আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে জিরোটলারেন্স নীতিতে এগোচ্ছে পুলিশ

ঘনিয়ে আসছে ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচন। তবে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক না হলেও আগের তুলনায় ক্রমেই কঠোর হচ্ছে পুলিশ। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে জিরোটলারেন্স নীতিতে এগোচ্ছে তারা। এর মধ্যে অবৈধ অস্ত্র, মাদক এবং চাঁদাবাজি বন্ধে পুলিশ সদর দপ্তর থেকে মাঠ পর্যায়ে দেওয়া হয়েছে বিশেষ বার্তা।

অপরাধ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে ‘জিরো টলারেন্স’ ঘোষণার কথাও ভাবছে সরকারের শীর্ষ মহল। যদিও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মধ্যে এখনো বিস্তর ফারাক। সরকারের উচিত হবে অতি দ্রুত নেপথ্য কারণ বের করে এর সুস্পষ্ট সমাধান করা।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি বর্তমানে যেভাবে রয়েছে, আমার মনে হয় নির্বাচন করতে তেমন অসুবিধা হবে না।

অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের জন্য আমরা পুরস্কারের ঘোষণাও দিয়েছি। আমরা মাঠপর্যায়ে নির্বাচনি কার্যক্রম অনেক আগে থেকেই শুরু করেছি। আমার দায়িত্ব ভোট কেন্দ্র দেখা না, ভোটের প্রস্তুতি গ্রহণ করা। বাইরে থেকে কী ধরনের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে সে বিষয়ে খোঁজ নেওয়া।

জানা গেছে, গত বৃহস্পতিবার ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকে কঠিন হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন খোদ কমিশনার সাজ্জাত আলী। ছিনতাই, চাঁদাবাজি রোধে সাঁড়াশি অভিযান পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। আগাম প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা হিসেবে ফুট প্যাট্রলিং এবং মোটরসাইকেল প্যাট্রলিং বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানের সিসিটিভি ক্যামেরা সচল আছে কিনা তা দেখে ব্যবস্থা নেওয়াসহ টানা পার্টি দমনে বিশেষ নির্দেশ দেন কমিশনার।

সূত্র বলছে, রাজধানীসহ দেশের প্রায় সব এলাকাতেই ঘটছে খুনাখুনি, চাঁদাবাজি, রাজনৈতিক হানাহানি এবং সামাজিক বিরোধের মতো ঘটনা।

সীমান্ত দিয়ে এখনো আগের মতোই ঢুকছে ভয়ংকর সব আগ্নেয়াস্ত্র-মাদক। পুলিশ সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী, গত এক বছরে (জুলাই ২০২৪ থেকে জুন ২০২৫) হত্যা মামলা ৩ হাজার ৮৫৭। আগের মামলা বাদ দিয়েও মাসে গড়ে ২৮৮। অথচ চলতি বছরের জানুয়ারি-জুনে গড় ছিল ২৫৬। বাড়ছে খুন। শুধু ঢাকা রেঞ্জেই ৯০৩টি মামলা। রাজধানীতেই ছয় মাসে ২১৭ খুন, এর বেশির ভাগ রাজনৈতিক কারণে। এক বছরে ডাকাতি-দস্যুতা মামলা ২ হাজার ৪৫৭। আগের বছরের চেয়ে ৮৩৮ বেশি। গড়ে মাসে ২০৫। সর্বাধিক মামলা ঢাকা রেঞ্জে ৫৮০, মহানগরে ৪৫২। মহাসড়কে রাতের পর রাত গণডাকাতি। কোথাও র‌্যাব পরিচয়ে বাস থামিয়ে প্রবাসীর মালামাল লুট, কোথাও গ্রামবাসী অস্ত্র ঠেকিয়ে সর্বস্ব খোয়াচ্ছে। আতঙ্কে বহু এলাকায় গ্রামবাসী রাত জেগে পাহারা দিচ্ছে। এদিকে সারা দেশে গত ২৪ ঘণ্টায় ১ হাজার ৮৮০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর।

অপরাধ বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজ কল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক ড. তৌহিদুল হক বলেন, প্রত্যাশা এবং প্রাপ্তির মাঝে অনেক ফারাক। পুলিশের নিজস্ব পরিসংখ্যানই দেখাচ্ছে পরিস্থিতি খারাপের দিকে। যত দিন যাবে, নির্বাচনের আগে অপরাধ আরও বাড়বে। অতীত অভিজ্ঞতাও তাই বলে। নির্বাচন ঘিরে অশনি সংকেত স্পষ্ট। সরকারের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এখন অপরাধ দমন, আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। তিনি আরও বলেন, অপরাধীকে অন্য কোনো পরিচয়ে বিবেচনা করা হলে ভবিষ্যতে এর ভয়াবহ খেসারত দিতে হবে সরকারকে। জুলাই বিপ্লবের পর ভেঙে পড়া পুলিশের মনোবল এখনো পুরোপুরি পুনরুদ্ধার হয়নি। এখনো অভিযানে আতঙ্কে ভুগছে পুলিশ সদস্যরা। মাঝেমাঝেই ঘটছে পুলিশের ওপর হামলার ঘটনা। অপরাধীদের ধরতে গেলেই চলছে তদবির-রাজনৈতিক চাপ। বিপরীতে বেপরোয়া হচ্ছে অপরাধীরা। দোকান না দিলে দোকান দখল, হাসপাতাল না দিলে হামলা, মাছের খামারে বিষ দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বিশাল মাছ প্রকল্পও চলে গেছে চাঁদাবাজদের কবলে। চাঁদাবাজির প্রতিবাদে ময়মনসিংহে হাসপাতাল মালিকরা ও রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করছেন। পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা এ প্রতিবেদককে বলছেন, মাঝেমাঝেই তারা আইন প্রয়োগে বাধার মুখে পড়ছেন। বিভিন্ন সংস্থার সদস্যদের ভূমিকা অনেকটা গ্যালারিতে বসে খেলা দেখার মতোই। জানা গেছে, রাজধানীর কারওয়ান বাজার, শাহবাগ, ধানমন্ডির ২৫ স্পট ছিনতাইকারীদের দখলে। রাজধানীতে সক্রিয় ছিনতাইকারী অন্তত ৯ শতাধিক।

