ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষদিক থেকে বিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভ—বাংলার সমাজ যেন এক অগ্নিপর্বের ধূসর ছায়ায় আচ্ছন্ন, যেখানে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের কঠোর শৃঙ্খল, সামাজিক কুসংস্কার, নারীর নিপীড়ন এবং দরিদ্র মানুষের নীরব যন্ত্রণার সঙ্কট প্রতিটি জীবনকে বেধে রেখেছিল। এই অন্ধকারময় প্রেক্ষাপটে ১৮৭৬ সালের ১৫ সেপ্টেম্বর জন্ম নিলেন শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় যিনি কেবল একজন কথাসাহিত্যিকই নন, বরং মানবতার অন্তর্দৃষ্টি ও সমাজচিন্তার এক অগ্নিশিখা। তাঁর কলম ছিল এক প্রজ্বলিত দীপ, যা গ্রামীণ ও শহুরে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি উদ্ভাসিত করত, নিপীড়িত নারীর নীরব কণ্ঠকে স্বাধীনতার ভাষায় প্রকাশ করত, আর শোষিত মানুষের হৃদয়ে অমলিন আশা ও দৃঢ়চেতার বীজ বুনে দিত।
শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, মানুষের জীবন কেবল বেঁচে থাকার সংগ্রাম নয়; এটি নৈতিকতা, আত্মসম্মান এবং সামাজিক দায়বদ্ধতার অন্বেষণ, যেখানে প্রত্যেকটি চরিত্র তার অন্তর্নিহিত শক্তি দিয়ে সমাজের অন্ধকারের মধ্যেও আলো সৃষ্টি করতে পারে। তাঁর সাহিত্য সমাজের কুসংস্কার, অসাম্য, দারিদ্র্য এবং নারীর সীমাবদ্ধতাকে শুধু বাস্তবতার প্রতিফলন হিসেবে দেখায় না; বরং এগুলোর মধ্য দিয়ে তিনি পাঠককে নৈতিক ও দার্শনিক আলোকে নিমজ্জিত করেন।
‘দেবদাস’-এ দেবদাস ও পার্বতীর প্রেম কেবল রোমান্টিক আবেগ নয়; এটি সামাজিক বিধিনিষেধ, অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এবং নৈতিকতার সংঘাতকে তুলে ধরে। পার্বতীর চরিত্রের যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে আমরা দেখি, সমাজের শিকল ভাঙা কঠিন হলেও অসম্ভব নয়। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, নারীর আত্মসম্মান, চেতনা এবং সামাজিক মর্যাদা রক্ষা করা প্রতিটি মানুষ ও সমাজের নৈতিক দায়িত্ব। প্রতিটি চরিত্র যেন আমাদের চোখে বাস্তব জীবনের প্রতিবিম্ব হয়ে ওঠে, যেখানে মানবিক মূল্যবোধ ও নৈতিক দায়িত্ব এক অপরিহার্য দিক।
নারীচরিত্র শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক দর্শনের এক অপরিহার্য ভিত্তি। ‘দত্তা’-র বিজয়া, ‘চরিত্রহীন’-এর কিরণময়ী, ‘পল্লীসমাজ’-এর রমা—এরা শুধু নারী নয়, বরং আত্মসম্মান, বুদ্ধি এবং সাহসের জীবন্ত প্রতীক। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, নারীর শিক্ষা ও মর্যাদা সমাজ সংস্কারের মূল ভিত্তি। তারা শোষণ ও সামাজিক বিধিনিষেধের শিকল ভাঙে, নিজের পরিচয় প্রতিষ্ঠা করে এবং সমাজের দৃষ্টিভঙ্গিতে নতুন দিগন্ত খুলে দেয়। তিনি বিশ্বাস করতেন, নারী শুধু পরিবারে নয়, সমাজের সর্বত্র পরিবর্তন আনার শক্তি রাখে। বুদ্ধদেব বসুর কথায়,
