একসময়ের টালিউডের জনপ্রিয় অভিনেত্রী শতাব্দী রায় তার অভিনয় দিয়ে দর্শক নন্দিত ছিলেন। একের পর একে সিনেমায় অভিনয় করে সিনেমাপ্রেমীদের হৃদয়ে স্থান করে নেন তিনি। পরে হঠাৎ করেই অভিনেত্রী অভিনয় থেকে দূরে সরে যান। দীর্ঘ একযুগেরও বেশি সময় পর আবার অভিনয়ে ফিরলেন তিনি।
দীর্ঘ দিন পর অভিনয়ে ফিরে যা দেখলেন অভিনেত্রী— মানুষ বদলে গেছে। কাজ করার ভঙ্গি পাল্টেছে। এত বদল দেখে একটু বুক কেঁপেও ছিল? মৈনাক ভৌমিকের সিনেমা ‘বাৎসরিক’ দিয়ে আবারও ক্যামেরার মুখোমুখি শতাব্দী রায়। এই প্রজন্মের সঙ্গে কাজ করে খুশি সংসদ সদস্য ও অভিনেত্রী? ভারতের জনপ্রিয় একটি গণমাধ্যমের এক সাক্ষাৎকারে অকপটে যা বললেন শতাব্দী রায়।
শতাব্দী রায় কি নিয়মিত অভিনয়ে করবেন?—এমন প্রশ্নের উত্তরে শতাব্দী বলেন, নিয়মিত কিনা জানি না। যদি গল্প ভালো লাগে, চরিত্র পছন্দ হয়, তবে আগামী দিনে আবার হয়তো আমাকে দেখা যাবে। যেমন— মৈনাক ভৌমিকের সিনেমা ‘বাৎসরিক’ দিয়ে কয়েক যুগ পর অভিনয়ে ফিরলাম। আমার সঙ্গে সময় ভাগ করে নেওয়াটাও একটা বড় ব্যাপার। আমার তো প্রচণ্ড কাজের চাপ।
দীর্ঘ দিন পর অভিনয়ে ফিরে কেমন লাগল? অভিনেত্রী বলেন, সব কিছুরই ধারা বদলে গেছে। প্রযুক্তি পাল্টে গেছে। মানুষের মধ্যেও বদল এসেছে। কাজ করার পদ্ধতিও আগের মতো নেই। তাই ভয়ে ভয়ে ছিলাম— কতটা মানিয়ে নিতে পারব। দুটো-তিনটা ক্যামেরায় কাজ করায় অভ্যস্ত নই। তারপরও বলব— কাজ করে ভালো লেগেছে। একটানা কাজের পর ক্লান্তি চলে আসে। লম্বাবিরতির পর কাজে ফেরা মানে তাজা মন নিয়ে কাজে নামা। যেন নতুন করে ফিরলাম। কেমন কাজ করলাম সেটি দর্শকদের ওপরে ছেড়ে দিলাম।
মৈনাকের সিনেমায় কাজ করতে রাজি হলেন কেন? তিনি বলেন, এই প্রজন্মের ভালো পরিচালক বলে। মৈনাক ভালো সিনেমা বানায়— এই প্রশংসাও শুনেছি। তাতে ভরসা বেড়েছে। আর সিনেমার বিষয়, অন্য রকম চরিত্র। ভৌতিক আবার সম্পর্কের বুনোট— দুটো উপাদানই সিনেমায় আছে। সব মিলিয়ে রাজি হয়ে গেলাম।
পর্দায় আমরা কীভাবে আপনাকে দেখব?—এ প্রশ্নের উত্তরে শতাব্দী বলেন, সিনেমায় এক সদ্য স্বামীহারা স্ত্রীর গল্প বলা হয়েছে। সে আর তার ননদ এক বাড়িতে থাকে। এই ননদের ভূমিকায় আমি। গল্প যত এগোবে ভাইয়ের বউ আর ননদের সম্পর্কের নানা দিক প্রকাশ্যে আসবে। আপাতত এর বেশি কিছু বলা ঠিক হবে না।
বাস্তবে শতাব্দী ‘রায়বাঘিনী ননদিনী’? অভিনেত্রী বলেন, না না। একেবারেই নয়। আমার একজন দাদা, শারণ্য রায়। বৌদি সংগীতা বলে— আমি ওর খুব ভালো বন্ধু। ওকে ব্যবসা করতে উৎসাহ দিয়েছি। আবার তুতো ভাইয়ের বউরাও আমায় পছন্দ করে। আমাদের মেয়েদের একটা গ্রুপ আছে। সেই গ্রুপে শুধু বোনেরা নয়, বৌদিরাও আছে। আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে ঘুরতে যাই। টিপিক্যাল ননদ-বৌদির সম্পর্ক আমাদের মধ্যে নেই।
কাজের পদ্ধতিগত পরিবর্তনের সঙ্গে গল্প বলার ধারাও বদলেছে। আপনার সময়ের মতো নিটোল পারিবারিক গল্প নিয়ে সিনেমা খুব কম হয়? এ সংসদ সদস্য বলেন, দিন বদলেছে। সময় বদলেছে। মানুষের হাতে এত সময়ও নেই যে ধৈর্য ধরে আগের মতো বসে বসে সিনেমা দেখবে। তা ছাড়া মানুষ নতুনত্বের পূজারি। নতুন কিছু না পেলে সে-ই বা কেন প্রেক্ষাগৃহে পা রাখবে! যুগের সঙ্গে, সময়ের সঙ্গে নিজেকে বদলাতে হবে। তবে দর্শক সিনেমা দেখবেন। খেয়াল করে দেখুন— হিন্দিতে, বাংলায় এখনো কিন্তু সম্পর্কের গল্প, পারিবারিক গল্প দেখানো হয়, ভিন্ন মোড়কে। বদলাতে আপনাকে হবেই। পরীক্ষা-নিরীক্ষার মধ্য দিয়ে যেতে হবে।
