হাসিনার ঘনিষ্ঠদের বিপুল সম্পদ যুক্তরাজ্যে, তদন্তে নেমেছে এনসিএ

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে ক্ষমতাচ্যুত শেখ হাসিনা সরকারের ঘনিষ্ঠ ব্যক্তিরা যুক্তরাজ্যে তাদের মালিকানাধীন সম্পত্তি লেনদেন করেছেন বলে ধারণা করা হচ্ছে। বাংলাদেশে ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে যখন দুর্নীতির অভিযোগের তদন্ত চলছে, তখন যুক্তরাজ্যে তাদের সম্পদ বিক্রি, বন্ধক কিংবা হস্তান্তর করা হচ্ছে। ব্রিটেনের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, যুক্তরাজ্যে কেবল গত এক বছরে বাংলাদেশের সাবেক সরকারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সম্পদ লেনদেনের অন্তত ২০টি আবেদন জমা পড়েছে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ান ও দুর্নীতিবিরোধী আন্তর্জাতিক তদন্ত সংস্থা ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ অনুসন্ধানে এসব তথ্য উঠে এসেছে। শনিবার এই প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে দ্য গার্ডিয়ান।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, স্বৈরশাসক শেখ হাসিনার পালিয়ে যাওয়ার প্রায় এক বছর পর বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকার বর্তমানে তীব্র দলীয় কোন্দল ও অর্থনৈতিক সংকট সামাল দিতে লড়ছে। এই প্রেক্ষাপটে লন্ডনের নাইটসব্রিজের টাউনহাউস বা সারের কোনো অভিজাত সড়কে অবস্থিত প্রাসাদসম বাড়ি যেন অনেক দূরের বিষয় বলে মনে হতে পারে। তারপরও যুক্তরাজ্যের এসব বিলাসবহুল সম্পদ এই নাটকীয়তার কেন্দ্রে উঠে এসেছে।

ঢাকায় তদন্তকারীরা আগের সরকারের প্রভাবশালী ও রাজনীতির সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা উচ্চ পদ ব্যবহার করে রাষ্ট্রীয় চুক্তি ও ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে লুটপাট করেছে। এরপর সেই অর্থ যুক্তরাজ্যে সম্পত্তি কেনায় খরচ করেছে।

গত মে মাসে ব্রিটেনের ‘এফবিআই’ নামে পরিচিত ন্যাশনাল ক্রাইম এজেন্সি (এনসিএ) শেখ হাসিনার উপদেষ্টা সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার লন্ডনের প্রায় ১ হাজার ৪৬৯ কোটি টাকার সম্পদ জব্দ করে। এই রহমান পরিবারের যুক্তরাজ্যের সম্পদের পোর্টফোলিও গত বছর গার্ডিয়ানের এক প্রতিবেদনে প্রকাশ করা হয়েছিল।

এর তিন সপ্তাহ পর সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরীর ১৭০ মিলিয়নের বেশি সম্পদ জব্দ করে এনসিএ। হাসিনার শাসনামলে বিপুল সম্পদ অর্জন করেন এই মন্ত্রী। যুক্তরাজ্যে ৩০০টিরও বেশি অ্যাপার্টমেন্ট থেকে শুরু করে বিলাসবহুল টাউনহাউসও রয়েছে তার।

দ্য গার্ডিয়ান ও ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের যৌথ তদন্তে ঢাকায় তদন্তাধীন শেখ হাসিনার সাবেক সরকারের কিছু ব্যক্তির সাম্প্রতিক সময়ে যুক্তরাজ্যে সম্পদ বিক্রি, হস্তান্তর বা নতুন করে বন্ধক রাখার তথ্য পাওয়া গেছে।

এসব লেনদেন কীভাবে এই সন্দেহভাজনরা এখনও লন্ডনে নির্বিঘ্নে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছেন সেই বিষয়ে প্রশ্ন তুলেছে। একই সঙ্গে এই লেনদেনে সহায়তা করা যুক্তরাজ্যের আইনজীবী ও আইনি পরামর্শকনগুলোর দায়িত্বশীলতা ও সতর্কতা গ্রহণের বিষয়েও প্রশ্ন উঠেছে।

বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিরা বর্তমানে ঢাকার তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত আরও সম্পদ জব্দের মাধ্যমে ব্রিটেন যাতে সতর্ক থাকে, সেই বিষয়ে দেশটির প্রতি আহ্বান জানাচ্ছেন। লন্ডনের এসব সম্পত্তিকে এখন দুর্নীতিবিরোধী এক বহুল প্রতীক্ষিত অভিযানের অংশ হিসেবে দেখছেন অনেকে।

যুক্তরাজ্যের ভূমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য অনুযায়ী, গত এক বছরে অন্তত ২০টি সম্পদের লেনদেন সংক্রান্ত আবেদন জমা পড়েছে। আর এসব আবেদন ঢাকায় তদন্তের আওতায় থাকা ব্যক্তিদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। এসব নথিপত্রে সাধারণত বিক্রি, হস্তান্তর বা বন্ধক মালিকানা পরিবর্তনের ইঙ্গিত দেয়।

গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সাইফুজ্জামান চৌধুরীর অবৈধ সম্পদের বিষয়ে তদন্তে আরও দুই ব্যক্তির সংশ্লিষ্টতা পেয়েছে দুদক। শেখ হাসিনার সরকারের পতনের পর গত এক বছরে তারা একাধিক সম্পদের লেনদেনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ওই দুই ব্যক্তির একজন হলেন সাবেক মন্ত্রী সাইফুজ্জামানের ভাই আনিসুজ্জামান। অপরজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি ব্যবসায়ী বললেও গার্ডিয়ান তার পরিচয় প্রকাশ করেনি।

