অভিনয়ের শীর্ষে থেকেও হঠাৎ কেন হারিয়ে গেলেন শাবানা?

বাংলা চলচ্চিত্রের কিংবদন্তি নায়িকা শাবানা অভিনয়জীবন শুরু করেন ষাটের দশকের শুরুতে। তখন তিনি মাত্র ক্লাস ফাইভে পড়েন এবং এহতেশাম পরিচালিত ‘নতুন সুর’ সিনেমায় শিশুশিল্পী হিসেবে অভিনয়ের মাধ্যমে রূপালি পর্দায় পা রাখেন। এরপর পাঁচ বছর পর ‘চকোরী’ সিনেমার মাধ্যমে নায়িকা হিসেবে অভিষেক হয় তার, যেখানে তার বিপরীতে ছিলেন জনপ্রিয় অভিনেতা নাদিম।

শুধু অভিনয়েই নয়, শাবানা পরবর্তীতে প্রযোজনায়ও সক্রিয় হন। এসএস প্রোডাকশনের ব্যানারে তিনি বেশ কয়েকটি সফল সিনেমা প্রযোজনা করেন, যেগুলোতে দেশের পাশাপাশি বিদেশি শিল্পীরাও অংশ নেন।

নব্বই দশকের শেষ দিক পর্যন্ত টানা অভিনয় করে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে যান শাবানা। তখনই হঠাৎ করেই অভিনয় থেকে সরে দাঁড়ান এবং যুক্তরাষ্ট্রে চলে যান। তার এই আকস্মিক দেশত্যাগে বিস্মিত হয়েছিলেন ভক্ত-অনুরাগী ও চলচ্চিত্র-সংশ্লিষ্ট সবাই। বর্তমানে তিনি ২৫ বছর ধরে অভিনয়জগৎ থেকে দূরে এবং স্বামী-সন্তান, নাতি-নাতনিদের নিয়ে নিউ জার্সিতে স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন।

বাংলাদেশে মাঝেমধ্যে এলেও সাম্প্রতিক কয়েক বছরে আর আসা হয়নি। দেশের কথা এখনো মনে পড়ে, তাই আগে মাঝে মাঝে এক-দুই মাসের জন্য দেশে ফিরে প্রিয়জনদের সঙ্গে দেখা করতেন এবং প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার ফিরে যেতেন যুক্তরাষ্ট্রে।

সিনেমা প্রেমী ও শাবানার অনেক ভক্তের মনে এখনো প্রশ্ন- জনপ্রিয়তায় তুঙ্গে থাকা সত্ত্বেও শাবান হঠাৎ কেনো যুক্তরাষ্ট্রে পাড়ি দেন?

সাম্প্রতি গণমাধ্যমকে দেওয়া এক সাক্ষাতকারে এ প্রসঙ্গে শাবান বলেন, ‘লাখোকোটি মানুষের ভালোবাসায় শাবানা হলাম। হঠাৎ মনে হলো, সন্তানদেরও তো সময় দেওয়া দরকার। আমার বড় মেয়ে সুমী তখন এ লেভেল শেষ করল। উচ্চশিক্ষার জন্য তাকে যুক্তরাষ্ট্রে পাঠানো হলো। কিছুদিন পর ছোট মেয়ে ঊর্মি আর ছেলে নাহিনও যুক্তরাষ্ট্রে চলে গেল। ওদের সবার বয়সই–বা তখন আর কত। বাচ্চারা আমাকে খুব মিস করছিল। দেশে যখন ছিল, তখন তো আমার চোখের সামনেই ছিল। কাজের ফাঁকে দেখতাম। তখন আমিও ভাবলাম, মা হিসেবে আমার তো কিছু দায়িত্ব আর কর্তব্য আছে। সন্তানদের যদি ঠিকভাবে গড়ে তুলতে না পারি, তাহলে আমার এই অভিনয়জীবন দিয়ে কী হবে! তাই কষ্ট হলেও সিনেমা ছেড়ে সন্তানদের ব্যাপারে মনোযোগী হলাম। এ জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। ’

শাবানা স্বামী ওয়াহিদ সাদিক বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে ব্যবসায় নিয়োজিত আছেন। শাবানা তার এই যাত্রা সম্পর্কে আরও বলেন, ‘সাদিক সাহেবও ওখানে কিছু ব্যবসার ব্যবস্থা করলেন। আমিও দেখলাম অনেক দিন তো সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিতে ছিলাম, এবার ঘরের দিকে মনোযোগী হই। তাই চলে গেলাম। তবে চলচ্চিত্র ইন্ডাস্ট্রিও কিন্তু আমার কাছে একটা পরিবারের মতো ছিল। সেখানে আমি রাত-দিন অবসরবিহীন কাজ করেছি। সহশিল্পী, পরিচালকদের সঙ্গে দারুণ সম্পর্ক গড়ে উঠল। কাউকে ‘ভাই’, আবার কাউকে ‘চাচা’ ডাকতাম। সবাইকে খুব মিস করি। কিন্তু মানুষের জীবনে একটা সময় আসে, যখন কোনো উপায় থাকে না। জীবনের ধাপে ধাপে কিছু সময় আসে, সে সময় সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়া খুব দরকার। সৃষ্টিকর্তার কাছে শুকরিয়া, আমি সঠিক সময়ে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে পেরেছি।’

