চার দশক পর চট্টগ্রাম বন্দরের মাশুল বাড়ছে

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ প্রায় চার দশক পর বন্দরের বিভিন্ন সেবার বিপরীতে মাশুল কাঠামো নতুন করে নির্ধারণের উদ্যোগ নিয়েছে। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এর পরিপ্রেক্ষিতে চলতি বছরের জুন মাসের মধ্যেই এই নতুন কাঠামো কার্যকর করার পরিকল্পনা নিয়েছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। নতুন কাঠামো অনুযায়ী কনটেইনার হ্যান্ডলিং, জাহাজ পাইলটিং এবং টাগবোটসহ বিভিন্ন সেবার বিপরীতে উল্লেখযোগ্য হারে ফি বাড়ানো হচ্ছে।

তবে বন্দরের প্রস্তাবনা ঘিরে ব্যবসায়ী মহলে দেখা দিয়েছে শঙ্কা। তাদের মতে, এই বাড়তি ব্যয় সরবরাহ শৃঙ্খলে প্রভাব ফেলবে। একই সঙ্গে আমদানি, উৎপাদন এবং রপ্তানি ব্যয় বাড়াবে। যার সরাসরি প্রভাব পড়বে সাধারণ মানুষের পণ্য খরচে। বন্দর ব্যবহারকারীরা জানান, বিদ্যমান কাঠামোতে চট্টগ্রাম বন্দর প্রতিবছর মুনাফা করছে। তাছাড়া বন্দর মূলত মাশুল আদায় করে ডলারে। প্রতিবছরই ডলারের বিপরীতে টাকার মূল্য কমছে। এ হিসেবে মাশুল এমনিতেই বেড়ে যাচ্ছে।

বন্দর কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে, তাদের সেবার মূল্য এখনও বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। এই বাস্তবতার মাঝখানে একটি ভারসাম্যপূর্ণ ও বাস্তবভিত্তিক মাশুল কাঠামো করা হবে। বর্তমানে যে কাঠামোতে মাশুল আদায় করা হয় তা ১৯৮৬ সালে নির্ধারণ করা হয়েছিল। মাঝখানে ২০০৮ সালে মাত্র ৫টি খাতে মাশুল হালনাগাদ করা হয়েছিল। মাশুল কাঠামো পুনরায় নির্ধারণ করতে ২০১৩ সালে একবার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। কিন্তু ওই সময় আর মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন মেলেনি। তাই আর এগোয়নি বন্দর কর্তৃপক্ষ।

২০১৯ সালে এসে ট্যারিফ হালনাগাদ করতে চেয়েছিল বন্দর। তখন মন্ত্রণালয়ের গ্রিন সিগন্যাল পেয়েও ব্যবহারকারীদের বিরোধিতায় মাশুল হালনাগাদ করতে পারেনি বন্দর কর্তৃপক্ষ। এরপর নানা সময়ে উদ্যোগ নেওয়া হলেও মাশুল কাঠামো পরিবর্তিত করতে পারেনি বন্দর।

সম্প্রতি মাশুল পুনরায় নির্ধারণ করতে বন্দর এবং মন্ত্রণালয় সরব হয়েছে। ব্যবহারকারীসহ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে বন্দর কর্তৃপক্ষ। চলতি বছরের জুনের শেষের দিকে ব্যবহারকারীদের চূড়ান্ত মতামত সাপেক্ষে মাশুল হালনাগাদ করতে পারে বন্দর। এর আগে ২০১৯ সালে আন্তর্জাতিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে বিস্তারিত পর্যালোচনার ভিত্তিতে যে প্রস্তাব তৈরি হয়, সেটির ভিত্তিতেই নতুন মাশুল কাঠামোর খসড়া করেছে বন্দর কর্তৃপক্ষ।

নতুন প্রস্তাবনায়, প্রতিটি ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ১৫ ডলার থেকে বাড়িয়ে ২৩ দশমিক ১৫ ডলার এবং ৪০ ফুট কনটেইনারের ক্ষেত্রে ২২ দশমিক ৫০ ডলার থেকে ৩৪ দশমিক ৮৩ ডলার করার কথা বলা হয়েছে। জাহাজ পাইলটিং চার্জ ৩৫৭ ডলার থেকে ৭০০ ডলারে উন্নীত করার প্রস্তাবও রয়েছে। তাছাড়া মোট ৫৬টি সেবার মধ্যে ১৮টি খাতে ৬০ শতাংশের বেশি, ১৭টি খাতে ২০ থেকে ৫৯ শতাংশ এবং ১৯টি খাতে ২০ শতাংশ পর্যন্ত বৃদ্ধি করা হয়েছে। মাত্র দুটি খাতে মাশুল কমানোর প্রস্তাব এসেছে।

চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্সের সিনিয়র সহ-সভাপতি এ. এম মাহবুব চৌধুরী বলেন, বন্দর চল্লিশ বছরে মাশুল বাড়ায়নি সেটি সঠিক নয়। মূলত প্রতি বছরই বেড়েছে। কারণ বন্দরের বিভিন্ন সেবার মূল্য পরিশোধ করা হয় ডলারে। ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের সঙ্গে সঙ্গে বন্দরের ট্যারিফ বেড়ে যায়। ২০০৮ সালে যখন ডলারের দাম ছিল ৭৬ টাকা। তখন আমরা ৭৬ টাকা হারে সেবার মূল্য দিতাম। প্রতি বছরই ডলারের দাম বাড়তে বাড়তে এখন সেটা ১২১ টাকা। আমরা এখন ১২১ টাকা কিংবা ক্ষেত্র বিশেষে আরও বাড়তি রেটেই বন্দরের মাশুল পরিশোধ করছি।

