প্রতিবাদ সত্ত্বেও বিদেশি নিয়ন্ত্রণে যাচ্ছে চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ টার্মিনাল

চট্টগ্রাম বন্দরের গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণে দেওয়ার প্রক্রিয়া এগিয়ে নেয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার, যদিও এ নিয়ে বিভিন্ন মহল থেকে বিরোধিতা ও প্রতিবাদ চলছে।

বিশেষ করে বন্দরের সবচেয়ে লাভজনক ও আধুনিক নিউমুরিং কনটেইনার টার্মিনাল (এনসিটি) দুবাইভিত্তিক অপারেটর ডিপি ওয়ার্ল্ডকে দেওয়ার বিষয়টি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে রয়েছে। ইতোমধ্যে সৌদি প্রতিষ্ঠান ‘রেড সি গেটওয়ে টার্মিনাল ইন্টারন্যাশনাল’ (RSGTI) পতেঙ্গা কনটেইনার টার্মিনালের (পিসিটি) পরিচালনার দায়িত্ব নিয়েছে। শনিবার প্রথমবারের মতো ওই টার্মিনালে বিদেশি জাহাজ পণ্য নিয়ে ভিড়েছে।

শুধু এনসিটি নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের বে-টার্মিনাল ও লালদিয়ার চর এলাকায় বিদেশি বিনিয়োগ আনার বিষয়েও আলোচনা চলছে। বাংলাদেশকে একটি আঞ্চলিক ম্যানুফ্যাকচারিং হাব হিসেবে গড়ে তোলার জন্যই এসব উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে বলে জানায় সরকার পক্ষ।

প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম সম্প্রতি চট্টগ্রাম সফরে এসে বলেন, চলতি বছরের সেপ্টেম্বরের মধ্যেই এসব প্রকল্পে বিদেশি বিনিয়োগ চূড়ান্ত করতে চায় সরকার। তাঁর ভাষায়, “চট্টগ্রাম বন্দরকে ঘিরে যে বিনিয়োগ হবে, তা দেশের ১৮ কোটির পাশাপাশি পুরো অঞ্চলের ৩০-৪০ কোটি মানুষের জন্য সুফল বয়ে আনবে।”

তবে এই উদ্যোগকে কেন্দ্র করে ব্যাপক সমালোচনা এবং মাঠ পর্যায়ে প্রতিবাদও দেখা দিয়েছে। জাতীয়তাবাদী শ্রমিক দল, বন্দর শ্রমিক ফেডারেশন, জামায়াতে ইসলামী ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠন এনসিটিসহ লাভজনক টার্মিনালগুলো বিদেশিদের হাতে তুলে দেওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে।

চট্টগ্রাম মহানগর জামায়াতের আমির শাহজাহান চৌধুরী বলেন, “বিদেশি বিনিয়োগ আমরা চাই, তবে তা হওয়া উচিত নতুন প্রকল্পে।"

চট্টগ্রাম বন্দর সংযুক্ত শ্রমিক-কর্মচারী ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক শেখ নুরুল্লাহ বাহার আশঙ্কা প্রকাশ করেন, "এনসিটি বিদেশিদের কাছে হস্তান্তরিত হলে প্রায় ৭ হাজার স্থানীয় শ্রমিক-কর্মচারী চাকরি হারাতে পারেন।"
তবে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ভাষ্য ভিন্ন। বন্দর চেয়ারম্যান রিয়ার অ্যাডমিরাল এসএম মরিুজ্জামান বলেন, এনসিটি নিয়ে এখনো আলোচনা চলছে, সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। তাঁর মতে বিদেশি অপারেটর এলে প্রতিযোগিতা বাড়বে, দক্ষতা ও আয়ও বাড়বে, কর্মসংস্থানেও হুমকি নেই।

বর্তমানে চট্টগ্রাম বন্দরে তিনটি প্রধান কনটেইনার টার্মিনাল রয়েছে—সিসিটি, এনসিটি ও পিসিটি। এর বাইরে রয়েছে আরও কয়েকটি ইয়ার্ড ও সাধারণ কার্গো বার্থ। এনসিটি ২০০১ সালে তৎকালীন বিএনপি সরকারের সময়ে নির্মাণ শুরু হয় এবং এটি এখন বন্দরের রাজস্বের প্রায় ৬০ শতাংশ সরবরাহ করে। আধুনিক যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত এই টার্মিনাল গত ১৭ বছরে প্রায় ১ কোটি ১৮ লাখ কনটেইনার হ্যান্ডলিং করেছে এবং এটি আগামী ১৫ বছর স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে পরিচালিত হতে সক্ষম।

সরকার বলছে, ২০৩০ সালের মধ্যে চট্টগ্রাম বন্দরের কনটেইনার হ্যান্ডলিং সক্ষমতা ৬ গুণ বাড়িয়ে প্রায় ৭৮ লাখ ইউনিটে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বিশ্লেষকরা সতর্ক করছেন, এই ধরনের নীতিগত সিদ্ধান্ত যেন দেশের সার্বভৌমত্ব ও অর্থনৈতিক স্বার্থকে ক্ষতিগ্রস্ত না করে।

সুশাসনের জন্য নাগরিক (সুজন) চট্টগ্রাম চ্যাপ্টারের সভাপতি অ্যাডভোকেট আখতার কবির চৌধুরী বলেন, “চট্টগ্রাম বন্দর দেশের অর্থনীতির লাইফলাইন। এর মালিকানা, পরিচালনা ও লাভজনকতা নিয়ে যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জনস্বার্থকে সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিতে হবে।”

আরআর/এসএন 

Share this news on:

সর্বশেষ

img
আরও ৪ মামলায় চিন্ময়কে দাসকে গ্রেফতার দেখানোর আদেশ দিল আদালত May 06, 2025
img
দেড় বছরের মেয়েকে স্কুলে নিয়ে গেলেন শুভশ্রী May 06, 2025
img
আওয়ামী দোসররা এখনো ব্যাঙের মতো মাথা তুলে ষড়যন্ত্র করছে: রিজভী May 06, 2025
img
গভীর রাতে অভিযান চালিয়ে সরকারি চাল-আটা উদ্ধার করল যৌথবাহিনী May 06, 2025
img
খালেদা জিয়ার বাসভবন ‘ফিরোজার’ নিরাপত্তায় সেনাবাহিনী May 06, 2025
img
অজয়ের রসিকতায় ঘুমের ওষুধ খেয়ে হাসপাতালে বন্ধুর বউ May 06, 2025
img
কাদের মোল্লাকে সংক্ষিপ্ত রায়ে ফাঁসি দেয়া হয়: শিশির মনির May 06, 2025
img
টিকটকের ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত, সময়সীমা বাড়াতে পারেন ট্রাম্প May 06, 2025
img
ব্যাংকিং খাতে সংকট: ২০ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি পৌনে দুই লাখ কোটি টাকা May 06, 2025
img
পদ্মায় ধরা পড়ল ১৫ কেজি ওজনের বিশাল পাঙাশ মাছ May 06, 2025