মৌলিক সংস্কারে ঐকমত্য আছে, বাস্তবায়নে ম্যান্ডেট নিতে হবে জনগণের : জোনায়েদ সাকি

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, জুলাই আন্দোলন পরবর্তীতে এই মুহূর্তে বাংলাদেশে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা বা সচেতনতা তৈরি হয়েছে তা হচ্ছে বিদ্যমান সংবিধানের মৌলিক সংস্কার। সংস্কারে রাজনৈতিক ঐকমত্য আছে। কিন্তু নতুন সংবিধান বা সংবিধান পুনর্লিখনে প্রস্তাব থাকলেও ঐকমত্য নেই। অন্তর্বর্তী সরকার নিজেও সংবিধান সংস্কার কমিশন গঠন করেছে।

তিনি বলেন, আমরা যে মৌলিক সংস্কার করতে চাই তার অনুমোদন, এখতিয়ার বা ম্যান্ডেট জনগণের কাছ থেকে নিতে হবে। জনগণ যদি সংবিধানের মৌলিক সংস্কারের ম্যান্ডেট দেয় আগামী সংসদকে, তাহলে সেটা টেকসই হবে। তাতে করে আদালতে চ্যালেঞ্জ না করে উল্টো সুরক্ষা দেওয়ার দায়িত্বে যাবে। তাতে সংস্কার টেকসই হবে।

রোববার (২৭ এপ্রিল) জাতীয় সংসদের এলডি হলে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সংলাপ শেষে এসব কথা বলেন গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকির নেতৃত্বে দলটির নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেলসহ ১০ সদস্যের প্রতিনিধি দল সংলাপে অংশগ্রহণ করেন।

জোনায়েদ সাকি বলেন, যেসব বিষয়ে আমাদের ভিন্নমত ও আংশিক মত ছিল সেসব বিষয়ে আজ বিস্তারিত কথা হয়েছে। আমাদের কাছ থেকে তারা আরও বিস্তারিত ও সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব প্রত্যাশা করেছেন। সেটা আমরা করব।

তিনি বলেন, গণতন্ত্রের বিষয়ে আমরা যে বন্দোবস্ত দেখছি সেটা ফ্যাসিস্ট বন্দোবস্ত। যে ক্ষমতা কাঠামো সেটার মধ্যে স্বৈরতান্ত্রিক চেহারা আছে। এই ক্ষমতা কাঠামোর বদল ঘটাতে হবে। গণতান্ত্রিক বন্দোবস্ত তৈরি করতে হবে। যে আত্মত্যাগের ভিত্তিতে এই জুলাই অভ্যুত্থান হয়েছে, সত্যিকার অর্থে তাদের প্রতি আমরা ভালোবাসা প্রকাশ করতে পারব যদি গুম-খুন অত্যাচার মোকাবিলা করে যে গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষার জন্য, যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য… সেটা আমরা ঠিকঠাক মতো এগিয়ে নিতে পারি।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, বাংলাদেশের সংসদ সদস্যরা হচ্ছে জনগণের প্রতিনিধি। কিন্তু তারা সংসদে গিয়ে দলের অনুগত বা প্রতিনিধিতে পরিণত হন। এটার বদল ঘটাতে আমরা ৭০ অনুচ্ছেদ বাদ দিতে বলেছি। যদিও অর্থবিল পাস ও আস্থাভোট ব্যতিরেকে বাকি সব জায়গায় পরিবর্তনের প্রস্তাব করা হয়েছে। আস্থাভোট ও বাজেট বিষয়ে সংসদ সদস্যরা যেন স্বাধীন মত ও ভোট দিতে পারেন সেজন্য আমরা ৭০ অনুচ্ছেদের সংস্কার চেয়েছি।

জোনায়েদ সাকি বলেন, বিচার বিভাগের মতো সাংবিধানিক সংস্থাকে শুধু আলাদা করাই নয়, বিচার বিভাগ যেন সত্যিকার অর্থে পৃথক পাওয়ারের জায়গায় থাকে, নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে যেন চেক অ্যান্ড ব্যালান্সের জায়গায় থাকে সেটার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থার কথা বলেছি। সুপ্রিম কোর্টের বিচারক নিয়োগে সততা-যোগ্যতাসহ সুনির্দিষ্ট ক্রাইটেরিয়ার কথা বলেছি। সুপ্রিম কোর্টের অধীনে থাকবে এর সচিবালয়। যারা নিম্ন আদালতের নিয়োগ, পদোন্নতিসহ সব কিছু দেখভাল করবে।

