়।

‘থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা’ আয়োজিত এই সেমিনারে দেশের  সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বরা অংশগ্রহণ করেন। এখানে ধারণাপত্র পাঠ করেন তৌফিকুল ইসলাম ইমন।

এতে বলা হয়, বাজেট কেবল আর্থিক বিষয় নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিফলন। সংস্কৃতিকে প্রগতিশীল জাতি গঠনের প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করলে সংস্কৃতিখাতে জাতীয় বাজেটের ১ শতাংশ বরাদ্দ সময়োপযোগী ও যৌক্তিক দাবি। এ জন্য যেমন রাষ্ট্রীয় সহযোগিতা প্রয়োজন, তেমনি সংস্কৃতি কর্মীদেরও সক্ষমতা অর্জন করতে হবে এবং দায়িত্ব নিতে হবে।

এখানে দশটি প্রস্তাবনা দেওয়া হয়। যেমন, ডিজিটাল আর্কাইভ ও ভার্চুয়াল প্রদর্শনীর অবকাঠামো নির্মাণ, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের সাংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর আর্থিক সহায়তা, লোকসংস্কৃতি ও নৃ-গোষ্ঠী সংস্কৃতির গবেষণাগার ও প্রতিষ্ঠান গঠন, বাংলা একাডেমি, শিশু একাডেমি ও শিল্পকলা একাডেমির আধুনিকায়ন, দক্ষ জনবল নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন, সংস্কৃতিসেবীদের জন্য পেনশন সুবিধা চালু, বিদেশে সংস্কৃতি কেন্দ্র স্থাপন ও সাংস্কৃতিক বিনিময় কার্যক্রম বাড়ানো, শিল্পী ও সংগঠনের অনুদান বাড়িয়ে কার্যকর বরাদ্দ নিশ্চিতকরণ, সংস্কৃতিখাতকে রেভিনিউ বাজেটে অন্তর্ভুক্ত করে ধারাবাহিকতা বজায় রাখা এবং সরঞ্জাম রক্ষণাবেক্ষণ ও অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য প্রয়োজনীয় বরাদ্দ।

আলোচকরা তাদের বক্তব্যে বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে সংস্কৃতি খাতে বাজেট বৃদ্ধির প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন। 

সেমিনারের প্রধান অতিথির দায়িত্ব পালন করা বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আনু মোহাম্মদ তার বক্তব্যে বলেন, যদি একজন শিল্পী স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশের  সুযোগ না পান, তাহলে সৃজনশীলতার জন্ম হয় না। শিল্প কেবল আনুগত্যের হাতিয়ার হয়ে পড়ে, যার কোনো গভীরতা থাকে না।

দেশে প্রাক-বাজেট আলোচনায় কৃষক, শ্রমিক, সংস্কৃতিকর্মীদের অংশগ্রণ থাকা উচিত বলে মনে করে তিনি। এ বিষয়ে তিনি বলেন, এ তিন শ্রেণিই সমাজের ভিত্তি। তাদের অভাব, তাদের বঞ্চনা এবং তাদের দাবিই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু নীতিনির্ধারক পরিসরে তাদের কোনো জায়গা নেই।

এরপর তিনি বলেন, উপজেলা পর্যায়ে সৃজনশীল সমাজ গঠনে লাইব্রেরি, খেলার মাঠ, নাটকের মঞ্চ এবং সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য অবকাঠামো থাকা জরুরি। তিনি উল্লেখ করেন যে, শিল্পী ও শিক্ষকদের সম্মান না থাকার কারণে সৃজনশীলতা বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।

সুজিত মোস্তফা সংগীতশিল্পীদের মর্যাদা, সম্মানী এবং তাদের জন্য একটি জাতীয় গ্রেডিং সিস্টেম প্রণয়নের উপর জোর দেন। তিনি বিশেষভাবে বেতার ও টেলিভিশন শিল্পীদের সম্মানী বৃদ্ধির পাশাপাশি, প্রাতিষ্ঠানিক প্রণোদনা, প্রশিক্ষকদের বেতন বৃদ্ধি এবং জাতীয় বাজেটে সংস্কৃতি খাতে ন্যূনতম ৪% বরাদ্দ রাখার দাবি জানান। তার মতে, বাজেট বরাদ্দ সাংস্কৃতিক বিনিয়োগ হিসেবে জাতির সৃজনশীলতা ও আত্মপরিচয়ের ভিত্তি নির্মাণে সহায়ক হবে।

