জামানতের শত কোটি টাকা নিয়ে উধাও আ.লীগের তিন নেতা

মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলার জামশা এলাকায় গ্রাম-মানবিক উন্নয়ন ক্ষুদ্র সমবায় সমিতি নামে একটি এনজিওর বিরুদ্ধে অভিযোগ—জামানতের শত কোটি টাকা নিয়ে লাপাত্তা প্রতিষ্ঠানটির তিন কর্ণধার, যাদের সবাই আওয়ামী লীগের নেতা। ভুক্তভোগীরা বছরের পর বছর ধরে ঘুরেও পাচ্ছেন না তাঁদের মূল টাকা কিংবা মুনাফা। প্রতারণার এই জালে পড়ে বহু গ্রাহক হারিয়েছেন জমিজমা, এমনকি বসতভিটাও।

জামানতের টাকা চাইতে গিয়ে হয়রানি ও লাঞ্ছনার শিকার হতে হয়েছে বছরের পর বছর। অভিযোগ করেও কোনো প্রতিকার পাননি ভুক্তভোগীরা। এরই ফলশ্রুতিতে রোববার (২৭ এপ্রিল) সকালে জামশা ইউনিয়নের উত্তর জামশা এলাকায় অবস্থান ধর্মঘট ও মানববন্ধন করে ভুক্তভোগী গ্রামবাসী। এ সময় বিক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক ও সমবায় মালিক আমজাদ হোসেনের বসতবাড়িতে ভাঙচুর করে।

গ্রামের সাধারণ মানুষের সঙ্গে এমন প্রতারণার ফাঁদ পেতেছিল মানিকগঞ্জের সিংগাইর উপজেলায় জামশা ইউনিয়নের দক্ষিণ জামশা এলাকার এই সমবায় প্রতিষ্ঠানটি। আশপাশের জামশা, জামির্তা, চারিগ্রাম, বলধারা, তালেবপুর এবং জয়মন্টপ ইউনিয়নের হাজারো গ্রাহক এই প্রতারণার ফাঁদে পড়েছেন।

ভুক্তভোগী ও এলাকাবাসী সূত্রে জানা গেছে, যৌথ মালিকানায় ২০০১ সালে সমবায় প্রতিষ্ঠানটি নিবন্ধিত হয়। জামশা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক গাজী কামরুজ্জামান, ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক বিষয়ক সম্পাদক আমজাদ হোসেন, ইউনিয়ন শ্রমিক লীগের সভাপতি মানিক মিয়া উজ্জ্বল ও ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতা হাবিবুল্লাহ যৌথভাবে প্রতিষ্ঠা করেন‌ এই সমবায় সমিতিটি। এর মধ্যে হাবিবুল্লাহ বেশ কয়েক বছর আগে মারা যাওয়ার পরে সমিতির কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছেন ওই তিন আওয়ামী লীগ নেতা।

শরীরের দুটি কিডনিতেই জটিলতা ধরা পড়েছে গ্রাহক ফাতেমা আক্তারের (৩৩)। আলাপকালে ফাতেমা বলেন, জটিল এই সমস্যায় চিকিৎসার খরচ মেটাতে খামারি স্বামী বিক্রি করেছেন গরু-বাছুরসহ ফসলি জমি। পাশাপাশি বাবার বাড়ি থেকে এনেছেন জমি বিক্রির টাকা। সব মিলিয়ে ১০ লাখ টাকা চিকিৎসা ব্যয়ের জন্য জামানত হিসেবে রেখেছিলেন গ্রাম-মানবিক উন্নয়ন ক্ষুদ্র সমবায় সমিতিতে। চাহিদা বিবেচনায় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে যে কোনো সময় তুলতে পারবেন টাকা- এ ভরসায় দুই মাস মেয়াদে তিন বছর আগে রেখেছিলেন ১০ লাখ টাকা। জামানতের টাকার তিন বছর পার হলেও পাওয়া যায়নি কোনো অর্থ। টাকার অভাবে আটকে আছে চিকিৎসা।

তিনি আরও বলেন, টাকা দেওয়ার পর থেকে তাদের পায়ে পর্যন্ত ধরেছি, কোনো টাকা দেয়নি। আমার যা সহায় সম্বল ছিল সব শেষ। পোলাপান নিয়ে কীভাবে আমার দিন যায় রাত পোহায় আমি জানি আর আল্লাহ জানে। আমার পরিবারটারে একেবারে নিঃস্ব করে ফালাইছে (ফেলছে)।