“শরৎচন্দ্র নারীকে কেবল চরিত্রের পাত্র হিসেবে নয়, বরং আত্মসম্মানের এক স্বাধীন শক্তি হিসেবে গড়ে তুলেছেন।”
শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কেবল নারী মুক্তির দিকে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি দরিদ্র মানুষের অধিকার, কৃষক ও শ্রমিকের সংগ্রাম এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়েও গভীর মনন করেছেন। ‘পল্লীসমাজ’-এর গ্রামীণ চিত্র কেবল এক গ্রামের জীবন নয়; এটি দারিদ্র্য, অন্ধবিশ্বাস, ধর্মীয় বিধিনিষেধ এবং নারীর সীমাবদ্ধতার মধ্য দিয়ে সমাজের অন্তর্দৃষ্টি উদ্ঘাটন করে। রমা এবং অন্যান্য নারী চরিত্ররা দেখান, কেবল সমাজের শৃঙ্খল ভাঙলেই নয়, বরং ব্যক্তির নিজস্ব বুদ্ধি ও সাহস দিয়েই পরিবর্তনের সূচনা সম্ভব। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, সমাজ সংস্কার মানে শুধুই বাইরে থেকে নীতি প্রণয়ন নয়; এটি ব্যক্তির অন্তর্দৃষ্টি ও নৈতিক চেতনার সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত।
শরৎচন্দ্রের দার্শনিক চিন্তা অনুযায়ী, সমাজের অন্ধকার কখনো স্থায়ী নয়। মানুষের নৈতিকতা, শিক্ষা ও মানবিক মূল্যবোধ সমাজে আলো বিস্তার করতে পারে। প্রতিটি গল্পে তিনি দেখিয়েছেন, চরিত্রের সংকট, আশা ও সংগ্রাম কেবল ব্যক্তিগত নয়, বরং সমষ্টিগত সমাজ সংস্কারের প্রতিফলন। ছোটবেলায় জীবনসংগ্রামের মধ্য দিয়ে অর্জিত তাঁর অন্তর্দৃষ্টি, শারীরিক অসুস্থতা এবং সামাজিক শৃঙ্খলের অভিজ্ঞতা তাঁকে মানবিক ও দার্শনিক দৃষ্টিভঙ্গিতে সমৃদ্ধ করেছে।
‘শ্রীকান্ত’-এর চরিত্রগুলি দেখায় কিভাবে ব্যক্তি ও সমাজের মধ্যকার অবিচ্ছিন্ন সংঘাত মানুষের নৈতিক দিককে প্রভাবিত করে। শ্রীকান্তের চরিত্র একদিকে নিজের স্বপ্ন ও নৈতিক দায়িত্ব নিয়ে লড়ছে, অন্যদিকে সমাজের অন্যায় ও অসাম্যের সঙ্গে সংগ্রাম করছে। এটি শুধুই গল্প নয়; এটি আমাদের শেখায়, যে সমাজকে আমরা মানবিক ও ন্যায্য করতে চাই, তার জন্য প্রত্যেকের নৈতিক দায়িত্ব অপরিহার্য।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্যিক দক্ষতা কেবল সামাজিক বাস্তবতা চিত্রায়ণে সীমাবদ্ধ নয়; তিনি আমাদের মানবিক অন্তর্দৃষ্টির গভীরতার দিকে নিয়ে যান। ‘চরিত্রহীন’-এর কিরণময়ীর সংকট কেবল নারী নিপীড়নের প্রতিফলন নয়; এটি সমাজের নৈতিক ব্যর্থতা, ব্যক্তি ও পরিবেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব এবং স্বাধীনচেতা নারীচরিত্রের উদ্ভাসনকে নির্দেশ করে। তাঁর সাহিত্যে প্রতিটি চরিত্রের সংকট ও সংগ্রাম পাঠককে এক প্রাঞ্জল নৈতিক আলোকে নিমজ্জিত করে।