তারিক আনাম খান তার বক্তব্যে বলেন, থিয়েটার খাতে বাজেট বৃদ্ধির প্রস্তাব  শুধু অর্থের বিষয় নয়, এটি সাংস্কৃতিক পরিচয় এবং সমাজ গঠনে শিল্পের গুরুত্বকে প্রতিফলিত করে।

অন্যদিকে মামুনুর রশিদ মঞ্চ নাটকের বাজেট ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা এবং সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের কাঠামোগত সমস্যা নিয়ে সমালোচনা করেন। তিনি বাজেট ও নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় স্বচ্ছতা এবং অংশগ্রহণমূলক ব্যবস্থা প্রস্তাব করেন, বিশেষভাবে নাট্যদল ও শিল্পীদের জন্য স্যালারি গ্রান্ট চালু করার কথা বলেন।

তিনি বলেন, মঞ্চ নাটক শুধুমাত্র বিনোদন নয়, একটি শিক্ষামূলক মাধ্যম হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ এবং এর বিকাশের জন্য আরও কার্যকরী নীতির প্রয়োজন।

সভাপতি আজাদ আবুল কালাম তার সমাপনী বক্তব্যে সেমিনারের লক্ষ্য হিসেবে সংস্কৃতির গুরুত্ব রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করার কথা বলেন। তিনি বলেন, আমরা প্রায়ই বিভিন্ন দাবি তুলে ধরি, কিন্তু সেই দাবি সুনির্দিষ্টভাবে কোথায়  পৌঁছাবে, কাকে লক্ষ্য করে বলছি, তা নির্ধারণ করি না। এই সেমিনার সুনির্দিষ্ট দাবি তৈরি করতে সহায়তা করেছে, যাতে বাজেটের বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যবহৃত হয়।

বাজেট বৃদ্ধির জন্য প্রস্তাবিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ দিক নিয়েও সেমিনারে আলোচনা করা হয়। যেমন, সংস্কৃতি খাতে বাজেট বৃদ্ধি, সংস্কৃতির প্রতি দীর্ঘমেয়াদী সরকারের নীতি, নতুন শিল্পী ও শিক্ষার্থীদের জন্য প্রশিক্ষণ, সৃজনশীল প্রকল্পের জন্য বাজেট বরাদ্দ, সংস্কৃতির ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে প্রসার, সংস্কৃতি কেন্দ্র এবং শিল্পকলা একাডেমি স্থাপন, সংস্কৃতি ও জনগণের মধ্যে সম্পর্ক দৃঢ়করণ, শিল্পীদের জন্য মাসিক সম্মানী, সংস্কৃতিক সংগঠনগুলোর মাসিক গ্রান্ট, শিল্পীদের সম্মান ও সন্মানী প্রদান, বহুমাত্রিক সাংস্কৃতিক প্রকল্প, সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, সংস্কৃতির প্রতি জনগণের আগ্রহ সৃষ্টি, সংস্কৃতির জন্য পরিকাঠামো উন্নয়ন এবং শিল্পীদের জন্য সামাজিক নিরাপত্তা।

প্রসঙ্গত, সেমিনারে সভাপতিত্ব করেন থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা’র সভাপতি আজাদ আবুল কালাম,  পরিচালনা করেন অপু শহীদ, সেক্রেটারি ইভেন্ট,  থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা, এবং ধারণাপত্র পাঠ করেন তৌফিকুল ইসলাম ইমন, সেক্রেটারি অর্গানাইজেশন, থিয়েটার আর্টিস্টস এসোসিয়েশন অব ঢাকা। প্রধান অতিথির দায়িত্ব পালন করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও গবেষক আনু মোহাম্মদ। 

এসএম/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