অ্যাসিড টেস্টের মধ্য দিয়ে তো বাংলা সিনেমা যাচ্ছে, যে সাফল্য আসার কথা সেটি আসছে কই? শতাব্দী বলেন, বাংলা সিনেমাও চেষ্টা করছে। অন্য রকম সিনেমা করার। ভিন্ন স্বাদের গল্প বলার। কিন্তু টালিউডে যে অনেক সমস্যা, বাজেট একটা বড় ব্যাপার। এখানে কম বাজেটের সিনেমার ওপরে জোর দেওয়া হয়। প্রেক্ষাগৃহের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। কম খরচে ভালো প্রযুক্তির সিনেমা তৈরি অনেক বড় লড়াই। সেই লড়াইও জিততে চেষ্টা করছেন তারা। তিনি বলেন, আমার কানে খবর আসে। এরপরও কী করে বলব যে টালিউড চেষ্টা করছে না? দর্শকও যে পুরোপুরি মুখ ফিরিয়েছে, সেটিও নয়। আমি তো মনে করি, এটি আমাদের জন্য ইতিবাচক দিক।
এই প্রজন্মের অভিনেতাদের নিয়েও কি একই ভাবে আশাবাদী, ওরা আপনাদের মতো পরিশ্রমী? অভিনেত্রী বলেন, ওরা ওদের মতো। আমাদের থেকে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। অনেক বেশি আত্মনির্ভরশীল। বেশ কিছু ক্ষেত্রে ওরা আমাদের থেকেও বেশি জানে। সেসব ওদের কাজে ছায়া ফেলে। ভালো বা মন্দ— যেটাই করে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে করে— এটি প্রশংসা করার মতো।
বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতি দেখে মনে হয় ‘আতঙ্ক ২’ তৈরির উপযুক্ত সময়? আপনি সিক্যুয়েল বানাবেন?—এমন প্রশ্নের উত্তরে শতাব্দী বলেন, তপন সিংহের জুতায় পা গলাব। এত স্পর্ধা ও সাহস— কোনোটিই আমার নেই। তপনদা বলেই ওই সিনেমা তৈরি করতে পেরেছিলেন। আমি কেন, আজকের দিনে কেউ-ই ‘আতঙ্ক ২’ বানাতে পারবেন না।
ফেলে আসা দিন ডাকে? হইহই করতে করতে অভিনয়, সিনেমামুক্তি আর গ্ল্যামার...। শতাব্দী বলেন, আমার শতাব্দী রায় হয়ে ওঠার মাধ্যম তো ওই জীবন। এখনো আমি আগে অভিনেত্রী। অভিনয় আমাকে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা এনে দিয়েছে। কত অভিজ্ঞতা, কত ঘটনা জমে আছে। সেসব ভোলা যায় কখনো?
এখন সিনেমা ছাড়াও অনেক মাধ্যম— ছোটপর্দা, ওয়েব প্ল্যাটফর্ম। আপনার পরিচালনা করতে ইচ্ছা করে না? অভিনেত্রী বলেন, ওটা অনেক বড় বিষয়। প্রচুর সময় দিতে হবে। একটা সময় পরিচালনা করেছি তো। জানি, জুতা সেলাই থেকে চণ্ডীপাঠ— সব করতে হয়। অবশ্যই মাধ্যম অনেক। কিন্তু আমার হাতে যে সময় কম।
রাজনীতিতে বেশি অভিনয় করতে হয় নাকি বিনোদন জগতের পর্দায়? নিজেকে গোছাতে একটু বেশিই সময় নিয়ে শতাব্দী বললেন, করতেই হবে— এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। যারা যারা মনে করেন, অভিনয় করবেন; তারা করেন।
আবার একটু থেমে অভিনেত্রী বলেন, রাজনীতি বা বিনোদন দুনিয়ার বাইরের অনেকেও তো অভিনয় করেন। সম্পর্কে অভিনয় করেন। বাঁচার তাগিদে, ঠকানোর তাগিদে, ভালো থাকার তাগিদে এবং কাউকে খারাপ রাখার তাগিদেও অভিনয় করেন।
তিনি বলেন, শুধু রাজনীতি কিংবা বিনোদন দুনিয়ার মানুষকে কাঠগড়ায় দাঁড় করাবেন না। প্রতিদিনই আমাদের কোনো না কোনো কারণে অভিনয় করতেই হয় (হাসি)। এ প্রসঙ্গে আমার এক ভক্তে কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। এক ভক্ত প্রশ্ন করেছিলেন— ‘অভিনয়ের বাইরে কী করেন?’ আমি আমার লেখা কবিতার পঙ্ক্তি ধার নিয়ে বলেছিলাম— ‘অভিনয় করি না’।
শতাব্দী রায় এখনও কবিতা লেখেন? অভিনেত্রী বলেন, লিখি। তবে নিয়মিত লেখা হয় না। সারা দিনের পর হয়তো ইচ্ছেও করে না। তার ওপরে আমি খুবই কুঁড়ে। লিখছি, লিখব করতে করতে সময় পেরিয়ে যায়। আবার না লিখলেও মনখারাপ করে। যখন মন চায়, তখন লিখি।
টিকে/এসএন