ঈমানের অভিযাত্রায় আল্লামা ইকবালের পথচলা

যাঁদের চিন্তা ইতিহাসের গতি ঘুরিয়ে দেয়, যাঁদের কণ্ঠ থেকে উচ্চারিত শব্দ হয়ে ওঠে সভ্যতার সংজ্ঞা, আল্লামা মোহাম্মদ ইকবাল তাঁদেরই একজন। ইকবালকে বুঝতে গেলে শুধু তাঁর কাব্য পড়লে হবে না, বুঝতে হবে তাঁর চিন্তার স্তর, অনুভব করতে হবে তাঁর আত্মার জ্বালা।

তাঁর কবিতা ছিল না কেবল প্রেম বা প্রকৃতির বন্দনা; তা ছিল অগ্নিস্নাত, জাতিকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তোলার আর্তি। তাঁর দর্শন ছিল না নিছক চিন্তার অনুশীলন; তা ছিল বাস্তব জীবন ও সমাজ পরিবর্তনের রূপরেখা।

আর তাঁর রাজনীতি ছিল না ক্ষমতার তৃষ্ণা; ছিল জাতির অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই। এই একেকটি পরিচয় এককভাবে কাউকে ইতিহাসে অমর করার জন্য যথেষ্ট। অথচ ইকবাল একাই ধারণ করেছেন সব পরিচয় অবলীলায় নির্লিপ্ত সাধকের মতো।

খুদি : আত্মপরিচয়ের কাব্যিক দর্শন
ইকবালের দর্শনের কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে ‘খুদি’ বা আত্মসত্তা।কিন্তু এটি পাশ্চাত্য ইগোর মতো স্বার্থপর কোনো ধারণা নয়, বরং এটি একটি পরিশুদ্ধ, আল্লাহর প্রতিনিধিত্বকারী চেতনা। তাঁর মতে, ‘খুদি’ মানে এমন এক আত্মসচেতনতা, যার উৎস আল্লাহ, যার পথ নবুয়ত, আর যার গন্তব্য পরিপূর্ণ মানবতা। কোরআনের ভাষায়—‘আর আত্মা ও যিনি তা সুসংগঠিত করেছেন এবং তাকে তার অসচ্চরিত্রতা ও সচ্চরিত্রতার জ্ঞান দান করেছেন।’ (সুরা : আশ-শামস, আয়াত : ৭-৮)
ইকবালের কবিতা ও দর্শন এই আয়াতেরই কাব্যিক ও দার্শনিক ব্যাখ্যা, যেখানে মানবাত্মার গুণ ও সম্ভাবনার জয়গান গাওয়া হয়।

কবিতা নয়, আত্মার জাগরণ
ইকবাল কখনো কাব্যকে উদ্দেশ্য মনে করেননি, বরং কাব্য ছিল তাঁর আত্মার বাহন। তাঁর ফারসি রচনাগুলো, বিশেষ করে ‘আসরারে খুদি’, ‘রুমুজে পয়ামে মাসরিক’, ‘বেখুদি’, এমনকি ‘জাওয়েদ নামা’—এমন সব কাব্যিক মহাকাব্য, যেখানে শব্দের আড়ালে জেগে ওঠে চিন্তার বিপ্লব। ‘খুদি’ তাঁর ভাবনাজগতে এক আত্মপ্রতিষ্ঠার রূপরেখা; ‘বেখুদি’ সেখানে সামাজিক কর্তব্যহীনতার দিগন্ত। তিনি লিখেছেন—

‘খুদি মে ডুব জা গাফেল! ইয়ে ছিররে জিন্দেগি হে
নেকাল কর হালকায়ে শাম ও সেহের ছে জাওদা হো জা’
(নিজের ভেতরে ডুবে যাও, হে গাফেল! এটাই জীবনের রহস্য। সময়ের গণ্ডি পেরিয়ে চিরস্থায়ী হয়ে ওঠো)।

পশ্চিমের জ্ঞান, পূর্বের আত্মা
ইকবাল পাশ্চাত্যের জ্ঞানচর্চা করেছেন গভীরভাবে। তিনি নিটশে, বার্গসন, হেগেল, গ্যোথের ভাবধারায় ডুবে ছিলেন, কিন্তু সেখান থেকে উঠে এসেছেন কোরআনের আলোতে। তিনি বলেছিলেন, ‘পশ্চিম আমাকে শিখিয়েছে কিভাবে চিন্তা করতে হয়; কিন্তু কোরআন শিখিয়েছে, কেন চিন্তা করতে হয়।’ এভাবেই তিনি হয়ে উঠেছেন ‘ইসলামী এক্সিস্টেনশিয়ালিজম’-এর পথিকৃৎ।
পশ্চিম যেখানে আল্লাহর মৃত্যু ঘোষণা করেছিল, ইকবাল সেখানে আত্মার পুনর্জন্মের ঘোষণা দেন। তাঁর ‘Reconstruction of Religious Thought in Islam’ একটি দার্শনিক ঘূর্ণাবর্ত, যেখানে ধর্ম নতুন করে আত্মপরিচয়ের ভিন্ন ব্যাখ্যা পায়।

নারীর মর্যাদা ও ফেমিনিজম : ভারসাম্যপূর্ণ দৃষ্টি
ইকবাল ছিলেন নারী শিক্ষার প্রবল সমর্থক, কিন্তু পশ্চিমা নারীবাদের এক কঠোর সমালোচক। তিনি দেখেছিলেন, ইসলামের চেতনায় নারী হলো সভ্যতার জন্মদাত্রী; পাশ্চাত্যে সে শুধু ভোগের বস্তু। তাঁর মতে, ‘যে জাতি তার নারীর আত্মাকে সংরক্ষণ করতে পারে না, সে জাতি আত্মপরিচয়ও হারিয়ে ফেলে।’

