কাশ্মীর যেভাবে ভারত-পাকিস্তানের অংশ হলো

১৯৪৭ সাল থেকে শুরু হয়ে এখন পর্যন্ত মুসলিম অধ্যুষিত কাশ্মীর অঞ্চল নিয়ে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধ চলছে। হিমালয়ের পার্বত্য অঞ্চলে অবস্থিত ৮৬,০০০ বর্গ মাইলের এই এলাকাটি এক সময় স্বাধীন রাজ্য হিসেবে বিবেচিত হতো। বর্তমানে অঞ্চলটি ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে বিভক্ত আর উভয়েই কাশ্মীরকে নিজেদের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে দাবি করছে।

জানা গেছে, ১৮৪৬ খৃষ্টাব্দে ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও মহারাজা গোলাব সিংয়ের মধ্যে চুক্তি সম্পাদনের মধ্য দিয়ে প্রিন্সলি স্টেট হিসেবে জম্মু এবং কাশ্মীর গঠিত হয়। জম্মুর শাসনকর্তা গোলাব সিং ব্রিটিশ সরকারকে ৭৫ লাখ নানকশাহী রুপি প্রদানের বিনিময়ে কাশ্মীর উপত্যকা ও লাদাখ উইজারাত (বাল্টিস্তান, কার্গিল এবং লেহ) অঞ্চলকে জম্মুর সঙ্গে সংযুক্ত করে জম্মু ও কাশ্মীরের প্রথম রাজা হিসেবে শাসনভার লাভ করেন। সূত্র: ডেইলি স্টার

১৯৪৭ সালে ভারতবর্ষ ভাগের নীতিতে বলা হয়, ভারতবর্ষে যে ৫৫০টি প্রিন্সলি স্টেট রয়েছে, সেগুলি চাইলে স্বাধীন থাকতে পারবে অথবা স্টেটগুলির ইচ্ছে অনুযায়ী ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যে কোনো একটি দেশের সঙ্গে যোগ দিতে পারবে।

তখন মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জম্মু ও কাশ্মীর অঞ্চলের রাজা ছিলেন হিন্দু ধর্মাবলম্বী হরি সিং। অন্য প্রিন্সলি স্টেটগুলির মত হরি সিং ভারত বা পাকিস্তানের সঙ্গে একীভূত হতে চাননি। বলা হয়ে থাকে, তিনি জম্মু ও কাশ্মীরকে স্বাধীন রাখতে চাইছিলেন। আর তাই তিনি ভারত ও পাকিস্তানকে সহাবস্থানের সমঝোতা চুক্তি সাক্ষরের আহ্বান জানান।

পাকিস্তান দ্রুত এই আহ্বানে সাড়া জানায় এবং চুক্তিটি সাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুযায়ী জম্মু ও কাশ্মীরের বাসিন্দারা পাকিস্তানের সঙ্গে আগের মতোই ব্যবসা করার ও সেখানে ভ্রমণের সুবিধা লাভ করে। তবে ভারত চুক্তি সই না করে আলোচনার প্রস্তাব দেয়, যে আলোচনা কখনো বাস্তবে পরিণত হয়নি। সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি

দেশ ভাগের পর ভারত ও পাকিস্তান জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা শুরু হলে পাকিস্তানের নতুন সরকার হরি সিংকে পাকিস্তানের সঙ্গে যোগদানের আহ্বান জানান। একই সময় অনেকগুলি ঘটনা ঘটতে থাকে, যা পরবর্তীতে কাশ্মীরের ভাগ্য নির্ধারণ করে দিয়েছিল। কাশ্মীরের পশ্চিম সীমান্তের মুসলিম সম্প্রদায়ভুক্ত প্রজারা রাজা হরি সিংয়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ শুরু করে।

অন্যদিকে পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী অঞ্চল হতে পাশতুন উপজাতি গোষ্ঠীর লোকেরা কাশ্মীর আক্রমণ করে, তারা অগ্রসর হয়ে শ্রীনগরের দ্বারপ্রান্ত অব্দি পৌঁছে গিয়েছিল। সূত্র: ব্রিটানিকাডটকম