৫ আগস্ট থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত ছিনতাইকারীদের হাতে নিহত সাতজন। সর্বশেষ কারওয়ান বাজারে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে আহত হন বঙ্গভবন নিরাপত্তার অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সুমন রেজা। এর আগেও শাহবাগ, ধানমন্ডি, পুরান ঢাকায় একের পর এক রক্তাক্ত ছিনতাই। পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ডাকাতি-ছিনতাইও থামছে না। জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত ডাকাতি মামলা হয়েছে ১,৩৬৩। এর মধ্যে মে মাসেই ২৪৪টি। মহাসড়কে কুমিল্লা, পাবনা, পঞ্চগড়ে গণডাকাতি। ঘরে ঢুকে খুন, রাস্তায় অস্ত্র ঠেকিয়ে লুট। এর বাইরে গত ৯ জুলাই মিটফোর্ডে ব্যবসায়ী সোহাগ ওরফে লাল চাঁদকে খুনের বীভৎস দৃশ্য এখনো ভুলতে পারছেন না অনেকেই। ৮ মে বাড্ডায় ঠিকাদার আনোয়ার হোসেন, পুলিশ প্লাজার সামনে টেলি সুমন হত্যাকাণ্ড এবং ১৫ মে একই এলাকায় বিএনপি নেতা কামরুল আহসান সাধনকে গুলি করে হত্যার ঘটনাও আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির স্বাভাবিকতা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে। অন্যদিকে সেনাবাহিনীর বরখাস্তকৃত মেজর সাদিক দম্পতির ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের প্রশিক্ষণের বিষয়টি ভাবিয়ে তুলেছে সরকারের শীর্ষ মহলকে। যদিও পুলিশ পরিদর্শক বাহারুল আলম দাবি করেছেন, নির্বাচন সামনে রেখে বিশেষ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছে। র‌্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপস্) কর্নেল ইফতেখার আহমেদ বলেন, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে র‌্যাবের প্রতিটি সদস্য তাদের সামর্থ্য অনুযায়ী সর্বোচ্চটা দিয়ে কাজ করছে।

এফপি/ টিকে

Share this news on:

সর্বশেষ

img
বিশ্বে প্রায় ৯০ কোটি মানুষ জলবায়ু বিপর্যয়ের ঝুঁকিতে : জাতিসংঘ Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদে স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে অংশ নেয়নি এনসিপি Oct 17, 2025
img
যুদ্ধবিরতি লঙ্ঘনের অভিযোগের মধ্যেও চলছে বন্দি বিনিময় Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষর করলেন প্রধান উপদেষ্টা ও রাজনৈতিক দলের নেতারা Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদে স্বাক্ষর করল রাজনৈতিক দলগুলো Oct 17, 2025
img

সাত কলেজ নিয়ে মান্না

স্বতন্ত্র ঐতিহ্য নষ্ট করা অন্যায় Oct 17, 2025
img
আমরা এখনও আদর্শ জুটি খুঁজছি: সিমন্স Oct 17, 2025
img
সবার ইশতেহার সমন্বয় করে কাজ করবো: রাকসু ভিপি Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান ঘিরে কঠোর নিরাপত্তা Oct 17, 2025
img
লোকসংগীতের প্রাণ লালন সাঁইকে স্মরণে তিরোধান দিবস Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছেন বিএনপি, জামায়াতসহ বিভিন্ন দলের শীর্ষ নেতৃবৃন্দ Oct 17, 2025
img
বঙ্গোপসাগরে লঘুচাপ সৃষ্টি হতে পারে : আবহাওয়া অধিদপ্তর Oct 17, 2025
img
জাতীয় সংগীত দিয়ে জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠান শুরু Oct 17, 2025
বাংলাদেশের বিপক্ষে মাঠে নামার আগে যা বললেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের কোচ ড্যারেন স্যামি Oct 17, 2025
সালাহউদ্দিনের নজর জুলাই জাতীয় সনদের ৫ নং দফায় Oct 17, 2025
img
জুলাই সনদ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মির্জা ফখরুল ও সালাহউদ্দিন Oct 17, 2025
img
খাগড়াছড়িতে বাস উল্টে ২ জনের প্রাণহানি Oct 17, 2025
img
‘জুলাই জাতীয় সনদ ২০২৫’ স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে যোগ দিলেন প্রধান উপদেষ্টা Oct 17, 2025
img
জীবিত থাকতে প্রশংসা করি না, চলে গেলেই যত আদিখ্যেতা : বাপ্পারাজ Oct 17, 2025
img
দাবি আদায়ে শহীদ মিনারে অনশনে এমপিওভুক্ত শিক্ষকরা Oct 17, 2025