যাঁদের আদর্শ ভাবতেন
ইকবালের ভাবনায় যাঁরা ছিলেন চির অম্লান, তাঁরা হলেন সালাহউদ্দিন আইয়ুবী, ওমর (রা.), ইমাম গাজ্জালি ও মাওলানা রুমি। তাঁর কাব্যে তাঁরা কখনো প্রতীক, কখনো প্রশ্নকর্তা, কখনো আদর্শ নেতৃত্বের মডেল। তিনি মুমিনকে সেই মুক্তচিন্তার ফকির হতে বলেছিলেন, যার দুনিয়া গড়ে ওঠে ঈমানের শক্তিতে, দাসত্বের প্রলোভনে নয়।

মৃত্যুর আগে শেষ বার্তা
ইকবালের মৃত্যুর মাত্র কয়েক মাস আগে তিনি বলেন, ‘মুসলিম জাতি আত্মা হারিয়েছে, এখন কেবল একটি দেহ হয়ে বেঁচে আছে। আমি কেবল এই আত্মাকে জাগিয়ে তুলতে চেয়েছিলাম। যদি কেউ একদিন সত্যিকারভাবে আমার খুদিকে বোঝে, তাহলে হয়তো উম্মাহ তার নিজস্ব পথ খুঁজে পাবে।’

শেষ কথা
ইকবাল আমাদের প্রজন্মের কাছে শুধুই ইতিহাস নয়, তিনি এক অনন্ত প্রশ্ন। আমরা কী এখনো আত্মসচেতন? আমাদের ‘খুদি’ কি জাগ্রত? আমাদের চিন্তা কি কোরআনের আলোয় আলোকিত?
ইকবাল বলেছিলেন—
‘ছেতারু ছে আগে জাহা আওর ভি হে
আভি এশক কে ইমতেহান আওর ভি হে’
(তারারও ওপারে রয়েছে জগৎ আরো,
এখনো রয়েছে প্রেমের পরীক্ষা আরো)।
এই দার্শনিক কবির ভাষায়, আত্মার সফর শেষ নয়। চিন্তা ও ঈমানের এক নতুন অভিযাত্রায় ইকবাল যেন আমাদের অনন্ত পথচলার পথিক। তিনি ছিলেন অতলান্তিকের মতো, চোখে যা দেখা যায়, তা তাঁর মাত্র একটুকরা; তাঁর গভীরতা মাপা যায় না, শুধুই অনুভব করা যায়।

এমআর/এসএন


Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্বাসঘাতক মীরজাফর একটি দল জুলাই আন্দোলন নস্যাৎ করার চেষ্টা করছে : জিন্নাহ কবির Nov 01, 2025
img
ইউক্রেনে যুদ্ধ থামাতে একসঙ্গে কাজ করবে যুক্তরাষ্ট্র-চীন : ট্রাম্প Nov 01, 2025
img
ট্রাম্পের বৈশ্বিক শুল্কনীতি বাতিলের দাবিতে মার্কিন সিনেটে রেজোল্যুশন পাস Nov 01, 2025
img
বামপন্থি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের আহ্বান Nov 01, 2025
img
প্রতারণার কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে গেছে এই সরকার: মান্না Nov 01, 2025
img
চিকিৎসার জন্য বিদেশ যেতে না দেওয়া অপমানজনক: এহছানুল হক মিলন Nov 01, 2025
আইকনিক সড়ক ভাঙার পরিকল্পনা নিয়ে বিশেষজ্ঞদের সতর্কতা Nov 01, 2025
গণভোট প্রসঙ্গে জামায়াত আমিরের স্পষ্ট বার্তা Nov 01, 2025
কোনো চটকদারিত্বের কাজ-কর্মে আমরা নাই: মেঘমল্লার বসু Nov 01, 2025
"১০ হোন্ডা, ২০ গুন্ডা, ইলেকশন ঠান্ডা" Nov 01, 2025
বিমানবন্দরে নেমে এ কি দেখলেন বনি আমিন! Nov 01, 2025
সংস্কার প্রশ্নে উভয়সংকটে বিএনপি : মানলে পরাজয়, প্রত্যাখ্যান করলে সংস্কারবিরোধী Nov 01, 2025
১০ মিনিটে গোটা বিশ্বের সারাদিনের সর্বশেষ আলোচিত সব খবর Nov 01, 2025
চাকরি হারিয়ে রাস্তায়! ইসলামী ব্যাংক কর্মকর্তাদের প্র'তিবাদ! Nov 01, 2025
img
পথচারীকে চাপা দিয়ে পালানোর সময় ৪ গাড়িতে ধাক্কা বাসের, আহত ১০ Nov 01, 2025
হঠাৎ ঢাবি ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগের ব্যানার; ক্ষুব্ধ সূর্যসেন হলের ভিপি Nov 01, 2025
বিশ্বকাপের আগে সৌদি মঞ্চ থেকে মেসি অনিশ্চিত Nov 01, 2025
বিরতির অবসান, তানিয়া বৃষ্টি এবার কোর্টরুম থ্রিলারে Nov 01, 2025
img
স্থগিত কাবাডির ক্যাম্প, যথাসময়ে হচ্ছে না এসএ গেমস! Nov 01, 2025
img
অদৃশ্য শক্তিকে পরাজিত করে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করব: মুরাদ Nov 01, 2025