শাবানার সন্তানরা এখন পরিণত বয়সের অধিকারী। পাট চুকিয়েছেন পড়াশোনার। বড় মেয়ে সুমী ইকবাল এমবিএ করেছেন। বিয়ে করে এখন সে পুরোদস্তুর গৃহিণী। ছোট মেয়ে ঊর্মি সাদিক হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করেছেন। ছেলে নাহিন সাদিক রটগার্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে মাস্টার্স করে চাকরি করছেন।

অভিনেত্রীর সন্তানরাও বিয়ে করেছেন। তাদের ঘরেও এসেছে নতুন মুখ। নাতি-নাতনিদের সঙ্গে দারুণ সময় উপভোগ করছেন তিনি।

শাবানা বলেন, আগে আমি অভিনয়ের চাপে যে কাজগুলো করতে পারিনি, এখন সেগুলো করছি। ঘরসংসার করছি। জীবনের বেশির ভাগ সময় কাজ করতে করতে কেটে গেছে। বাচ্চাগুলো অনেক মিস করেছি। এখন ওদের দেখাশোনা করি, ওদের বাচ্চারা যখন নানুমণি বলে ডাকে, কাছে এসে খেলে তখন মনে হয় জীবনে এর চেয়ে সুন্দর কিছু হতে পারে না! এর বাইরে যেটুকু সময় পাই প্রার্থনা করে কাটাই। সংসারের তো অনেক কাজ।

তবে আমার নাতি–নাতনিরা মাঝেমধ্যে ইউটিউবে দেখে। ওরা আমাকে বলে নানুমণি সত্যিই, রিয়েলি ইউ আর আ বিগ অ্যাকট্রেস! মাঝেমধ্যে এ-ও বলে আমরা যদি তোমার মতো অভিনয় করতে চাই, হতে পারব? খুব মায়া লাগে ওদের মুখ থেকে এ কথা যখনই শুনি।’

যদিও দীর্ঘদিন অভিনয় থেকে দূরে তবে ভক্তদের হৃদয় থেকে কখনোই মুছে যাননি শাবানা। এখনো কোথাও গেলে মানুষ তাকে দেখে আবেগে ছুঁয়ে দেখেন, জড়িয়ে ধরেন বা সেলফি তোলার আবদার করেন।

তিন দশকের বেশি সময়ের অভিনয়জীবনে নাদিম, রাজ্জাক, আলমগীর, ফারুক, জসিম, সোহেল রানার মতো অভিনয়শিল্পীর সঙ্গে জুটি বেঁধে শাবানা উপহার দেন ২৯৯টি সিনেমা। তার উল্লেখযোগ্য সিনেমাগুলো হচ্ছে—‘ভাত দে’, ‘অবুঝ মন’, ‘ছুটির ঘণ্টা’, ‘দোস্ত দুশমন’, ‘সত্য মিথ্যা’, ‘রাঙা ভাবী’, ‘বাংলার নায়ক’, ‘ওরা এগারো জন’, ‘বিরোধ’, ‘আনাড়ি’, ‘সমাধান’, ‘জীবনসাথী’, ‘মাটির ঘর’, ‘লুটেরা’, ‘সখী তুমি কার’, ‘কেউ কারো নয়’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘স্বামী কেন আসামি’, ‘দুঃসাহস’, ‘পুত্রবধূ’, ‘আক্রোশ’ ও ‘চাঁপা ডাঙ্গার বউ’।

আরএ/টিএ


Share this news on:

সর্বশেষ

img
আওয়ামীপন্থী সেই ৬১ আইনজীবীর হাইকোর্টে জামিন Apr 22, 2025
img
ছয় বা বেশি সন্তানের মায়েদের জাতীয় মেডেল দেবেন ট্রাম্প Apr 22, 2025
img
‘এপিএসরা দুর্নীতি করবে আর উপদেষ্টারা বলবেন আমার টাকা-পয়সা নাই!’ Apr 22, 2025
img
আওয়ামী মুক্ত করার নামে প্রশাসনকে বৃদ্ধ পুনর্বাসন কেন্দ্রে পরিণত করা হচ্ছে: মাসুদ কামাল Apr 22, 2025
img
যুদ্ধ পরবর্তী পরিকল্পনা নিয়ে ইসরায়েলের বৈঠক Apr 22, 2025
img
কেরানীগঞ্জে বিএনপি নেতার ওপর হামলা, গ্রেফতার ১ Apr 22, 2025
img
আগামীতে বিএনপির নেতৃত্বে জাতীয় সরকার গঠন হবে : আমানউল্লাহ আমান Apr 22, 2025
img
২১ দিনে রেমিট্যান্স এলো প্রায় ১৯৬ কোটি ডলার Apr 22, 2025
img
এ বছর দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি হতে পারে ৩.৮% : আইএমএফ Apr 22, 2025
কারওয়ান বাজারে পিয়াজ ব্যবসায়ীদের সি'ন্ডি'কে'ট ভে'ঙে দিল ভোক্তা'র কর্মকর্তা Apr 22, 2025