নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত পুরুষ। অবিভক্ত বাংলা ও ভারত বর্ষের স্বাধীনতা আন্দোলনের অন্যতম মহানায়ক। সুভাসচন্দ্র বসু ১৮৯৭ সালের ২৩ জানুয়ারি বেঙ্গল প্রদেশের উড়িষ্যার কাটাকে এক কায়স্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। মেট্রিক পাশ করার পর ১৯১৩ সালে কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। সেখানে তিনি স্বামী বিবেকানন্দ ও রামকৃষ্ণের লেখা দ্বারা প্রভাবিত হন।
ব্রিটিশ কর্তৃক ভারতীয়দের অবমাননা এবং প্রথম বিশ্বযুদ্ধ এই দু’টি ঘটনা সুভাসচন্দ্র বসুর চিন্তাধারাকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত করে। একদিন ভারতবিরোধী মন্তব্যের কারণে প্রফেসর ওয়াতেনকে মারধরের অভিযোগে তাকে কলেজ থেকে বের করে দেয়া হয়। যদিও এ ঘটনায় জড়িত ছিলেন না বলে তার দাবি। এ ঘটনার পর তার মধ্যে চরম জাতীয়তাবাদী মনোভাবের প্রকাশ ঘটে।
১৯১৮ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে দর্শন বিষয়ে বিএ পাস করেন। পরে ইন্ডিয়ান সিভিল সার্ভিসে যোগ দেন। কিন্তু ব্রিটিশ সরকারের অধীনে কাজ করতে চান না। তাই ১৯২১ সালে চাকরী ছেড়ে দেন। এরপর তিনি ‘স্বরাজ’ পত্রিকা প্রকাশ করেন এবং বিপ্লবী চিত্তরঞ্জন দাস ছিলেন তার গুরু। ১৯২৪ সালে তিনি কলকাতা মিউনিসিপ্যাল কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচিত হন।
অন্যান্য জাতিয়তাবাদীদের সঙ্গে ১৯২৫ সালে তাকে গ্রেফতার করে ব্রিটিশ সরকার। ১৯২৭ সালে মুক্তির পর তিনি ভারতীয় কংগ্রেসের সেক্রেটারি নিযুক্ত হন। ভারত বর্ষের স্বাধীনতার দাবিতে তিনি নেহরুর সঙ্গে যোগ দেন। কিছুদিন পরে তাকে আবার গ্রেফতার করা হয়। ১৯৩০ সালে আবার কলকাতার মেয়র নির্বাচিত হন।
মুক্তির পর তিনি ইউরোপ চলে যান। সেখানে ভারতীয় শিক্ষার্থী ও বেনিতো মুসোলিনীসহ বিভিন্ন ইউরোপীয় রাজনীতিবিদের সঙ্গে দেখা করেন। তিনি ‘দ্য ইন্ডিয়ান স্ট্রাগল’ নামে বই লিখেন। তবে ব্রিটিশ সরকার তার এই বইকে নিষিদ্ধ করে দেয়।
১৯৩৯ সালে তিনি কংগ্রেসের সভাপতি নির্বাচিত হন। কিন্তু তার বিপ্লবী চিন্তা ধারার কারণে গান্ধী ও নেহরুর সঙ্গে মতবিরোধ দেখা দেয়। ফলে তিনি কংগ্রেস থেকে পদত্যাগ করেন।
তিনি বিপ্লবী ধারার সমর্থকদের নিয়ে ‘অল ইন্ডিয়া ফরওয়ার্ড ব্লক’ গড়ে তুলেন। তিনি ছিলেন সমাজতান্ত্রিক কর্তৃত্ববাদে বিশাসী। তুরস্কের জনক কামাল আতাতুর্কের সঙ্গে তিনি দেখা করতে চান। ব্রিটিশরা সে সুযোগ দেয়নি। পরে তিনি ব্রিটেনের লেবার পার্টির নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন।
১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সুভাসচন্দ্র বসু ব্রিটিশদের সহযোগিতা করতে আপত্তি জানান। ব্রিটিশ সরকার তাকে গ্রেফতার করে। অনশনের ফলে সাত দিন পর তিনি মুক্তি পান। মুক্তির পর জার্মানিতে পালিয়ে যান। তিনি আজাদ হিন্দ রেডিওতে কাজ শুরু করেন। তিনি বার্লিনে ‘ফ্রি ইন্ডিয়া সেন্টার’ প্রতিষ্ঠা করেন এবং সাড়ে চার হাজার ভারতীয় বিদ্রোহীদের নিয়ে দল গঠন করেন।
ভারতকে স্বাধীন করতে তিনি জার্মান নাৎসি বাহিনীর সঙ্গে মিলে ভারত আক্রমণের জন্য প্রস্তুত ছিলেন। ১৯৪২ সালে হিটলারের সঙ্গে দেখা করেন। তার পরামর্শে তিনি জাপানি সাবমেরিনে করে ভারতের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করেন।
১৯৪৩ সালে তিনি সিঙ্গাপুর আসেন এবং এখানে রাশবিহারী বসু সেখানকার ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির নিয়ন্ত্রণ সুভাস বসুর হাতে ছেড়ে দেন। ১৯৪৪ সালের ৪ জুলাই বার্মায় ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল আর্মির উদ্দেশ্যে এক বক্তব্যে তিনি বলেন, “তোমরা আমাকে রক্ত দাও, আমি তোমাদের স্বাধীনতা দেব।”
এসময় ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য তিনি ভারতীয়দের প্রতি আহবান জানান। এখান থেকেই জাপান সেনাদের সাহায্যে তিনি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালিয়ে যান। ১৯৪৫ সালের ১৮ আগস্ট তাইওয়ানে এক বিমান দুর্ঘটনায় মারা যান মহান বিপ্লবী নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু।
তিনি বলেছিলেন, “একটি আদর্শের জন্য একজন ব্যক্তি মারা যেতে পারে, কিন্তু একটি আদর্শ হাজার হাজার মানুষকে বাঁচাতে পারে।”
নাৎসি বাহিনীকে সহযোগিতার কারণে অনেকের কাছে নেতাজী সুভাসচন্দ্র বসু একজন বিতর্কিত ব্যক্তি। প্রকৃতপক্ষে, তিনি একজন চরম দেশপ্রেমিক জাতিয়বাদী নেতা। ব্রিটিশ দুঃশাসনের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাসে স্বর্ণাক্ষরে লিখা থাকবে।
টাইমস/এএইচ/জিএস