রাজনীতিতে শেষ কথা বলে কিছু নেই বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও টেলিভিশন উপস্থাপক জিল্লুর রহমান। তিনি বলেছেন, সময় ও প্রেক্ষাপটের পালাবদলে এক সময়ের শত্রুও হয়ে উঠতে পারে মিত্র আর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও ভেঙে যেতে পারে মুহূর্তেই। ইতিহাস, অভিজ্ঞতা এবং বাস্তব উদাহরণ দেখায়-রাজনীতি কোনো স্থির চিত্র নয় এটি পরিবর্তনের খেলা-যেখানে প্রধান চালিকাশক্তি দেশের, দলের বা ব্যক্তির স্বার্থে কাজ করে।
শুক্রবার (১৯ সেপ্টেম্বর) নিজের ইউটিউব চ্যানেলে তিনি এসব কথা বলেন।
জিল্লুর রহমান মনে করেন, দেশ-বিদেশের বিভিন্ন বাস্তব দৃষ্টান্ত, যেখানে ‘অসম্ভব’ মনে হলেও সময়ের প্রয়োজনে বদলে গেছে সমীকরণ, জোট, সম্পর্ক। বাংলাদেশের রাজনীতিও এর ব্যতিক্রম নয়-বরং নানা বাঁকে বাঁকে আমরা সেই রূপান্তরের স্পষ্ট চিত্রই দেখি।
তিনি বলেন, রাজনীতিতে কখনোই কোনো বিষয়কে চূড়ান্ত বলা যায় না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যেমন বলেছিলেন, ‘শেষ কথা কে বলবে, শেষ নাহি যে’-ঠিক তেমনই রাজনীতিতেও ‘শেষ কথা’ বলে কিছু নেই।
আন্তর্জাতিক সম্পর্কের ছাত্রদের কাছেও এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা। রাষ্ট্র, সরকার বা রাজনৈতিক দল-সময়, প্রেক্ষাপট ও স্বার্থের ভিত্তিতে তাদের অবস্থান ও সম্পর্ক বদলাতেই পারে।
জিল্লুর রহমান তার বক্তব্যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির কিছু উদাহরণ তুলে ধরেন। জাপান ও যুক্তরাষ্ট্র-যাদের সম্পর্ক একসময় ভয়াবহ যুদ্ধ ও পারমাণবিক বোমার দুঃসহ স্মৃতি দিয়ে চিহ্নিত ছিল, আজ তারা ঘনিষ্ঠ মিত্র।
ভিয়েতনাম, যাদের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধ ছিল দীর্ঘ ২৫ বছরের, আজ মার্কিন বিনিয়োগের জন্য অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এমনকি চীন-ভারতের মতো দ্বন্দ্বপূর্ণ সম্পর্কেও আমরা দেখি নানা সময়ে সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চলছে। এইসব উদাহরণই প্রমাণ করে, রাজনীতির মূলে থাকে স্বার্থ-আর সেই স্বার্থের জন্য একসময়কার শত্রু পরিণত হয় মিত্রে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের রাজনীতিও এর বাইরে নয়। ঐতিহাসিকভাবে আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে মিলের কোনো কারণ নেই।
কিন্তু এরশাদবিরোধী আন্দোলনে কিংবা বিএনপির বিরুদ্ধে অবস্থান নিতে গিয়ে আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ, জামায়াত ও জাতীয় পার্টি একসঙ্গে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি জামায়াতের তৎকালীন আমির নিজামীকেও একসময় শেখ হাসিনার পাশে প্রেস কনফারেন্সে দেখা গেছে। কেউ কেউ একে রাজনৈতিক সৌজন্য বললেও বাস্তবতা ছিল-স্বার্থের জায়গা থেকেই এই ঐক্য।
ইতিহাসে এ রকম বহু উদাহরণ আছে, যেখানে এক সময়ের প্রতিদ্বন্দ্বীরা একই প্ল্যাটফরমে এসেছে আবার কাছের মিত্ররাও সময়ের সঙ্গে দূরে সরে গেছে। বিএনপির ক্ষেত্রেও একই চিত্র।
যারা এক সময় জামায়াতকে ‘ঘাতক’ বলত, তারাই পরবর্তীতে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জামায়াতের সঙ্গে জোট গঠন করে সরকারে গেছে। অথচ এখন বিএনপি ও জামায়াতের সম্পর্কও ভালো নেই-তারা একে অপরের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। এমনকি গুঞ্জন আছে, ডাকসু নির্বাচনে আওয়ামী লীগ-সমর্থিত ছাত্ররা ছাত্রশিবিরকে ভোট দিয়েছে কি না, তা নিয়েও করিডরে আলোচনা চলছে। প্রশ্ন হলো, যদি আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অংশ না নেয়-তবে তাদের ভোটাররা যাবে কোথায়? বিএনপি? জামায়াত? নাকি জাতীয় পার্টি? অনেকের মতে, জাতীয় পার্টির সামনে একটি ‘পুনরুত্থান’-এর সুযোগ তৈরি হচ্ছে।