ব্রিটেনের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানের তথ্য বলছে, সম্প্রতি আনিসুজ্জামান চৌধুরীর মালিকানাধীন চারটি সম্পত্তি বিক্রির চেষ্টা করা হয়। এর মধ্যে সেন্ট্রাল লন্ডনের রিজেন্টস পার্কের আশপাশের ১৬৩ কোটি টাকার সমমূল্যের জর্জিয়ান টাউনহাউস নামের একটি সম্পত্তি রয়েছে। গত বছরের জুলাইয়ে বিক্রি হয় সম্পত্তিটি। এটি বিক্রি হয়ে যাওয়ার পর থেকে এখন পর্যন্ত লেনদেনের জন্য আরও তিনটি আবেদন জমা পড়েছে।

দ্য গার্ডিয়ানকে আনিসুজ্জামান চৌধুরীর আইনজীবীরা বলেছেন, আনিসুজ্জামান চৌধুরীর কোনও সম্পদ জব্দ করার বৈধ কারণ আছে বলে বিশ্বাস করেন না তারা। কারণ ২০২৩ সালেই রিজেন্টস পার্কের সম্পত্তিটির বিক্রয় চূড়ান্ত হয়।

বেক্সিমকো গ্রুপের কর্ণধার কারাবন্দী সালমান এফ রহমানের ছেলে ও ভাতিজার মালিকানাধীন সম্পত্তির বিষয়ে যুক্তরাজ্যের জমি নিবন্ধন প্রতিষ্ঠানে আরও তিনটি ‘লেনদেনের আবেদন’ জমা পড়েছে। সালমানের ছেলে আহমেদ শায়ান এফ রহমান ও ভাতিজা আহমেদ শাহরিয়ার রহমানের বিষয়েও ঢাকায় তদন্ত করছে দুর্নীতি দমন কমিশন।

বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর আহসান মনসুর বলেছেন, আমরা জানি সম্পদ বিক্রির চেষ্টা চলছে এবং আমরা যুক্তরাজ্য সরকারকে আরও সম্পদ জব্দের নির্দেশ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনার আহ্বান জানাই।

তিনি বলেন, লেনদেন বন্ধ করে দেওয়ার মতো ব্যবস্থা নেওয়া হলে আমরা যথাযথ আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সম্পদ ফেরত আনার বিষয়ে আশাবাদী হতে পারি। দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আবদুল মোমেনও একই ধরনের কথা বলেছেন। গত মাসে তিনি বলেন, বিপ্লব-পরবর্তী সম্পদের লেনদেনের তোড়জোড়ের প্রেক্ষাপটে তিনি এনসিএকে আরও সম্পত্তি জব্দের আহ্বান জানিয়েছেন।

এমকে/এসএন

Share this news on:

সর্বশেষ

img
তিরিশে এসে বোঝা যায় প্রেমের মানে : শোলাঙ্কি রায় Nov 07, 2025
img
নির্বাচনী প্রচারণায় জামায়াতের প্রার্থী হেলাল উদ্দিনের মোটরসাইকেল শোভাযাত্রা Nov 07, 2025
img
নির্বাচনী হাওয়া বইছে, কেউ রুখতে পারবে না: প্রেস সচিব Nov 07, 2025
img
৩ মুসলিম দেশের মধ্যস্থতায় যুদ্ধবিরতিতে সম্মত সুদানের যোদ্ধারা Nov 07, 2025
img
জাতিসংঘের মতে, ২০২৫ হবে ইতিহাসের সবচেয়ে গরম বছরের একটি Nov 07, 2025
img
লক্ষ্মীপুরে আগুনে পুড়ল ১৫ দোকান Nov 07, 2025
img
শালিনির সহায়তা ছাড়া কিছুই সম্ভব হতো না: অজিত কুমার Nov 07, 2025
img
মা ন্যাওটা, সরল ভাষায় অনির্বাণের অনুভূতি প্রকাশ Nov 07, 2025
img
৭ নভেম্বর বিপ্লবের মহানায়কে পরিণত হন জিয়াউর রহমান: মির্জা ফখরুল Nov 07, 2025
img
ভোটার আইডি কার্ড বাতিল না করে সংশোধন করার নির্দেশ নির্বাচন কমিশনের Nov 07, 2025
img
ক্যারিয়ারের জন্য পরিবারকে কখনো ত্যাগ করতে চান না শ্বেতা ভট্টাচার্য Nov 07, 2025
img
মার্টিনেজকে বাদ দিয়েই আর্জেন্টিনার দল ঘোষণা Nov 07, 2025
img
সরাইলে ট্রাক ও অটোরিকশার সংঘর্ষে প্রাণ গেল ২ জনের Nov 07, 2025
img
ট্রাম্পের সম্ভাব্য ভারত সফর হতে পারে আগামী বছর Nov 07, 2025
img
রেকর্ড শাটডাউনে অচল যুক্তরাষ্ট্র, বাতিল হাজারো ফ্লাইট Nov 07, 2025
img
সরকার না পারলেও বিএনপি নির্বাচনের আবহ তৈরি করতে পেরেছে : জিল্লুর রহমান Nov 07, 2025
img
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড যেই করুক ছাড় দেবে না পুলিশ: ঢাকা রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি Nov 07, 2025
img
বিশ্বকাপকে সামনে রেখে ফ্রান্সের স্কোয়াড ঘোষণা, নেই তিন তারকা Nov 07, 2025
img
বাংলা ধারাবাহিকের ভিত্তি পার্শ্বচরিত্র : সুব্রত গুহরায় Nov 07, 2025
img
চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ১১ কোটি ডলারের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান হবে ৭৬০৭ জনের Nov 07, 2025