তিনি বলেন, নির্বাচন কমিশন, দুদক, মানবাধিকার কমিশন, অ্যাটর্নি জেনারেলের মতো সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ প্রক্রিয়া স্বাধীন সাংবিধানিক কমিশনের হাতে অর্পণের কথা বলেছি। ইতোমধ্যে এনসিসি বা জাতীয় সাংবিধানিক কমিশনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটা আমাদের দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। আমরা মনে করি, ক্ষমতার সত্যিকার ভারসাম্য আনতে হলে এটা অপরিহার্য। কেন না সাংবিধানিক পদগুলো যদি সরকার নিয়ন্ত্রণ করে তাহলে রাষ্ট্র ও সরকার একাকার হয়ে যায়।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ, স্থানীয় সরকার, ক্ষমতা কাঠামো, উচ্চকক্ষে সংখ্যানুপাতিক প্রতিনিধিত্ব, উচ্চকক্ষের কাঠামো কি হবে, তত্ত্বাবধায়ক সরকার কীভাবে গঠিত হবে, এর সদস্য কারা হবেন, কাঠামো কি হবে, নারী আসন কীভাবে বণ্টন বা গঠিত হবে এসব ব্যাপারে কথা বলেছি।

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক চর্চা আসলে কোন নিয়মে চলবে– এমন প্রশ্ন তুলে জোনায়েদ সাকি বলেন, একটা দল নানা নীতি তৈরি করে। জনগণ তাকে সমর্থন বা ভোট দিলে সে দল ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু যেটা সবার জন্য প্রযোজ্য সেটা আমরা কীভাবে করব, সেটার দায়িত্ব বা কর্তব্য এই গণঅভ্যুত্থান আমাদের সামনে হাজির করেছে।

পদ্ধতিগত দিক থেকে সমস্ত রাজনৈতিক দল যেসব বিষয়ে একমত হচ্ছি সে বিষয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, আরও বেশি বেশি আলোচনা করুক ঐকমত্য কমিশন। আমরা ইতোমধ্যে দলীয়ভাবে সেটা শুরু করেছি। আজ আমরা আনুষ্ঠানিকভাবে গণসংহতি আন্দোলনের পক্ষ থেকে ঘোষণা দিচ্ছি যে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও অংশীজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করব, কীভাবে আমরা বেশি সংস্কারের জন্য ন্যূনতম জাতীয় ঐকমত্য তৈরি করতে পারি।

যেসব বিষয়ে ঐকমত্য তৈরি হবে সেটাকে জাতীয় সনদ বা জুলাই চার্টার্ড হিসেবে গ্রহণ করার প্রস্তাবের কথা তুলে ধরে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, যেসব বিষয়ে কোনোভাবেই ঐকমত্য হবে না সেগুলো জনগণের কাছে নিয়ে যেতে হবে। রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নিজ নিজ রাজনৈতিক ইশতেহারে উল্লেখ করবেন। জনগণ চাইলে তাদের ভোট দেবেন। সংখ্যাগরিষ্ঠরা সেসব বাস্তবায়ন করবেন ক্ষমতায় গিয়ে।

গণতান্ত্রিকভাবে যেসব বিষয়ে ঐকমত্য হবে সেসব জুলাই চার্টার্ড বা সনদে উল্লেখ করার বিষয়ে সবাই অঙ্গীকারবদ্ধ উল্লেখ করে জোনায়েদ সাকি বলেন, আগামী সংসদে এসব বাস্তবায়ন করা হবে। জুলাই সনদ বা জাতীয় সনদ অর্ডিন্যান্স আকারে আগামী গঠিত সংসদে বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার জায়গা তৈরি করতে হবে।

তিনি বলেন, জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে এ সংস্কারগুলো বাস্তবায়ন করা দরকার। মোটাদাগে তিনটি প্রস্তাব রয়েছে। একটা হচ্ছে– গণপরিষদ নির্বাচন, আগামী সংসদে সংস্কার বাস্তবায়নে অ্যামেন্ডমেন্ট হবে। আমরা বলেছি সংবিধান সংস্কার পরিষদ বা সংবিধান সংস্কার সভার নির্বাচন। গণপরিষদ বা সংবিধান সভার যে নির্বাচন তা জনগণ একটা সংসদকে সংবিধান তৈরির এখতিয়ার দেয়।

গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী বলেন, জাতীয় সনদের দুটো অংশ তৈরি করার কথা বলেছি। একটা সংবিধান সম্পর্কিত। আরেকটি অন্য প্রশাসনিক অংশ, যেটা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারই নির্বাহী আদেশে এখনই কার্যকর বা বাস্তবায়ন করতে পারে। যেটা ভবিষ্যতে চলমান থাকবে।