জিল্লুর রহমান বলেন, রাজনীতির কেন্দ্রে সবসময় স্বার্থ কাজ করে-তা দেশের হোক, দলের হোক, কিংবা ব্যক্তির। কাউকে যাচাই করতে চাইলে তার স্বার্থে আঘাত করলেই বোঝা যায়, সে আসলে কতটা বিশ্বস্ত। এ কারণেই নির্বাচনের সময় যতই দল নিষিদ্ধ বা সাসপেন্ড হোক না কেন, ভোট এলে আপস হয়-প্রকাশ্যে না হলেও পর্দার আড়ালে। এই জায়গায় এসে বিএনপির অবস্থান অনেকটাই দুর্বল। তারা এখনো পরিষ্কারভাবে ঠিক করতে পারেনি কিভাবে আওয়ামী লীগ ও তার সমর্থকদের মোকাবেলা করবে। তাদের বক্তব্যও একেক সময়ে একেক রকম। অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামী শুরু থেকেই স্পষ্ট ও সংগঠিত কৌশল অনুসরণ করছে। তারা নিজের মতো করে আগাচ্ছে এবং এমনকি বিএনপির নেতৃত্বের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগের চেষ্টাও করছে-যেমনটা শোনা গেছে শফিকুর রহমান লন্ডনে খালেদা জিয়ার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন।
জিল্লুর রহমান মনে করেন, দেশের স্বার্থে সবচেয়ে ভালো হতো যদি সব রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়া হতো। কেউ যদি আওয়ামী লীগকে ফ্যাসিস্ট বলে অন্য কেউ হয়তো বিএনপি বা জামায়াতকে একইভাবে দেখে। অর্থাৎ, কোনো দলের ক্ষেত্রেই মানুষের মধ্যে একচেটিয়া ইতিবাচক ধারণা নেই। এমন বাস্তবতায় সবার জন্য রাজনীতি উন্মুক্ত না রাখলে জনগণের প্রকৃত মত প্রকাশের সুযোগ থাকে না। গণতন্ত্রের সৌন্দর্যই হলো-মানুষ পাঁচ বছর পর পর মতামত বদলাতে পারে। সেই ব্যবস্থাটা নিশ্চিত করাই রাজনীতিবিদদের দায়িত্ব।
ভারতের প্রসঙ্গে তিনি বলেন, বিএনপি এখনো তাদের ভারতবিষয়ক অবস্থান পরিষ্কার করতে পারেনি। অথচ ভারত আমাদের প্রতিবেশী-তারা আমাদের ঘিরে রেখেছে তিন দিক দিয়ে এবং আমাদের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক পরিস্থিতিও তাদের প্রভাবিত করে। তাই দায়িত্বশীল রাজনৈতিক দলদের উচিত-ভারতের সঙ্গে দূরত্ব না রেখে, সংলাপ ও কূটনীতির মাধ্যমে দেশের স্বার্থ আদায় করা। শুধু বৈরিতা দিয়ে কখনোই রাষ্ট্রীয় সফলতা অর্জন সম্ভব নয়।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো-আদর্শ বা রাজনৈতিক দলকে নিষিদ্ধ করে দিলে তা গণতন্ত্রের পরিপন্থী হয়ে যায়। ইতিহাস বলেছে, যাকে দমন করা হয় সে-ই আবার আন্ডারগ্রাউন্ড হয়ে উঠে আসে ভয়ংকর রূপে। কেউ যদি জামায়াতের ১৯৭১ সালের ভূমিকার জন্য তাদের বর্তমান রাজনীতিকে পুরোপুরি বাতিল করে দেন, সেটা এক ধরনের সংকীর্ণতা। বর্তমান প্রজন্মের অনেকেই তো তখন জন্মাননি। তারা যদি রাজনীতিতে আসে, নির্বাচন করে, জয়ী হয়-তাহলে তা মোকাবেলা করতে হবে রাজনৈতিক ও আইনি পথে-নির্বাহী আদেশে নয়।
জিল্লুর রহমান বলেন, আজকে আপনি যাকে প্রত্যাখ্যান করছেন, কাল পরিস্থিতি বদলে গেলে তাকেই পাশে পেতে পারেন। তাই সবার জন্য রাজনীতিকে উন্মুক্ত রাখতে হবে। দল নিষিদ্ধ করে হয়তো সাময়িক স্বস্তি পাওয়া যায় কিন্তু সেটি স্থায়ী সমাধান নয়। অভ্যুত্থান, নিষেধাজ্ঞা এগুলো অস্থায়ী পথ। দীর্ঘমেয়াদে ফিরতে হবে নির্বাচন, আইনের শাসন ও প্রাতিষ্ঠানিক রাজনীতির পথে-এটাই গণতন্ত্রের মূল ভিত্তি।
কেএন/টিকে