ভুক্তভোগী প্রবাসী সেলিম মিয়া (৩০) বলেন, গ্রাহকের শত কোটি টাকা পাচার করে দুবাইতে ব্যবসা শুরু করেছে এই চক্র। পরিবারসহ যে কোনো সময় চলে যাবে। তারা গ্রাহকের টাকায় ব্যবসা করেছে কোথাও কোনো লস খায়নি। পাবলিকের টাকায় পাবলিককে দিয়েছে। সমিতির ভাষ্যমতে তাদের ফিল্ডে পাঁচ কোটি টাকা আছে কিন্তু তারা হাজার খানেক গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত নিয়ে রেখেছে শত কোটি টাকা। তারা এই টাকা অবৈধভাবে দেশ থেকে পাচার করেছে। তাদের এই চক্রান্ত পূর্ব পরিকল্পিত।

এ সব বিষয়ে অভিযুক্ত কাউকেই এলাকাতে পাওয়া যায়নি। তবে ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ও সমবায়ের পরিচালক গাজী কামরুজ্জামানের স্ত্রী মৌসুমী আক্তারের সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, টাকা-পয়সার জন্য বাড়িতে প্রতিনিয়তই লোকজন আসে। আমি আমার স্বামীকে জিজ্ঞেস করলে তিনি আট থেকে নয় কোটি টাকার কথা স্বীকার করেছেন, যা গ্রাহক পায়। পর্যায়ক্রমে গ্রাহকদের টাকা ফেরত দেওয়া হচ্ছে। শেখ হাসিনা পলানোর পর থেকে রাজনৈতিক মামলায় তিনিও গা ঢাকা দিয়ে আছেন। সমিতির টাকাগুলো একাধিক জায়গায় ইনভেস্ট করা আছে। সেখান থেকে প্রফিট আসা শুরু হলে তিন থেকে চার বছরের ভেতর গ্রাহকের সব টাকা ফেরত দেওয়া সম্ভব হবে।

এ বিষয়ে জেলা সমবায় কর্মকর্তা ফারহানা ফেরদৌসী বলেন, প্রথমত কোনো সমবায় সমিতি গ্রাহকের কাছ থেকে জামানত সংগ্রহ করতে পারবে না। সমিতির নিবন্ধন থাকলে সদস্যদের মাঝে ক্ষুদ্রঋণের কার্যক্রম পরিচালিত করতে পারবে। এ বিষয়ে ভুক্তভোগী গ্রাহকরা অভিযোগ করলে আমরা সমিতির বিরুদ্ধে প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গ্রহণ করব।

আরএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img
ফের ছোটপর্দায় শ্রীময়ী, ‘মিলন হবে কত দিনে’তে নতুন চমক Nov 28, 2025
img
পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে ৭০৬৬০ প্রবাসীর নিবন্ধন Nov 28, 2025
img
জোট নিয়ে বিভাজনের মুখে এনসিপি Nov 28, 2025
এক সিনেমায় ঢালিউডের দুই সুপারস্টার শাকিব খান ও আরিফিন শুভ! Nov 28, 2025
img
তুই তোকারিতে প্রেম হয় না, হয় বন্ধুত্ব: দীপঙ্কর দে Nov 28, 2025
img
পদত্যাগের পর কোন দল থেকে নির্বাচন মাহফুজ-আসিফের? Nov 28, 2025
img
সৃজিতের সিনেমায় নায়িকার চরিত্রে নতুন মুখ Nov 28, 2025
img
ম্যারাডোনার হৃদপিণ্ড আরও কতদিন থাকবে পুলিশের পাহারায়? Nov 28, 2025
img
সিলেটে বাড়ছে ডেঙ্গুর প্রকোপ Nov 28, 2025
img
জনসেবা যাদের পেশা-নেশা, তাদের হাতেই জামায়াতের পতাকা: ডা. শফিকুর Nov 28, 2025
img

গবেষণা

পেশি যত বেশি, মস্তিষ্ক তত তরুণ Nov 28, 2025
img
প্রতিহিংসার রাজনীতির কবর রচনা হয়েছে, ফ্যাসিবাদীরা হারিয়ে যাবে : ডা. খালিদুজ্জামান Nov 28, 2025
img
ভর্তিযুদ্ধ শব্দটি সমীচীন নয়: ঢাবি উপাচার্য Nov 28, 2025
img
লাস ভেগাসে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ বিয়ে করলেন তনুশ্রী Nov 28, 2025
img
বাংলাদেশে পাটভিত্তিক উৎপাদনে বড় বিনিয়োগে আগ্রহী চীন Nov 28, 2025
img
‘কিস কিসকো প্যায়ার কারু টু’-তে কপিলের ৩ বিয়ে Nov 28, 2025
img
জানা গেলো পপির সঙ্গে ভগ্নিপতির ঝামেলা কারণ Nov 28, 2025
img
নতুন পোশাকে দায়িত্ব পালন করছে সিলেটের ট্রাফিক পুলিশ Nov 28, 2025
img
‘তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলো’ থেকে স্থায়ীভাবে অভিবাসন বন্ধ করছে যুক্তরাষ্ট্র! Nov 28, 2025
img
ছুটির দিনে আজও ঢাকার বাতাস ‘খুবই অস্বাস্থ্যকর’ Nov 28, 2025