‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’-এর ট্রেলার লঞ্চ অনুষ্ঠানে শনিবারই বিস্তর ঝামেলা হয়েছিল। পরিচালকের বিরুদ্ধে ইতিহাস বিকৃত করে বিভাজনে উসকানি দেওয়ার অভিযোগ তুলেছিল নেটমাধ্যমের একাংশ। রবিবার সরাসরি ওই পরিচালকের বিরুদ্ধে বাংলাকে অসম্মান করার অভিযোগ এনে গর্জে উঠলেন টলিউডের একাধিক নামজাদা পরিচালক-প্রযোজক। বাঙালির অপমান মুখ বুঝে সহ্য করা হবে না বলে সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তাঁরা। তাঁদের অনেকের মত, ‘বেঙ্গল ফাইলস’ হোক। ‘কেরল ফাইলস’ হোক। ‘ছাবা’ হোক। কারণ সিনেমা দেখেই আমরা সত্য জানি। সিনেমা সমাজের দর্পণ। কিন্তু একই যুক্তিতে তাহলে ‘পরজানিয়া’, ‘ফিরাক’, ‘চাঁদ বুঝ গয়া’, ‘আবির গুলাল’, ‘ইন্ডিয়া: দ্য মোদি কোশ্চেন’ সিনেমাগুলির উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তোলা হচ্ছে না কেন? সত্য জানার সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে কেন?
উল্লেখ্য, বিবেক অগ্নিহোত্রীর ‘ফাইলস’ ট্রিলজির তৃতীয় রাজনৈতিক থ্রিলার ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’। খবর আগেই ছিল যে ‘তাসখন্দ ফাইলস’, ‘কাশ্মীর ফাইলস’ ছবির পর বাংলার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে ছবি বানাতে চলেছেন পরিচালক। যদিও গত বছর অক্টোবরে ছবির ফার্স্ট লুক প্রকাশ্যে আনার সময় সেটির নাম ছিল ‘দ্য দিল্লি ফাইলস’। তবে সাবলাইনে উল্লিখিত ছিল ‘দ্য বেঙ্গল চ্যাপ্টার’-এর কথা। পরে দর্শক চাহিদার কথা বলে ছবির নাম পাল্টে ফেলেন। তখন থেকেই তাঁর উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছিল। প্রসঙ্গত, ২০১৮ সালে ২০০৫ সালের ছবি ‘চকোলেট ডিপ ডার্ক সিক্রেটস’-এর শুটিংয়ের সময় বাঙালি অভিনেত্রী তনুশ্রী দত্তকে বিবেক অগ্নিহোত্রী যৌন হেনস্তা করেন। অভিযোগে দাবি করা হয়, এক পরিচালক তাঁকে ক্যামেরার পিছনে পোশাক খুলে নাচতে বলেন, যাতে অপর অভিনেতা ‘কিউ’ বুঝে নিতে পারে। তনুশ্রীর আইনজীবীর দাবি, পরিচালক নিজেই একটি ১০ পাতার আইনি নোটিসে ঘটনাটি স্বীকার করে নিয়েছেন, যেখানে তিনি লেখেন, “পরিচালকটি আমি নিজেই ছিলাম।”
এই স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে, তনুশ্রী ওশিওয়ারা থানায় লিখিত অভিযোগ দাখিল করে যৌন হেনস্তার মামলা করার জন্য পুলিশকে অনুরোধ জানান। নানা মহলে প্রশ্ন, জেলে যাওয়ার হাত থেকে বাঁচতেই কি বিজেপির হয়ে ‘প্রোপাগান্ডা সিনেমা’ বানাতে শুরু করেছেন এই পরিচালক। গত জুন মাসে ছবির ঝলকে যে রোমহর্ষক কোলাজ দেখিয়েছিলেন বিবেক, তাতে প্রশ্ন উঠেছিল, তিনি কি কোনও অভিসন্ধি নিয়েই বাংলার বিধানসভা ভোটের আগে নিজের সিনেমার নাম বদলে ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ রাখলেন? সেই প্রশ্নই রবিবার উঠে এসেছে টলিউডের পরিচালক-প্রযোজকদের মুখে।