বিজিএমইএর প্রথম সহ-সভাপতি সেলিম রহমান বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে চট্টগ্রাম বন্দর ট্যারিফ বাড়ালে রপ্তানিমুখী শিল্প মারাত্মক চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে এবং পোশাক শিল্প টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে দাঁড়াবে।

২০২০ সালের করোনা পরবর্তী সময় থেকে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পখাত বিভিন্ন ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। পরবর্তীতে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দাবস্থা, চলমান ইসরাইল-ফিলিস্তিন যুদ্ধ, ইসরাইল-ইরান যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী জ্বালানির দাম বৃদ্ধি এবং সম্প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক বিভিন্ন দেশে বর্ধিত শুল্ক আরোপের ফলে বর্তমানে দেশের গার্মেন্টস শিল্পে মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে।

তিনি আরও বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময় থেকে দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রমূলকভাবে শ্রম অসন্তোষসহ নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হয়ে এ শিল্প বেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তিনি বর্তমান পরিস্থিতিতে জাতীয় রপ্তানির বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় বন্দরে ট্যারিফ বৃদ্ধির মতো রপ্তানিমুখী শিল্পের জন্য আত্মঘাতী সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে বিরত থাকতে সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে আহ্বান জানান।

চট্টগ্রাম বন্দরের চিফ পার্সোনেল অফিসার ও মুখপাত্র নাসির উদ্দিন বলেন, বন্দরের উন্নয়ন ও পরিচালন ব্যয় বহনের জন্য এই মাশুল সমন্বয় জরুরি। প্রতিবেশী দেশগুলোর তুলনায় এখনো চট্টগ্রাম বন্দরের হ্যান্ডলিং চার্জ অনেক কম। যেখানে চট্টগ্রামে ২০ ফুট কনটেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ ৪৩ দশমিক ৪০ ডলার, সেখানে কলম্বোতে তা ১০০ ডলার এবং সিঙ্গাপুরে ৭৫ ডলার।

এফপি/টিএ

Share this news on:

সর্বশেষ

img

জাকসু নির্বাচন ২০২৫

নির্বাচনে কারচুপি প্রমাণিত হলে চাকরি ছেড়ে দেব : জাকসুর সিইসি Sep 13, 2025
img
সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে আটক ১০ বাংলাদেশিকে হস্তান্তর করল বিএসএফ Sep 13, 2025
img
মেসিকে নিয়ে সুখবর দিলেন মাশচেরানো! Sep 13, 2025
img
পদত্যাগ করলেন জাকসু নির্বাচন কমিশনের আরেক সদস্য ড. স্নিগ্ধা Sep 13, 2025
img
শ্রীলেখাকে বয়কট ইস্যুতে নীরব পুলিশ, পদক্ষেপ নিল আদালত Sep 13, 2025
img
অবশেষে শেষ হলো জাকসুর ভোট গণনা Sep 13, 2025
img
সড়ক দুর্ঘটনায় ১১ বছরে প্রাণহানি ৮৬ হাজারের বেশি Sep 13, 2025
img
জামায়াত আমিরের উদ্দেশে নীলা ইসরাফিলের বার্তা Sep 13, 2025
img
আজ রাতেই প্রকাশিত হবে চাকসু নির্বাচনের সংশোধিত ভোটার তালিকা Sep 13, 2025
img
একাত্তর সম্মানের, জুলাইও অস্বীকার করা যাবে না : মাওলানা হালিম Sep 13, 2025
img
সুনামগঞ্জে কার-মোটরসাইকেল সংঘর্ষে নিহত ২ Sep 13, 2025
img
হঠাৎ মণিপুর সফরে গেলেন প্রধানমন্ত্রী মোদি! Sep 13, 2025
img
নেপালের নবনিযুক্ত প্রধানমন্ত্রী সুশীলা কার্কিকে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা Sep 13, 2025
img
ডাকসু নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এনসিপি নাই হয়ে গেছে : মোস্তফা ফিরোজ Sep 13, 2025
img
গ্রুপ অব ডেথে বাংলাদেশ নয়, শোয়েবের পছন্দ অন্য দুটি দল! Sep 13, 2025
img
মাহফুজ আলমের গাড়িতে ডিম নিক্ষেপ, ক্ষোভ প্রকাশ রাশেদ খাঁনের Sep 13, 2025
img
৩৩ বছর জাকসু হয়নি, অভিজ্ঞতা কম থাকায় ফল প্রকাশে সময় লাগছে: জাবি প্রক্টর Sep 13, 2025
img
এমপি-মন্ত্রী হওয়ার জন্য পাগল হবেন না : গয়েশ্বর Sep 13, 2025
img
জাকসুর ১৯ কেন্দ্রের ভোট গণনা শেষ Sep 13, 2025
img
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় রুমিন ফারহানার বিরুদ্ধে মশাল মিছিল Sep 13, 2025