আজকের প্রাসঙ্গিকতায় দেখা যায়, শরৎচন্দ্রের শিক্ষা সমান গুরুত্বপূর্ণ। নারী শিক্ষা, বাল্যবিবাহ, সামাজিক বৈষম্য—এসব সমস্যা আজও বিদ্যমান। ২০২৫ সালের ইউনিসেফ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, বাংলাদেশের প্রতিটি চারজন কিশোরীর মধ্যে একজন এখনো বাল্যবিবাহের ঝুঁকিতে রয়েছে। এটি স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, শরৎচন্দ্রের সাহিত্য কেবল অতীতের প্রতিচ্ছবি নয়; এটি সমসাময়িক সমাজ সংস্কারের জন্য এক শক্তিশালী শিক্ষা ও অনুপ্রেরণার উৎস।
শরৎচন্দ্রের গল্প ও চরিত্রসমূহ আমাদের শেখায়, কিভাবে মানুষের নৈতিকতা, শিক্ষা, সহমর্মিতা এবং সাহস সমাজ পরিবর্তনের শক্তি হিসেবে কাজ করতে পারে। প্রতিটি গল্পের নিপীড়িত নারী, সংগ্রামী কৃষক, দারিদ্র্যজর্জরিত চরিত্র—এসব কেবল সাহিত্যিক প্রতিচ্ছবি নয়; তারা আমাদেরকে আজও নৈতিক দায়িত্ব, সহমর্মিতা এবং সামাজিক চেতনার দিকে মনোনিবেশ করতে প্রেরণা দেয়। শরৎচন্দ্র দেখিয়েছেন, সমাজ সংস্কার শুধুমাত্র বাহ্যিক প্রণয়ন বা আইন নয়; এটি মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং স্বাধীন চিন্তাশক্তির মাধ্যমে সম্ভব।
শরৎচন্দ্রের দর্শন, তার চরিত্র নির্মাণ এবং সমাজের প্রতি তার গভীর অন্তর্দৃষ্টি আমাদের দেখায়, সমাজ সংস্কার ও মানবিক উন্নতি কখনো সহজ নয়; কিন্তু নৈতিক চেতনা, শিক্ষা এবং সাহসের সঙ্গে মানুষের প্রত্যেক ছোট পদক্ষেপই সমষ্টিগত পরিবর্তনের শক্তি সৃষ্টি করে। এই দৃষ্টিভঙ্গি আজকের প্রজন্মের জন্যও সমান প্রাসঙ্গিক।
শরৎচন্দ্রের সাহিত্য আজও আমাদের মনে করিয়ে দেয়, সমাজের অন্ধকার যত ঘন হোক না কেন, মানবিক অন্তর্দৃষ্টি, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সাহস সেই অন্ধকারকে ছেদ করে আলোর পথে পরিচালিত করতে পারে। তার নিপীড়িত নারী, সংগ্রামী কৃষক এবং হতদরিদ্র চরিত্ররা কেবল গল্পের অংশ নয়; তারা আমাদের জানায়, প্রতিটি মানুষের অন্তর্দৃষ্টি ও নৈতিক দায়িত্বই সমাজকে মানবিক ও ন্যায্য করে গড়ে তুলতে পারে। শতবর্ষ পেরিয়েও, শরৎচন্দ্রের সমাজচিন্তা আজও প্রাসঙ্গিক, কারণ এটি আমাদের স্মরণ করায়—যতই সামাজিক কুসংস্কার বা বৈষম্য ঘন হোক, মানবিক চেতনা, নৈতিক দায়বদ্ধতা এবং সাহসই পারে সমাজকে আলোর দিকে পরিচালিত করতে। তাঁর সাহিত্য আমাদের বিশ্বাস ও আশাকে উদ্দীপ্ত রাখে এবং মনে করিয়ে দেয়, মানবতার আলো কখনো নিভে যায় না; বরং প্রতিটি প্রজন্মের চেতনার মধ্য দিয়ে নতুন করে জ্বলতে থাকে।
আজ এই অপরাজেয় কথাশিল্পী ও মহান সাহিত্য স্রষ্টার শুভ জন্মদিনে বিনম্র শ্রদ্ধা ।
লেখক: বাহাউদ্দিন গোলাপ
ডেপুটি রেজিস্ট্রার,
বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়