দলটির নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল বলেন, আমরা কোনটাতে একমত বা একমত নই তা জানিয়েছি। বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক যে রূপান্তর তা বহু বছরের। এর নানা সারসংক্ষেপ আমরা তুলে ধরেছি। এই ঐকমত্য কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলোর ব্যাপারে আমাদের অবস্থান তুলে ধরেছি।

তিনি বলেন, বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলোকে যদি সত্যিকার কার্যকর করতে হয় তাহলে এর যে নিয়োগ কর্তৃপক্ষ বা কে নিয়োগ করছে সেটা বদলাতে হবে। এখানে সাংবিধানিক প্রক্রিয়া চালু করা দরকার। ইতোমধ্যে কমিশন এটার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। ৭০ অনুচ্ছেদসহ সংবিধান অনুযায়ী যে অগণতান্ত্রিক ক্ষমতা কাঠামো রয়েছে, সে বিষয়ে আমরা কথা বলেছি। এই ৭০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, অর্থবিল কিংবা আস্থাভোট ছাড়া যেন বাকি সব বিষয়ে স্বাধীনভাবে সংসদ সদস্যরা কথা বলতে পারেন সেজন্য জাতীয় ঐকমত্য প্রয়োজন।

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মনির হায়দারের সঞ্চালনায় বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহ সভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ, কমিশন সদস্য সফর রাজ হোসেন, ড. বদিউল আলম মজুমদার, ড. ইফতেখারুজ্জামান।

এসএম/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আগস্টে তুরস্ক ফুটবল দলের মুখোমুখি হবে বাংলাদেশ Jul 05, 2025
অনলাইনে সালাম দিলে কীভাবে উত্তর দেবেন? | ইসলামিক জ্ঞান Jul 05, 2025
img
কীর্তির প্রত্যাবর্তনের বড় পরিকল্পনা, ফিরছেন ৫টি বড় প্রজেক্টে Jul 05, 2025
img
সিরিজ বাঁচাতে মাঠে নামছে বাংলাদেশ, যেমন হতে পারে একাদশ Jul 05, 2025
img
সবাইকেই ট্রানজিশন পিরিয়ডের মধ্য দিয়ে যেতে হয়, বাংলাদেশের পারফরমেন্স প্রসঙ্গে জয়সুরিয়া Jul 05, 2025
img
বাবার দ্বিতীয় বিয়ের খবরে ক্ষুব্ধ সানি, তেড়ে যান হেমা মালিনীর দিকে! Jul 05, 2025
img
১৫ হাজার কোটি টাকার সম্পত্তি হারানোর মুখে সাইফ আলি খান Jul 05, 2025
img
‘দ্য ট্রেইটার্স ইন্ডিয়া’র মঞ্চে উরফি জাভেদ ও নিকিতার জয় Jul 05, 2025
img
আগে পিওনের ৪০০ কোটি টাকা বানাতে লেগেছে ১৫ বছর কিন্তু এখন লাগে ৩ মাস : রুমিন ফারহানা Jul 05, 2025
img
প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত তরুণরা নতুন সমাজ গড়বে : সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা Jul 05, 2025
img
ক্লাব বিশ্বকাপে আল হিলালকে হারিয়ে সেমিফাইনাল নিশ্চিত করল ব্রাজিলের ফ্লুমিনেন্স Jul 05, 2025
img
‘বাবা আমাকে সাহায্য করেনি’, অভিনয় জীবন নিয়ে মিঠুন পুত্রের আক্ষেপ Jul 05, 2025
img
দেশের বাজারে আবারও বাড়ল সোনার দাম Jul 05, 2025
img
হজ শেষে দেশে ফিরলেন ৬৫ হাজার ৫৭৩ হাজি Jul 05, 2025
img
‘আমি পাঁচ বছরের মধ্যে বিয়ে করে মা হতে চাই’, জায়েদ খানকে তিশা Jul 05, 2025
img
রোমে পেট্রোল স্টেশনে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, আহত ৪৫ Jul 05, 2025
img
চট্টগ্রামে তাজিয়া মিছিলে আতশবাজি-অস্ত্র নিষিদ্ধ করল সিএমপি Jul 05, 2025
img
উড্ডয়নের আগেই অসুস্থ হয়ে লুটিয়ে পড়লেন এয়ার ইন্ডিয়ার পাইলট Jul 05, 2025
img
আমরা যেনতেন নির্বাচন চাই না : জামায়াত আমির Jul 05, 2025
img
এ কে আজাদের বাসভবনে হামলা, ফরিদপুরে বিএনপি নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মামলা Jul 05, 2025