জাতীয় পুরস্কারজয়ী পরিচালক গৌতম ঘোষ বলেছেন, “১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা পেলাম আমরা। দেশভাগ হলেও আসলে ভারত কি ভাগ হয়েছিল। ভাগ হয়েছিল বাংলা আর পাঞ্জাব। যে দেশের মানুষর সবচেয়ে বেশি লড়াই করেছিলেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, তাদের ভাগ করা হল। অনেক কারণ রয়েছে। কিন্তু সেই কারণগুলি নিয়ে যদি কাজ করতে হয় তাহলে গবেষণা করতে হয় বা দেশ ভাগ কেন হয়েছিল, ভাবতে হয়। আপনারা যদি কখনও আন্দামানের সেলুলার জেলে যান, দেখবেন একটি লম্বা ফলক রয়েছে। সেখানে প্রায় ৯০ শতাংশ রয়েছে বাঙালির নাম। তারপর পাঞ্জাবিরা, তারপর অন্যান্য জাতির মানুষ। ফলে বোঝাই যায়, কারা লড়াই করেছিলেন। এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মধ্যে আমরা বেঁচে আছি এবং চিরকাল বেঁচে থাকব। বাংলাকে বহুবার অপদস্থ করার চেষ্টা করা হয়েছে, কিন্তু পারেনি। বাংলা ভাষা আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হল বাংলা ভাষা। সেই বাংলাকে হেনস্তা করা আগেও সম্ভব হয়নি, ভবিষ্যতেও হবে না। বাঙালি তা করতে দেবে না। বিজেপি শাসিত রাজ্যগুলিতে বাঙালি দেখলেই হেনস্তা-অপমান করা হচ্ছে। বাঙালিকে আগেও হেনস্তা করা হলে মুখ বুজে সহ্য করা হয়নি। ভবিষ্যতেও হবে না। জয় বাংলা।”
পরিচালক অরিন্দম শীল বলেন, “কোন চলচ্চিত্র উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরি হচ্ছে, কোনটা প্রোপাগান্ডা করতে আর কোনটা সিনেমার জন্য সিনেমা, সেটা বোঝার মতো শিক্ষা ও ক্ষমতা সাধারণ মানুষের রয়েছে। সেই জনগণই বিবেক রঞ্জন অগ্নিহোত্রীর ‘দ্য বেঙ্গল ফাইলস’ ছবিটিকে প্রত্যাখ্যান করেছে। এটা নিয়ে আমরা যত বেশি কথা বলব, তত বেশি ওঁকে গুরুত্ব দেওয়া হবে। কোনও রকমের সংঘাত কিংবা প্ররোচনায় বাংলার মানুষ পা দেয় না। কোনও সাম্প্রদায়িক উসকানিতে পশ্চিমবঙ্গের জনতা প্ররোচিত হবে না।” আরও চাঁচাছোলা ভাষায় বিবেককে আক্রমণ করে তাঁকে গ্রেপ্তারির দাবি জানিয়েছেন প্রযোজক রানা সরকার। তাঁর কটাক্ষ, ‘আদতে তিনি কোনও চলচ্চিত্র পরিচালক নন, শুধুমাত্র বিজেপির বিজ্ঞাপন চলচ্চিত্র নির্মাতা। উনি যদি সিনেমা পরিচালক হতেন এবং রাজনৈতিক সিনেমা বানাতেন তাহলে সারা জীবনে একটা হলেও গল্পের অন্য দিকটাও বলতেন। ইতিহাসকে বিকৃত করে সস্তা সাম্প্রদায়িক সুড়সুড়ি দিয়ে সিনেমার বক্সঅফিস ভরানো না, ব্যালট বক্স ভরানোর উদ্দেশ্যে উনি সিনেমা বানান। ২০২৬ ভোটের আগে হিন্দু-মুসলিম অশান্তি সৃষ্টি করতে উনি এসেছেন। এরপর কলকাতায় এলে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়ার দায়ে ওঁকে গ্রেপ্তার করা হোক।”
এফপি/ টিএ