এমন দুর্যোগপূর্ণ পরিস্থিতিতে রাজা হরি সিং ভারতে পলায়ন করলেন এবং ভারতের কাছে সামরিক সাহায্যের আবেদন জানালেন। তবে সুযোগ বুঝে ভারত সাফ জানিয়ে দিল যে, ভারতের সঙ্গে যোগ দেয়ার চুক্তি করলেই কেবল সামরিক সাহায্য করা হবে।

ফলে হরি সিং একীভূত হওয়ার চুক্তিতে সই করতে রাজী হন। অতঃপর ১৯৪৭ সালের ২৬ অক্টোবর ‘ইন্সট্রুমেন্ট অব এক্সেসন’ নামে ভারতের সঙ্গে কাশ্মীরের একীভূত হওয়ার চুক্তিটি সম্পাদিত হয়। সূত্র: ন্যাশনাল জিওগ্রাফি ও ডেইলিস্টার

ভারত সরকার কাশ্মীরে সেনা মোতায়েন করলে পাকিস্তানও পাল্টা সামরিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে। ফলে ১৯৪৭-৪৮ খৃষ্টাব্দে ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে প্রথম যুদ্ধ সংগঠিত হয়। ১৯৪৮ সালের ১ জানুয়ারি ভারত জাতিসংঘের কাছে অভিযোগ জানায়। একই বছরের ১৩ অক্টোবর জাতিসংঘ ৪৭তম প্রস্তাব গ্রহণ করে। যেখানে পাকিস্তানকে সৈন্য সরিয়ে নিতে অনুরোধ করা হয়, একই সঙ্গে ভারতকেও সৈন্য সংখ্যা নূন্যতম করতে বলা হয়। জম্মু-কাশ্মীর অঞ্চলে অবাধ ও সুষ্ঠু গণভোট আয়োজনের মধ্য দিয়ে জনগণকে তাদের ভাগ্য নির্ধারণের সুযোগ দেয়ার কথাও এতে বলা হয়। সূত্র: টেলিগ্রাফ.কো.ইউকে

কিন্তু কাশ্মীরিদের ভাগ্য নির্ধারণের সেই গণভোট আর কখনোই অনুষ্ঠিত হয়নি। এ নিয়ে বিভিন্ন ধরণের মতবাদ রয়েছে। প্রচলিত মত অনুযায়ী পাকিস্তান জাতিসংঘের অনুরোধে সৈন্য প্রত্যাহার করেনি, আর তাই কাশ্মীরেও আর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়নি।

যাইহোক, ১৯৪৯ সালের ১লা জানুয়ারি দু’পক্ষ যুদ্ধবিরতির ব্যাপারে একমত হয়। তখন থেকে জম্মু-কাশ্মীরের ৬৫ শতাংশ এলাকা ভারতের নিয়ন্ত্রণে এবং বাকী এলাকা পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এভাবে দুই কাশ্মীরের মাঝখানে সৃষ্টি হওয়া সীমানাকে বলা হয় লাইন অব কন্ট্রোল বা লক। সূত্র: টেলিগ্রাফ.কো.ইউকে

১৯৪৮ খৃষ্টাব্দে ভারত নিয়ন্ত্রিত কাশ্মীরের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শেখ আব্দুল্লাহ দায়িত্ব গ্রহণ করেন। অতঃপর ১৯৪৯ সালে শেখ আব্দুল্লাহ ও রাজা হরি সিং দু’জনে মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে, সম্ভাব্য সর্বোচ্চ স্বায়ত্ত শাসনের ভিত্তিতে জম্মু-কাশ্মীর ভারতীয় যুক্তরাষ্টের সঙ্গে সংযুক্ত থাকবে।

এই দাবির প্রেক্ষিতে, ১৯৫১ খৃষ্টাব্দে ভারতীয় সংবিধানে ৩৭০ ধারাটি যোগ করার মধ্য দিয়ে কাশ্মীরকে বিশেষ মর্যাদা দেয়া হয়। এই বিশেষ মর্যাদা অনুযায়ী যোগাযোগ, পররাষ্ট্র নীতি এবং প্রতিরক্ষা নীতি ব্যতীত সব ক্ষেত্রেই কাশ্মীরের স্বাধীনতার কথা বলা হয়। সম্প্রতি ২০১৯ সালে ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী সংবিধানের ৩৭০ ধারটি বাতিল করেন। সূত্র: ইন্ডিয়া টুডে

ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করেছেন নাবিল জাহাঙ্গীর

 

টাইমস/এনজে/জিএস

Share this news on: